ঐতিহ্য
বানান বিশ্লেষণ : ঐ+ত্+ই+হ্+য্+অ ।
উচ্চারণ:
oi.
iɟɔ.ɟɦo (ই‌.তিজ্.ঝো)

=ওই [ঐ যৌগিক স্বরধ্বনি। একাক্ষর হিসেবে ওই হিসেবে উচ্চারিত হয়।]
তিহ্য= তিজ্.ঝো [হ্য =জ্.ঝো হিসেবে উচ্চারিত হয়। পূর্বের তি ধ্বনির সাথে জ্ যুক্ত হয়ে তিজ্ উচ্চারিত হয়। অবশিষ্ট ঝো ধ্বনি স্বাধীনভাবে উচ্চারিত হয়।]

শব্দ-উৎস: সংস্কৃত ऐतिह्य (ঐতিহ্য)>বাংলা ঐতিহ্য।
রূপতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ: ইতিহ+ য (ষ্যঞ্)
পদ : বিশেষ্য

        ঊর্ধ্বক্রমবাচকতা  {| জ্ঞান | মনস্তাত্ত্বিক বিষয় | বিমূর্তন | বিমূর্ত সত্ত | সত্তা |}
অর্থ: পরম্পরাগত আচরণ বিধি।

ইংরেজি :
Tradition

সমাজবিজ্ঞানের বিচারে ঐতিহ্য
সমাজবিজ্ঞানে ব্যবহৃত বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত শব্দ। কোনো নির্দিষ্ট পরিবার বা সমাজ বা জনগোষ্ঠীর ভিতরে কিছু বিশ্বাস, প্রথা, মূল্যবোধ, আচরণ, শিক্ষা ইত্যদির প্রজন্ম থকে প্রজন্মে পালিত হয়ে থাকে এবং যা পরিবার বা সমাজ বা জনগোষ্ঠীর প্রতিটি সদস্য গৌরবের সাথে চর্চা করে। ঐতিহ্য মূলত সমাজিক। সমাজের সদস্যদের অবস্থানের উপর ভিত্তি করে ঐতিহ্য বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।

পারিবারিক ঐতিহ্য
সমাজের ক্ষুদতম দল হলো পরিবার। একটি পরিবারের ভিতরে কোন রীতি বংশানুক্রমে প্রচলিত থাকতে পারে, যা ঐ পরিবারের স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত। যেমন একটি পরিবারে কোনো অতিথি এলো রুপোর থালায় খাদ্য পরিবেশন করা হয়। এই রেওয়াজটা ওই পরিবারে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। এই রীতি সমাজের অন্যান্য পরিবারের মধ্যে যদি না থাকে। তবে ও ঐতিহ্য হয়ে যাবে নিতান্তই পারিবারিক। কোনো কোনো ঐতিহ্য সমাজ বা পরিবারের সদস্যদের চিন্তা-চেতনায় এতটাই গভীরে প্রবেশ করে যে, ওই ঐতিহ্য লঙ্ঘন করাটা সমাজ বা পরিবারের জন্য অসম্মান মনে করা হয়। যেমন কোনো পরিবারের ঐতিহ্যই থাকে দাঙ্গা হাঙ্গামা না করা। ঘটনাক্রমে এই পরিবারের কোনো সদস্য যদি দাঙ্গা-হাঙ্গামা করে, তবে তা ঐ পরিবারের জন্য লজ্জাজনক হয় এবং ঐতিহ্য বহির্ভূত কাজ বিবেচনা করা হয়। সমাজের কল্যাণকর ভাবনা বা কার্যক্রমকে বিশেষভাবে মূল্য দেওয়া হয়। এই কারণে, কোনো পরিবারের সদস্যদের যে কোনো অকল্যাণকর বা নিন্দনীয়কাজকে পারিবারিক ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যেমন- পরিবারের কোনো সদস্য যদি ধর্ষণ করে, চুরি বা ডাকাতি করে, পরিবারের কোনো মেয়ে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ইত্যাদিকে পারিবারিক ঐতিহ্য ভঙ্গের পর্যায়ে ফেলা হয়। অনেক সময়ই একটি একক পরিবারের সাথে- ওই পরিবারের সাথে রক্তের সম্পর্কের বিচারে বংশীয় ঐতিহ্য তৈরি হয়। এ সকল ক্ষেত্রে কোনো একটি পরিবারের একজন সদস্যের ঘৃণ্য কাজকে- এই পরিবারের পুরো বংশের ঐতিহ্যের উপর আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

সামাজিক ঐতিহ্য
ছোটো ছোটো পরিবার নিয়ে গঠিত হয় একটি সমাজ। এই সমাজ হতে পারে পেশাগত। যেমন- কৃষক সমাজ, শ্রমিক সমাজ ইত্যদি। হতে পারে ধর্ম ভিত্তিক। যেমন হিন্দু সমাজ, মুসলমান সমাজ ইত্যদি। সামাজিক ঐতিহ্য হলো- একটি সমাজের অন্তর্গত সকল পরিবারের ভিতর সাধারণভাবে পালিত বা চর্চিত একটি সাধারণ রূপ। পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষা করেও যে সকল ঐতিহ্য সমাজের সকল সদস্য শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করে, সে সকল ঐতিহ্য সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়। যেমন একটি সমাজের সকল সদস্য নবান্ন উৎসব করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এই ক্ষেত্রে তা ঐ সমাজের সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হবে। একটি সামাজিক ঐতিহ্য ওই সমাজের সকল সদস্য নিষ্ঠার সাথে ধারণ করবে, এমনটাই সমাজের সকল সদস্য আশা করে। এর ভিতর দিয়ে একটি সামজিক আদর্শও প্রতিষ্ঠিত হয়। অনেক সময় ব্যক্তি বা পারিবারিক স্বার্থকে অগ্রাহ্য করেও সামাজিক ঐতিহ্য রক্ষায় সমাজের সদস্যরা যত্নবান হয়। ধর্মীয় বিচারে বহু সামাজিক ঐতিহ্য ধর্মীয় শাসন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন পিসি বা মাসির সূত্রে সৃষ্ট ভাইবোনের সম্পর্ককে বিবাহ দ্বারা কলুষিত হয়, এটা হিন্দু ধর্মের অনুশাসন। কিন্তু ইসলামধর্মাবলম্বীদের জন্য এটি ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ নয়। হিন্দু সমাজে এটি ধর্মীয় অনুসানের সূত্রে সামাজিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। আবার অবৈধ সন্তান ধারণ ধর্মীয় বিধিতে অনাচার এবং সামাজিক আচরণবিধির বিচারে ঐতিহ্য লঙ্ঘন।

 

জাতিগত ঐতিহ্য
ছোটো ছোটো সমাজ নিয়ে একটি বৃহৎ-জনগোষ্ঠী যখন একটি জাতীয় সত্তা গঠন করে, তখন ওই জনগোষ্ঠী একটি জাতীয় পরিচয় বহন করে। এই জাতি হতে পারে ধর্ম ভিত্তিক। যেমন- মুসলমান জাতি বা হিন্দু জাতি। আধুনিক জাতি সত্তার শক্তিশালী ভিত্তি হলো ভাষাভিত্তিক। যেমন বাঙালি জাতি, ইংরেজ জাতি। রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে নানা ধর্মের মানুষ নিয়ে গঠিত হলেও সাম্প্রদায়িক অনুভূতির বিচারে বিভাজন আসতে পারে। কিন্তু ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা মানুষকে একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীতে অভিন্ন জাতিসত্তা প্রদান করে। যেমন বাঙালি জাতিসত্তার ভিতরে নানা ধর্মের লোক আছে। কিন্তু ভাষাসত্তার বিচারে সবাই বাঙালি। পারিবারিক ঐতিহ্য, সামাজিক ঐতিহ্য, ধর্মীয় ঐতিহ্য থাকা সত্তেও ভাষাভিত্তিক সাতিসত্তার ভিতরে কিছু সাধারণ ঐতিহ্য রয়েছে যা ঐ ভাষার সকল সদস্য শ্রদ্ধার সাথে চর্চা করে। ভাষাভিত্তিক জাতিসত্তার ভিতরে দেখা যায়- মানুষের জীবন-প্রণালী তথা সংস্কৃতির একটি সাধারণ রূপ পাওয়া যায়। এই সাধারণরূপটিই হলো জাতিগত ঐতিহ্য। যখন শুধু কোনো ধর্ম ভিত্তিক জাতিসত্তার বিচারে ঐতিহ্য পালিত হয়, তখন তা ধর্মীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়। যেমন- মুসলমানদের ঈদ, বাঙালি হিন্দুদের দুর্গাপূজা বা খ্রিষ্টানদের বড় দিন। ধর্মীয় ঐতিহ্যের সাথে দুটি বিষয় মিশে থাকে। একটি হলো ধর্মমতে পালিত অংশ, অপরটি হলো লোকাচার। ঈদের নামাজ পড়াটা ধর্মীয় আচার আর ঈদের দিনে কোলাকুলি করা, আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে দেখা-সাক্ষাৎ বা খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি লোকাচার। এই লোকাচার অংশটুকু জাতীয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে যায়। বাঙালি সমাজে ধর্মীয় উৎসবে পরস্পরকে নিমন্ত্রণ করে। বাঙালি জাতির বিচারে ধর্মীয় আচার ঐতিহ্য নয়, কিন্তু এর সম্প্রীতির লোকাচারটুকু ঐতিহ্য। জাতিসত্তার এই ঐক্য থাকার পরও দেখা যায় কিছু কিছু বিষয় ধর্মীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণ করা হয়। বিশেষ করে ধর্মীয় ঐতিহ্যে অনুষ্ঠিত বিবাহ। বিয়ের বর-কণে দেখেই বুঝা যায়, কোনটি হিন্দু বিয়ে আর কোনটি মুসলমান বিয়ে।

 

ধর্ম, পেশা ইত্যাদির বাইরে একটি জাতি সত্তার ভিতরে কিছু সাধারণ বিষয় চর্চা করা হয়। যেমন প্রাপ্ত বয়স্কা বাঙালি মেয়েরা শাড়ি পড়ে। এই সকল ধর্মের, সকল পেশার বাঙলি মেয়েদের এটা ঐতিহ্য। কখনো কখনো কোনো কোনো বিষয় কোনো জাতিসত্তার গায়ে ঐতিহ্যগত ছাপ পড়ে যায়। যেমন বাঙালিরা নানা রকম খাদ্য দ্রব্য গ্রহণ করলেও বাঙালির ঐতিহ্যগত পরিচয় 'ভাতে-মাছে বাঙালি'।

 

ঐতিহ্য পালন এবং তার পরিবর্তন
ঐতিহ্য একটি সুনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত মানুষ নিষ্ঠার সাথে পালন করে।
কিন্তু সমাজের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের কারণে ঐতিহ্য পরিবর্তন ঘটে। এই পরিবর্তনের কিছু মানুষ প্রাত্যহি্ক জীবনের সুবিধার্থে সানন্দে গ্রহণ করে। কিছু কিছু ঐতিহ্যের পরিবর্তনকে সমাজ মেনে নেয়। যেমন এক সময় নতুন বৌ আসতো পাল্কিতে চড়ে। এটি কোনো কোনো পরিবারের ঐতিহ্য ছিল। আধুনিক যানবাহনের প্রচলনের পর পাল্কি উঠে গেছে। এখন সামর্থ আছে এমন পরিবারের বৌ ঘরে আসে সাজানো মোটর গাড়িতে। কনে সাজানোর রীতিও পাল্টে গেছে। এই জাতীয় বহুবিধি বিষয় ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাপ্তবয়ষ্কা অতি আধুনিক মেয়ে দুই টুকরো কাপড় পড়ে চলাচল করবেন, এমনটা বাঙালি মেয়েদের অধিকাংশ ভাবতেই পারেন না। ধর্মীয় ও সামাজিক বিধি এটাকে ঘৃণার সাথে প্রত্যখ্যান করবে। ইউরোপের এই রীতি বাংলাদেশে ঐতিহ্যগত বিষয় হয়ে উঠতে পারে, এমনটা এখনও ভাবা যায় না।

 

আর্থ-সামাজিক কারণে ঐতিহ্য পরিবর্তন হয়। বাংলাদেশের নিম্নবৃত্তের শ্রমজীবী পুরুষ মানুষ লুঙ্গি পড়ে। কিন্তু ঐ পরিবারের কোনো লেখাপড়া জানা পুরুষ মানুষ যখন চাকরি সুবাদে শহরে আসে তখন সে প্যান্ট পরা শুরু করে। মূলত লেখাপড়া জানা পুরুষ মানুষের প্যান্ট পরাটা ঐতিহ্যে পরিণত হয়ে গেছে। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ এবং শহরের নিম্নবিত্তরা এখনও লুঙ্গি পড়ে ঘরের বাইরে যায়। শহর বা গ্রামঞ্চলের লেখাপড়া জানা মানুষের ঘরের পোশাক লুঙ্গি হলেও বাইরে বেরুনোর জন্য ফুলপ্যান্ট পড়ে এবং এটাও ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।

 

কালের বিচারে মানুষের রুচগত পরিবর্তন ঘটে এবং ঐতিহ্যের পরিবর্তন ঘটে। এক সময় বাঙালি মেয়েরা শাড়ির সাথে ব্লাউজ বা সায় পরতো না। জানা যায় রবীন্দ্রনাথের বৌদি জ্ঞানদানন্দন দেবী আধুনিক শাড়ি পড়ার প্রচলন করেছিলেন। সে আমলের ব্লাউজ বা সেমিজ এখন আর একালের মেয়েরা পড়ে না। এক্ষেত্রে শাড়ি পড়ার ঐতিহ্যটুকু আছে কিন্তু ফ্যাসানটা নেই। মানুষ ঐতিহ্য রক্ষায় যতটা রক্ষণশীল, ফ্যাসানের বেলায় ততটা নয়। বিষয়টা নির্ভর করে মানুষের ফ্যাসানের প্রকৃতির উপর। প্রতিটি সমাজের কিছু শিষ্টাচার আছে, যেগুলো ঐতিহ্যেরই অংশ হয়ে যায়। সেই কারণে ফ্যাসানের নামে শরীর প্রদর্শনকে বাঙালি সমাজে মেনে নেয় না।

বাঙালি সমাজে গুরুজনদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো, এটি বাঙালির ঐতিহ্য। ইউরোপে সবাই সবার নাম ধরে ডাকে। কিন্তু বাঙালি সমাজে পারিবারিক সম্পর্কের বাইরের কোনো বয়সে বড় মানুষকে আপনি সম্বোধন করা হয় এবং নামের সাথে বয়সের বিচারে ভাই, দাদা, মামা, কাকা ইত্যদি যুক্ত করা। দেখা যায় বাবার ভাই, বন্ধু এমন কি বাবার বয়সী লোককে মামা বা কাকা সম্বোধন করা হয়।