১. কল্প-বাস্তবতা: মানুষ তার চারপাশের জগৎকে অনুভব করে, বাস্তবতার নিরিখে। সেখানে শিল্পের স্থান নেই। শিল্পের জগৎ বাস্তব জগতের বাইরে এসে অনুভব করার বিষয়। এই বাইরে জগতটি হলো- কল্পজগৎ। কোনো বাস্তবতাকে যখন কল্পজগতের সাথে মিশিয়ে উপস্থাপিত হয়, তখন তা হয়ে যায় কল্প-বাস্তব জগতের বিষয়। ধরা যাক কোনো শিল্পী একটি কোনো অবয়বের মূর্তি তৈরি করবে, তাহলে তার কাছে একটি বাস্তব মূর্তির রূপ থাকবে। শিল্পী ওই মূর্তি তৈরি সময় তার কল্পনার কিছু অংশ যুক্ত করে দেবে। এর ফলে একটি কল্প-বাস্তব রূপ তৈরি হবে। আবার এমনও হতে পারে শিল্পী তার কল্পনা থেকে এমন একটি রূপ তৈরি করলেন যার কোনো বাস্তব রূপ জগতে পাওয়া যায় না। এক্ষেত্রে শিল্পী তার কল্পনাকে বাস্তব রূপ দেবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। ফলে শিল্পীর কল্পলোক হয়ে যাবে বাস্তবতার অংশ। যদি এই শিল্পকর্ম হয় কোনো অলীক দৈত্যের মূর্তি, তাহলে তাকে শিল্পী এমন ভাবে স্থাপন করবেন যে, ভারসাম্যের অভাবে মূর্তিটি ডিগবাজি না খায়। এক্ষেত্রে শিল্পী মূর্তির ভারসাম্য নির্ধারণ করবেন বাস্তবতার নিরিখে।
আবার অন্য দিক থেকে কল্প-বাস্তব রূপ বিচার করা যেতে পারে। ধরা যাক মানুষের প্রাগৈতিহাসিক কোনো সভ্যতাকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করছেন। ধরা যাক ৩৫,০০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের ঘটনা অবলম্বনে নির্মিত ওই চলচ্চিত্রের কোনো একটি অংশে একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি দেখা যাচ্ছে। দর্শক বাস্তবতার নিরিখে ওই দৃশ্য দেখে ব্যথিত হবেন। দর্শক কল্পনার দোহাই দিয়ে এটা মেনে নিতে পারবেন না।
২. সৃজনশীল কর্ম: কল্প-বাস্তবাতার নিরিখে সৃষ্ট কাজটিতে শিল্পীর সৃজনশীলতা থাকতেই হবে। যদি তা না হয়, তবে তা হবে অনুকরণ। এখানে 'সৃজনশীল' বলতে ধরা হয়েছে, শিল্পির নতুন সৃষ্টির উদ্দীপনা। এর ভিতর শিল্পী হিসেবে তিনি রাখবেন শিল্পীর স্বকীয়তা বা স্বাক্ষর। ধরা যাক কোনো চিত্রকর্মী দ্যা ভিন্সির সৃষ্ট 'মোনালিসা' ছবিটিকে নিখুঁতভাবে আঁকলেন। নিখুঁত অঙ্কনের ওই চিত্রকর্মীকে আমরা বাহবা দেব, কিন্তু শিল্পীর আসনে স্থান দেবো না। কারণ, এতে তাঁর কোনো সৃজনশীল ক্ষমতার প্রকাশ ঘটবে না। ফলে ওই চিত্রের মধ্য দিয়ে শিল্পীর স্বকীয়তা বা স্বাক্ষর প্রকাশিত হবে না।
৩. মঙ্গলময় কর্ম: যদি কোনো সৃষ্টির ভিতরে শিল্পী মঙ্গলময় অনুভবকে শিল্পভোগীর কাছে পৌঁছাতে না পারেন, তবে তা যথার্থ শিল্প হয়ে উঠবে না। যে শিল্পকর্ম মানুষের সুকুমার মনোবৃত্তিকে ধ্বংস করে দেয় বা অমঙ্গলের অশুভ বার্তা পাঠায়, তা কল্পবাস্তবতা এবং সৃজনশীলতার বিচারে যতই নিখুঁত হোক, তা শিল্প-বর্জ্য রূপ পরিত্যাজ্য হবে। ধরা যাক, কোনো চিত্র, গান, গল্প ইত্যাদি যদি মানুষের সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেয় এবং এর প্রভাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টি করে, তবে তা শিল্প-বর্জ্যের তালিকায় স্থান পাবে।
৪. নান্দনিক কর্ম: শিল্পীর সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম হবে আনন্দপ্রদায়ী, যা সুসমন্বয়ে প্রবহমান ধারায় হবে সৌন্দর্যমণ্ডিত বা নান্দনিক।
ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য যে সকল উপাদান মানুষের মন বা 'আমি' নামক সত্ত্বাকে মুগ্ধ করে, তাকে ওই উপাদানের সৌন্দর্য বলা যায়। এই সৌন্দর্য রয়েছে প্রকৃতিতে কিম্বা মনুষ্যসৃষ্ট উপাদানে। এর ভিতরে মানুষের সৌন্দর্যময় সৃষ্টকেই শিল্প বলা হয়। একটি পাহাড়ের যত সৌন্দর্যই থাক, তা শিল্প নয়। কিন্তু এর অনেক খারাপভাবে আঁকা পাহাড়ের ছবিটিকে বলা হবে শিল্প। তাই শিল্প মাত্রেই মানুষের সৃজনশীল কাজ।
কোনো বিষয়ের বিচারে শিল্পকর্ম অখণ্ড সত্তায় বিরাজ করে। একটি গান বা একটি দৃশ্যকে যদি শিল্পকর্ম হিসেবে বিবেচনা করি, তাহলে তা অখণ্ড হিসেবই বিবেচনা করি। একটি হাতভাঙা মানুষের মূর্তিকে শিল্পকর্ম যখন বলা হয়, তখন ভাঙা হাতের উপস্থিতি মনে রেখেই করা হয়। ভাঙা হাতের জন্য আক্ষেপ কিন্তু মনে থেকেই যায়। আবার একটি হাতকেই যদি আলাদাভাবে শিল্পকর্ম হিসেবে নির্বাচন করা হয়, তাহলে যতটুকু শিল্পী দেখাতে চান, ততটুকুই শিল্পকর্ম হবে। এখানে হাত অখণ্ড সত্ত্বা হিসেবেই উপস্থাপিত হবে।
শিল্প বিমূর্ত, তাই তার স্থান মনে। শিল্পের মূল্য 'আমি'র সৌন্দর্যবোধের উপর নির্ভরশীল। মানুষের অন্যান্য সৃষ্টিশীল কাজের সাথে শিল্পকর্মের পার্থক্য গড়ে তোলে তার সৌন্দর্য। যেহেতু সৌন্দর্যবোধ মানুষে মানুষে ভিন্ন, তাই শিল্পের মর্যাদও মানুষে মানুষে ভিন্ন মাত্রা পায়। সেই কারণেই একই গান কারো কাছে খুব ভালো লাগে, আবার সেই গান অন্যের কাছে কুৎসিত মনে হয়।
মানুষের মন প্রাত্যহিক আটপৌরে কাজের ভিতর দিয়ে স্থবির হয়ে যায়। শিল্পকর্ম সেই স্থবির দশা দেখে মুক্তি দেয়। আর সেই মুক্তিই মানুষকে দেয় আনন্দ। শিল্প মানুষকে ভোগের পথে সঞ্চালিত করে, কিন্তু শিল্পবোধই মানুষকে বিকৃতচারিতা থেকে বিরতও রাখে।
শিল্পকলা একটি অসাধারণ যোগাযোগ মাধ্যম। প্রাথমিকভাবে শিল্পী এবং তার শিল্পকর্ম উপভোগকারীর ভিতরে যোগসূত্র গড়ে তোলে। উভয়ের পছন্দের সূত্রে পারস্পরিক সৌন্দর্যবোধের আদান-প্রদান ঘটে। শুধু তাই নয়, শিল্পকর্ম স্থান ও সময়কে অতিক্রম করে চিরায়ত মাধ্যম হয়েও বহু মানুষকে আলোকিত করতে পারে।
সার্বিক বিচারে শিল্পকলাকে প্রধানত দুটিভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগদুটো হলো- চারুশিল্প (fain art) এবং কারুশিল্প (crafts)।
চারুশিল্প
(fain art)
চারুকলা মূলত মানুষের মনের স্থবির
দশা থেকে মুক্তির আনন্দ দেয় এবং মনকে বেগবান করে। এই কলা মানুষের প্রত্যহিক
জীবনধারণের ক্ষেত্রে বৈষয়িক সুবিধা দেয় না, কিন্তু জীবনকে আনন্দময় করে তোলে।
সঙ্গীতকলা, নৃত্যকলা, চিত্রকলা, নাট্যকলা ইত্যাদি। এর ভিতর দিয়ে মানুষ জীবনের
নানা রূপ নানাভাবে প্রকাশ করে। ফলে জীবনকে নানা আঙ্গিকে দেখার অপার ক্ষেত্র
তৈরি করে দেয়।
কারুশিল্প
(crafts)
মানুষের প্রাত্যহিক প্রয়োজনে যে সকল উপাদান ব্যবহৃত হয়, তার ভিতরে সৌন্দর্যের
স্ফুরণ ঘটানো হয় কারুশিল্পে। হাতের কাছে যে চায়ের কাপ আছে, তাকে সুন্দর করে
তৈরি করার ভিতরে রয়েছে কারুশিল্পের কেরামতি। এই শিল্পের বিকাশ ঘটে লোকজ
ঐতিহ্যের সূত্রে। তাই কারুশিল্পের ভিতরে পাওয়া যায় জাতির সংস্কৃতির পরিচয়।
বয়নশিল্প, মৃৎশিল্প, কাঠশিল্পের মতো কারুশিল্পের নমুনা দেশে দেশে ভিন্ন হয়।
কারুশিল্পের বিকাশের সাথে স্থানীয় উপকরণের একটি বিশেষ ভূমিকা থাকে। দেখা যায়,
ঝিনুক ও শামুক শিল্প গড়ে উঠে বৃহৎ জলশয়, নদী বা সমুদ্রের পাড়ে, কিন্তু
বেতশিল্পের বিকাশ ঘটে বেতসমৃদ্ধ জঙ্গলের সূত্রে। যোগাযোগ মাধ্যম ভালো হলে, অনেক
সময় উপকরণের উৎস দূরে হলেও কোনো বিশেষ অঞ্চলে কারুশিল্পের বিকাশ ঘটতে পারে।