বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিতে ধর্মীয় মতবাদ
গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে
সৃষ্টিতত্ত্ব
হিন্দু
ধর্মমতে সৃষ্টি তত্ত্ব
বাইবেলের মতে
সৃষ্টিতত্ত্ব
কুরআনের মতে-
সৃষ্টিতত্ত্ব
গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে সৃষ্টি তত্ত্ব
প্রাচীন গ্রীক পুরাণ মতে- অন্ধকার থেকে
ক্যায়োস
দেবতার জন্ম হয়। পরে ক্যাওস থেকে জন্ম নেন
ইউরোনোমে
।
এই কারণে একে বলা হয়
ক্যায়োস
কন্যা।
জন্মের পর সারা
বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জুড়ে ইনি পা রাখার কোন জায়গা পেলেন না। কারণ তখন আকাশ ও সাগর
একত্রে ছিল। সে কারণে ইনি আকাশ থেকে সাগর পৃথক করলেন। আদি পুরাণ মতে এই সাগর ছিল
একটি জলধারার মতো। এর দেবতা ছিলেন
ওসিনাস।
এরপর সাগরের তরঙ্গে উপর ইনি একাকী নৃত্য করতে লাগলেন। ইতোমধ্যে
ক্যায়োস
অন্ধকারের সাথে মিলিত হয়ে উৎপন্ন করলেন–
রাত্রি,
দিন,
অন্ধকার
ও বাতাস। তাই ইউরিনোমে যখন নাচতে নাচতে দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হলেন,
তখন এর অনুগামী হলো বাতাস। এরপর ইনি বাতাসের গতিকে নির্ধারণ করে দিলেন। এরপর ইনি
উত্তরের বাতাস ধরলেন এবং দুই হাতের ভিতর উক্ত বাতাসকে ঘসলেন। এরপর ইনি ক্যায়োস থেকে
উৎপন্ন
ওফিয়োন
নামক
একটি বিরাট সাপ দেখতে পেলেন। ইউরিনোমে এরপর বিশাল অঞ্চল জুড়ে নাচতে থাকলেন। ধীরে
ধীরে এই নাচের সাথে সাথে
ওফিয়োন
কামাশক্ত হয়ে পড়লেন। সে তার কুণ্ডলী দিয়ে ইউরিনোমেকে আকর্ষণ করলেন। এরপর ইউরিনোমে
একটি ঘুঘুর রূপ ধরে ডিম প্রসব করলেন,
আর
ওফিয়োন
সাতটি পাকে কুণ্ডলি তৈরি করে উক্ত ডিমকে তা দিতে থাকলেন। অবশেষে এই ডিম দুটি ভাগে
বিভক্ত হলো এবং সেখান থেকে তৈরি হলো সূর্য,
চন্দ্রসহ অন্যান্য গ্রহ নক্ষত্র। একই সাথে ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর পাহাড়,
নদী সাগর ইত্যাদি দ্বারা সুসজ্জিত হলো। সৃষ্টি হলো বিভিন্ন গাছপালা ও প্রাণীকুল।
আদি গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে-
ক্যায়োস
স্বয়ম্ভু হিসাবে
বিবেচনা হয়েছে। আর
ইউরোনোমের
সৃষ্টি
হয়েছিল সেই স্বয়ম্ভু
ক্যায়োস থেকে। কিন্তু ইউরিনোমের ছিলেন সর্বত্র ।
রূপকতার আড়াল থেকে ইউরোনামকে বের করে আনলে- সুবিস্তৃত বস্তুরাশির কথাই মনে হয়। সে
কারণেই আকাশ ও পৃথিবীকে একত্রিত অবস্থানে ছিল। ইউরোনাম আকাশকে সাগর থেকে পৃথক
করলেন। এই ধারণা বিজ্ঞানের সাথে মেলে না। কিন্তু ইউরিনোমের নৃত্যকে বস্তুপুঞ্জের
অস্থিরতা ধরা যেতে পারে। সেই অস্থিরতা থেকে বস্তু যখন আন্তঃআর্কষণে
কেন্দ্রীভূত হতে থাকলো- তখন
ঘূর্ণায়মান গতির সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে তৈরি হয়েছিল বিশালকারে গতিময় কুণ্ডলিত অবয়ব।
যাকে হয়তো গ্রিক পৌরাণিক কাহিনীতে অফিয়ন নামক একটি বিরাট সাপের
কুণ্ডল হিসাবে
কল্পনা করা হয়েছে। উভয়ের মিলনে যে অণ্ডের সৃষ্টি হয়- তাই ছিল বিগব্যাং-এর
পূর্ববর্তী সুপার এটম। গ্রিক পুরাণের সেই আদি অণ্ড ফেটে গিয়ে মহাকাশ ও এর অন্যান্য
উপকরণ (সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র ইত্যাদি) তৈরি হয়েছিল।
হিন্দু ধর্মমতে সৃষ্টি তত্ত্ব
হিন্দু ধর্ম বিশ্বাস একক কোন প্রধান ধর্মগ্রন্থের অনুসরণে গড়ে উঠে নি। যেমন- ইসলাম
ধর্মের কুরআন, খ্রিষ্টান ধর্মের জন্য বাইবেল। হিন্দু ধর্ম হলো একাধিক প্রাচীন
ঋষিদের রচিত গ্রন্থের সমন্বিত দর্শন। এর সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে বিভিন্ন পৌরাণিক
উপাখ্যান।
হিন্দু ধর্মের যে এক ও অদ্বিতীয় সত্তা, তার নাম হলো ব্রহ্ম। ঈশ উপনিষদের ব্রহ্মের
প্রকৃতি হিসাবে বলা হয়েছে-
ওঁ পূর্ণমদঃ পূর্ণমিদং পূর্ণাত্ পূর্ণমুদচ্যতে।
পূর্ণস্য পূর্ণমাদায় পূর্ণমেবাবশিষ্যতে
সরলার্থ : উহা (পরব্রহ্ম) পূর্ণ, ইহা (নামরূপে স্থিত ব্রহ্ম) পূর্ণ; এই সকল সূক্ষ্ম
ও স্থূল পদার্থ পরিপূর্ণ ব্রহ্ম হইতে উদগত বা অভিব্যক্ত হইয়াছে। আর সেই পূর্ণস্বভাব
ব্রহ্ম হইতে পূর্ণত্ব গ্রহণ করিলেও পূর্ণই অর্থাৎ পরব্রহ্মই অবশিষ্ট থাকেন।
ত্রিবিধ বিঘ্নের (আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক) শান্তি হোক।
ঈশ উপনিষদ। শান্তিপাঠ। [অতুলচন্দ্র
সেন, সীতানাথ তত্ত্বভূষণ, মহেশচন্দ্র কর্তৃক অনূদিত ও সম্পাদিত- উপনিষদের
অখণ্ড সংস্করণ থেকে উদ্ধৃত করা হলো।]
উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম অদ্বিতীয় সত্তা। ইনি সূক্ষ্ম ও স্থূল সকল কিছূরই উত্স। এই উত্স
থেকে জগতের বিভিন্ন উপকরণের সৃষ্টি হয়। এর সমর্থন পাওয়া যায় অন্যান্য হিন্দু
ধর্মগ্রন্থে। যেমন- মার্কেণ্ডয় পুরাণে আছে-
যা অব্যক্ত এবং ঋষিরা যাকে প্রকৃতি বলে থাকেন, যা ক্ষয় বা জীর্ণ হয় না, রূপ রস গন্ধ
শব্দ ও স্পর্শহীন, যার আদি অন্ত নেই, যেখান থেকে জগতের উদ্ভব হয়েছে, যা চিরকাল আছে
এবং যার বিনাশ নেই, যার স্বরূপ জানা যায় না, সেই ব্রহ্ম সবার আগে বিরাজমান থাকেন।
মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
উপনিষদ ও মার্কেণ্ডয় পুরাণ অনুসারে- দেখা যাচ্ছে, সৃষ্টির আদিতে পরমব্রহ্ম বিরাজ
করেন। এবং সেই পরমব্রহ্ম থেকেই জগতের সব কিছু সৃষ্টি হয়। এই সৃষ্টি প্রক্রিয়ার
স্তরগুলো সম্পর্কে মার্কেণ্ডয় পুরাণে যা বিবৃত হয়েছে, তা হলো-
সত্ত্ব (প্রকৃতি) রজ (যার প্রভাবে অহংকারসহ অন্যান্য মন্দগুণের জন্ম হয়) ও তম
(অন্ধকার) এই তিন গুণ তাঁর মধ্যে পরস্পরের অনুকূলে ও অব্যাঘাতে অধিষ্ঠিত আছে।
সৃষ্টির সময়ে তিনি (ব্রহ্ম) এই গুণের সাহায্যে সৃষ্টিক্রিয়ায় প্রবৃত্ত হলে প্রধান
তত্ত্ব প্রাদুর্ভূত হয়ে মহত্তত্ত্বকে (মহৎ নামক তত্ত্ব) আবৃত করে। এই মহত্তত্ত্ব
তিনগুণের ভেদে তিন প্রকার। এর থেকে তিন প্রকার ত্রিবিধ অহঙ্কার প্রাদুর্ভূত হয়। এই
অহঙ্কারও মহত্তত্ত্বে আবৃত ও তার প্রভাবে বিকৃত হয়ে শব্দতন্মাত্রের সৃষ্টি করে। তা
থেকেই শব্দ লক্ষণ আকাশের জন্ম। অহঙ্কার শব্দমাত্র আকাশকে আবৃত করে এবং তাতেই
স্পর্শতন্মাত্রের জন্ম। এতে বলবান বায়ু প্রাদুর্ভূত হয়। স্পর্শই বায়ুর গুণ।
শব্দমাত্র আকাশ যখন স্পর্শমাত্রকে আবৃত করে, তখন বায়ু বিকৃত হয়ে রূপমাত্রের সৃষ্টি
করে। বায়ু থেকে জ্যোতির উদ্ভব, রূপ ঐ জ্যোতির গুণ। স্পর্শমাত্র বায়ু যখন
রূপমাত্রকে আবৃত করে, তখন জ্যোতি বিকৃত হয়ে রসমাত্রের সৃষ্টি করে। তাতেই রসাত্মক
জলের উদ্ভব। সেই রসাত্মক জল যখন রূপমাত্রকে আবৃত করে তখন জল বিকৃত হয়ে গন্ধমাত্রের
সৃষ্টি করে। তাতেই পৃথিবীর জন্ম হয়। মার্কেণ্ডয় পুরাণ/শ্রীসুবোধকুমার চক্রবর্তৗ।
পুরাণের এই বিবৃত থেকে বুঝা যায় ব্রহ্মা প্রকৃতিকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রূপান্তর করে
পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু এই বর্ণনা আমাদের কাছে সুষ্পষ্ট বর্ণনার পরিবর্তে এক
দুর্বোধ্য কল্পনাকে জাগ্রত করে। আবার বিভিন্ন পণ্ডিতরা যখন এর ব্যাখ্যা নিজেদের
মতো করে করতে থাকেন, তখন তা বিভিন্ন অর্থে প্রতীয়মান হতে থাকে।
মহাভারতের আদিপর্বের সৃষ্টিবর্ণন অংশের- সৃষ্টি তত্ত্ব থেকে যে ধারণা পাই তা কিছুটা
আধুনিক বিজ্ঞানের সমার্থক বলেই বোধ হয়। আধুনিক বিজ্ঞান বলে- আদিতে বস্তুপুঞ্জ
একত্রিত হয়ে একটি পিণ্ডের সৃষ্টি হয়েছিল। উক্ত পিণ্ডের বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে
বর্তমান মহাবিশ্বের জন্ম হয়েছিল। তবে মহাভারতে এর সাথে ঐশ্বরিক সত্তার মহিমা যুক্ত
করার কারণে- এই বর্ণনা ভিন্ন মাত্রায় রূপ পরিগ্রহ করেছে। যেমন-
প্রথমতঃ এই বিশ্বসংসার কেবল ঘোরতর অন্ধকারে আবৃত ছিল। অনন্তর সমস্ত বস্তুর বীজভূত
এক অণ্ড প্রসূত হইল। ঐ অণ্ডে অনাদি, অনন্ত, অচিন্তনীয়, অনির্বচনীয়, সত্যস্বরূপ
নিরাকার, নির্বিকার, জ্যোতির্ময় ব্রহ্ম প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ঐ অণ্ডে ভগবান্
প্রজাপতি ব্রহ্মা স্বয়ং জন্ম পরিগ্রহ করিলেন। তত্পরে স্থাণু, স্বায়ম্ভু মনু দশ
প্রচেতা, দক্ষ, দক্ষের সপ্ত পুত্র, সপ্তর্ষি, চতুর্দশ মনু জন্মলাভ করিলেন। মহর্ষিগণ
একতানমনে যাঁর গুণকীর্তন করিয়া থাকেন, সেই অপ্রমেয় পুরুষ, দশ বিশ্বদেব, দ্বাদশ
আদিত্য, অষ্টবসু, যমজ অশ্বিনীকুমার, যক্ষ, সাধুগণ, পিশাচ, গুহ্যক এবং পিতৃগণ
উত্পন্ন হইলেন। তত্পরে জল, পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, দশ দিক্, সংবত্সর, ঋতু, মাস, পক্ষ,
রাত্রি ও অন্যান্য বস্ত ক্রমশঃ সঞ্চাত হইল।
(কালীপ্রসন্নসিংহ কর্তৃক অনূদিত সংস্করণ থেকে।)
হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলোতে সৃষ্টি-তত্ত্বের রূপ মোটামুটি এই ভাবেই বিবৃত হয়েছে। এই
সকল বর্ণনা অনুসারে যে সার কথা পাওয়া যায় তা হলো- আদিতে ব্রহ্ম নামক পরম সত্তা
ছিল। উক্ত সত্তা প্রকৃতিকে একটি বিশাল অণ্ডে রূপান্তরিত করলেন। উক্ত অণ্ড থেকে
সৃষ্টি হয়েছিল বিশ্ব-চরাচর এবং দেবতাসহ অন্যান্য সকল প্রাণী। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো-
সৃষ্টির আদিতে যে ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি হয়েছিল, তাকে সমর্থন করা গেলেও- পৃথিবী সৃষ্টির
আগে জলের অস্তিত্বের কথা বলে- বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। যদি হিন্দু দর্শন আরও
সুবিস্তৃত। তারপরেও বলা যায় গ্রীক পুরাণের সাথে হিন্দু দর্শনের মূল কথা একই রকম।
বাইবেলের মতে- সৃষ্টিতত্ত্ব
বাইবেলের পুরাতন নিয়মের আদিপুস্তক অধ্যায় শুরু হয়েছে জগত্সৃষ্টির বিবরণের মাধ্যমে।
এই বিবরণটি নিম্নরূপ-
১ আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি করিলেন।
২ পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা জলের উপর অবস্থিতি
৩ করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল।
৪ তখন ঈশ্বর দীপ্তি উত্তম দেখিলেন, এবং ঈশ্বর অন্ধকার হইতে দীপ্তি পৃথক
৫ করিলেন। আর ঈশ্বর দীপ্তির নাম দিবস ও অন্ধকারের নাম রাত্রি রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে প্রথম দিবস হইল।
৬ পরে ঈশ্বর কহিলেন, জলের মধ্যে বিতান হউক, ও জলকে দুই ভাগে
৭ পৃথক করুক। ঈশ্বর এইরূপে বিতান করিয়া বিতানের উদ্ধস্থিত জল হইতে বিতানের অধঃস্থিত
জল পৃথক করিলেন;
৮ তাহাতে সেইরূপ হইল। পরে ঈশ্বর বিতানের নাম আকাশমণ্ডল রাখিলেন। আর সন্ধ্যা ও
প্রাতঃকাল হইলে দ্বিতীয় দিবস হইল।
৯ পরে ঈশ্বর কহিলেন, আকাশমণ্ডলের নীচস্থ সমস্ত জল এক স্থানে সংগৃহীত হউক ও স্থল
সপ্রকাশ হউক, তাহাতে
১০ সেইরূপ হইল। তখন ঈশ্বর স্থলের নাম ভূমি, ও জলরাশির নাম সমুদ্র রাখিলেন; আর ঈশ্বর
দেখিলেন যে,
১১ তাহা উত্তম। পরে ঈশ্বর কহিলেন, ভূমি তৃণ, বীজোত্পাদক ওষধি, ও সবীজ
স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী ফলের উত্পাদক ফলবৃক্ষ, ভূমির উপরে উত্পন্ন করুক;
১২ তাহাতে সেইরূপ হইল। ফলতঃ ভূমি তৃণ, স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী বীজোত্পাদক ওষধি, ও
স্ব স্ব জাতি অনুযায়ী সবীজ ফলের উত্পাদক বৃক্ষ, উত্পন্ন করিল;
আর ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে সকল
১৩ উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে তৃতীয় দিবস হইল।
১৪ পরে ঈশ্বর কহিলেন, রাত্রি হইতে দিবসকে বিভিন্ন করণার্থে আকাশমণ্ডলের বিতানে
জ্যোতির্গণ হউক; সে সমস্ত চিহ্নের জন্য, ঋতুর জন্য এবং দিবসের ও
১৫ বত্সরের জন্য হউক; এবং পৃথিবীতে দীপ্তি দিবার জন্য দীপ বলিয়া আকাশ-মণ্ডলের বিতান
থাকুক; তাহাতে সেই
১৬ রূপ হইল। ফলতঃ ঈশ্বর দিনের উপর কর্ত্তৃত্ব করিতে এক মহাজ্যোতিঃ, ও রাত্রির উপরে
কর্ত্তৃত্ব করিতে তদপেক্ষা এক জ্যোতিঃ, এই দুই বৃহৎ জ্যোতিঃ,
এবং নক্ষত্রসমূহ নির্ম্মাণ করিলেন।
১৭ আর পৃথিবীতে দীপ্ত দিবার জন্য, এবং দিবস ও রাত্রির উপরে কর্ত্তৃত্ব
১৮ করণার্থে, এবং দীপ্তি হইতে অন্ধকার বিভিন্ন করণার্থে ঈশ্বর ঐ জ্যোতিঃসমূহকে
আকাশমণ্ডলের বিতানে স্থাপন করিলেন, এবং ঈশ্বর দেখিলেন যে, সে
১৯ সকল উত্তম। আর সন্ধ্যা ও প্রাতঃকাল হইলে চতুর্থ দিবস হইল।
পবিত্র বাইবেল /পুরাতন ও নূতন নিয়ম/বাংলাদেশ বাইবেল সোসাইটি, ঢাকা
বাইবেলের এই বর্ণনার সাথে আধুনিক বিজ্ঞানের সৃষ্টি তত্ত্বের বিশাল পার্থক্য লক্ষ্য
করা যায়। এমন কি- কিছু কিছু ভাষ্য অযৌক্তিক মনে হয়। যেমন-
১। উপরের উদ্ধৃতির ১, ২, ৩ অংশ জুড়ে পাই- আদিতে ঈশ্বর আকাশমণ্ডল ও পৃথিবী সৃষ্টি
করিলেন। পৃথিবী ঘোর ও শূন্য ছিল, এবং অন্ধকার জলধির উপরে ছিল, আর ঈশ্বরের আত্মা
জলের উপর অবস্থিতি করিতেছিলেন। পরে ঈশ্বর কহিলেন, দীপ্তি হউক, তাহাতে দীপ্তি হইল।
বিজ্ঞানের মতে পৃথিবী আদিতে ছিল গ্যাসপূর্ণ আগুনে গোলক হিসাবে। সেখানে বাইবেল
আদিতেই পানির অস্তিত্বকে তুলে ধরছে। বাইবেলের এই ধারণার সাথে বিজ্ঞানের ধারণা না
মিললেও গ্রীক ও হিন্দু ধর্মের সাথে মিলে। হিন্দু ধর্মমতে সমগ্র পৃথিবী জলমগ্ন ছিল-
আর তার উপরে বিষ্ণু অনন্ত শয়নে ছিলেন। নার অর্থ জল।
নারের উপর বিষ্ণু অবস্থান
করছিলেন বলে- তিনি নারায়ণ। কিন্তু ভিন্ন প্রেক্ষাপটে বিচার করলে, বিষয়টি ততটা
অযৌক্তিক মনে হয় না। এই বিষয়টি নিয়ে তৃতীয় পাঠে আলোকপাত করেছি।
২। বাইবেলের মতে চতুর্থ দিনে ঈশ্বর সুর্য তৈরি করলেন, পৃথিবী সৃষ্টির পরের কথা।
বিজ্ঞানের মতে- সূর্য পৃথিবী একই সাথে তৈরি সৃষ্টি হয়েছিল। তা ছাড়া গাছ-পালা জন্মের
জন্য সূর্য-কিরণ একটি অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ। অথচ বাইবেলের মতে সৃষ্টির তৃতীয় দিনেই
গাছ-পালা সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। প্রাণী সৃষ্টির যে কালানুক্রমিক ধারা বাইবেলে
পাওয়া যায়- তার সাথে প্রাণের ক্রমবিকাশ বা বিবর্তনের ধারা মেলে না।
কুরআনের মতে- সৃষ্টিতত্ত্ব
পূর্বে আলোচিত গ্রীক, হিন্দু পৌরাণিক গ্রন্থসমূহ বা বাইবেলের মতো- কুরআনে কোন
তথ্যাবলী উপস্থাপনেই ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয় নি। মূলত আল্লাহর স্বরূপ, আল্লাহর প্রতি
মানুষের আনুগত্য, সহজ ও সরল পথ অনুসরণে মানুষের জীবন-যাপনের ধারা ইত্যাদি সম্পর্কিত
নির্দেশাবলী কুরআনের বিষয়। তাত্ক্ষণিকভাবে উক্ত প্রেরিত বাণী ছিল- তত্কালীন
আরববাসীদের জন্য। কিন্তু এই বাণী এমনভাবে পরিবেশন করা হয়েছিল- যাতে করে আগামী দিনের
সকল ভূখণ্ডের মানুষও দিক নির্দেশনা পেতে পারে। এই নির্দেশনার অনুসঙ্গ বা উদাহরণ
হিসাবে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন সহায়ক তথ্যাবলী। এই তথ্যাবলীর ভিতর রয়েছে- পূর্ববর্তী
বিভিন্ন নবীদের কার্যকলাপ, প্রাচীন ইতিহাস, প্রকৃতি, মানুষ সৃষ্টি সম্পর্কিত
বিভিন্ন তথ্যাবলী, মানুষের জীবন-যাত্রার পদ্ধতি-সহ আরও বিবিধ প্রাসঙ্গিক বিষয়।
বিষয়াবলী এইভাবে উপস্থাপনের কারণে কুরআনের অনেক জায়গাতেই একই উদাহরণ বারবার এসেছে।
উদাহরণ প্রয়োগে বা মূল নির্দেশনামাটি কোনো ক্ষেত্রে বিস্তৃতভাবে এসেছে। আবার
কোন কোন ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংক্ষিপ্তাকারে এসেছে। সেই কারণে পুরো কুরআন পাঠ না
করে- এর অংশ বিশেষের নির্দেশ মেনে কোন বিষয়ের মীমাংশা করাটা অত্যন্ত অবিবেচকের কাজ
হবে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে- আমাদের দেশের তথাকথিত ফতোয়াবাজরা এই কাজটি বেশ
নিষ্ঠার সাথে করে থাকেন।
কুরআনে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির ক্ষেত্রেও তথ্যাবলী পাওয়া যায়- সহায়ক উপকরণ
হিসাবে। যেহেতু এই সহায়ক বাণীগুলো বিভিন্ন প্রসঙ্গে বিস্তারিত বা সংক্ষিপ্ত
আকারে এসেছে- তাই কোন বিশেষ সুরার বিশেষ আয়াতকে উপস্থাপন করে বিষয়টি বুঝতে গেলে
বিভ্রান্তির সৃষ্টি হতে পারে। যেমন- কুরাআনে মহাবিশ্ব সৃষ্টি ও পৃথিবী সৃষ্টি
প্রসঙ্গে ২ দিন বা ৬ দিনের কথা বলা হয়েছে। কুরআনের সমগ্র পাঠ উপলব্ধি না করলে-
বিষয়টি অবশ্যই বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। আসুন এই বিভ্রান্তিকর বিষয়টি দিয়েই
কুরআনের দৃষ্টিতে সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে আলোকপাত করা যাক।
সূরা আরফ। আয়াত ৫৪
৫৪ নিশ্চয়ই তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় দিনে সৃষ্টি
করেছেন।....
এখান সমগ্র বিশ্বচরাচর ৬ দিনে সৃষ্টির কথা বলা হয়েছে। এই হিসাবটি বাইবেলের সাথে
মিলে যায়। কিন্তু এই আয়াতে ৬ দিনের সৃষ্টিকে দুটি ভাগে ভাগ করেছে। একটি ভাগ
নভোমণ্ডল- অর্থাৎ মহাকাশ ও এর সকল উপকরণ (গ্যালাক্সি ও
মহাকাশীয় অন্যান্য উপকরণ)। দ্বিতীয় ভাগে সৃষ্টি করছেন ভূমণ্ডল- অর্থাৎ পৃথিবী।
এখানে একটি বিষয় লক্ষ্য করুন এখানে অধিকাংশ অনুবাদক দিন শব্দ ব্যবহার করেছেন। সেই
কারণে আমিও দিন ব্যবহার করেছি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এই দিন বলতে কি বুঝানো হয়েছে
সেটিও ভাববার বিষয়।
এখানে পার্থিব দিনের হিসাব গ্রহণ করা যাবে না। কারণ, সৃষ্টির আদিতে যখন পৃথিবী-
সূর্য তৈরি হয় নি তখন-পার্থিব দিনের বিষয়টি আসতে পারে না। আপনার হয়তো অনেকেই জানেন
যে- আরবী ইয়াওম শব্দের অর্থ দিন। কিন্তু উক্ত আয়াতে ব্যবহার করা হয়েছে আইয়াম।
উল্লেখ আইয়াম হলো ইয়াওম শব্দের বহুবচন- অর্থাৎ দিবসসমূহ। এখানে আক্ষরিক দিবসসমূহ
অর্থ গ্রহণ না করে এর অর্থ গ্রহণ করা উচিৎ কাল, পর্যায়, যুগ ইত্যাদি অর্থে। সে
হিসাবে এই আয়াতের অনুবাদ হওয়া উচিত্ ....তিনি নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলকে ছয় কালে
(পর্যায়ে বা যুগে) সৃষ্টি করেছেন।
কুরআনে বর্ণিত এই ছয় মহাকালের মধ্যে আল্লাহ কোন পর্যায় কি তৈরি করেছেন, তা পাওয়া
যায়- সূরা হা-মীম সেজদাহ-তে।
সূরা হা-মীম সেজদাহ। আয়াত ৯-১১
৯ বলুন, তোমরা কি সে সত্তাকে অস্বীকার কর যিনি পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুদিনে এবং তোমরা কি তার সমকক্ষ স্থির কর? তিনি তো সমগ্র বিশ্বের পালনকর্তা।
১০ তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগ অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন, তাতে কল্যাণ
নিহিত রেখেছেন এবং চার দিনের মধ্যে তাতে তার খাদ্যের ব্যবস্থা করেছেন- পূর্ণ হল জিজ্ঞাসুদের জন্য।
১১ অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্রকুঞ্জ......
এই সুরায় উল্লেখিত দুই দিন নিয়ে অনেক অনূবাদক বা সমালোচক বিভ্রান্তিতে পতিত হন।
লক্ষ্য করুন সূরা আরফ-এর ৫৪ আয়াত ছয়টি পর্যায়ে নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডল সৃষ্টির কথা বলা
হয়েছে। অর্থাৎ এখানেই সমগ্র ছয়টি পর্যায়কে দুটো ভাগে ভাগ করা হয়েছে। এর একটি
হলো-নভোমণ্ডল সৃষ্টি কাল অপরটি ভূমণ্ডল সৃষ্টিকাল। এই দুটি পর্যায়ের প্রথমেই
নভেমণ্ডল তৈরি করার সময়ই পৃথিবী তৈরি হয়ে গেছে। বিশ্বচরাচরের প্রাথমিক বিন্যাসে
আল্লাহ মাত্র দুটি সময়-পর্যায় ব্যয় করেছেন। ফলে ৬টি পর্যায়ের মধ্যে চারটি পর্যায়
অবশিষ্ট থেকে যায়। এই কারণে সূরা হা-মীম সেজদাহ ৯ আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে -যিনি
পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন দুদিনে।
বাকি চারটি পর্যায়ে- আল্লাহ ভূমণ্ডল তৈরিতে মনোনিবেশ করলেন। ফলে পৃথিবীর উপরিভাগে
পাহাড় পর্বত স্থাপন করছেন। সূরা হা-মীম সেজদাহ ১০ আয়াতে তার উল্লেখ পাওয়া যায় এই
ভাবে- তিনি পৃথিবীতে উপরিভাগ অটল পর্বতমালা স্থাপন করেছেন। এর সাথে উক্ত আয়াত থেকেই
জানা যায় যে আল্লাহ খাদ্যের উপযোগী পরিবেশ ও উপকরণ সৃষ্টি করেছেন। অর্থাৎ নদী,
সাগর, প্রাণধারণের উপযোগী বায়ুমণ্ডল, গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণী তৈরির বিষয়টিও এই
সময়ে সম্পন্ন হয়েছিল।
বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ১৫০০-১০০০ কোটি বত্সরের মধ্যে গ্যালাক্সিগুলোর বিন্যাস হয়েছিল
বটে কিন্তু সুবিন্যাস্ত ছিল না। কিন্তু ৫০০ কোটি বত্সরের মধ্যে যখন সূর্য, পৃথিবী
ইত্যাদি তৈরি হয়েছিল, তখন মহাকাশেও তেমনি প্রক্রিয়া চলছিল। এই পর্যায়ে কিছু কিছু
নক্ষত্র তৈরির প্রক্রিয়া চলতে থাকলেও তাদের অধিকাংশই তখন গ্যাসীয় অবস্থাতেই ছিল।
কুরআনের মতে- মহাকাশের এই পরিবর্তনের সূচনা করলেন আল্লাহ। এবং কুরআনের মতে- আল্লাহ
এই ধুম্রকুঞ্জের দিকে নজর দিলেন। অর্থাৎ ধুম্রকুঞ্জকে বিভিন্ন মহাকাশীয় অবজেক্টে
পরিণত করলেন। সৃষ্টির এই পর্যায়ে যখন আকাশ মণ্ডলের দিকে আল্লাহ নজর দিলেন- তখন
মহাকাশকে সম্প্রাসরণ ও পৃথিবীকে বিস্তৃত করেছেন। বিষয়টি সূরা আন্-নাযিআত-এ যেভাবে
বলা হয়েছে, তা হলো-
সূরা আন্-নাযিআত। আয়াত ২৭-৩০
২৭ তোমাদের সৃষ্টি অধিক কঠিন না আকাশের, যা তিনি নির্মাণ করেছেন?
২৮ তিনি একে উচ্চ করেছেন ও সুবিন্যস্ত করেছেন।
২৯ তিনি রাত্রিকে করেছেন অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং এর সূর্যালোক প্রকাশ করেছেন।
৩০ পৃথিবীকে এর পরে বিস্তৃত করেছেন।
এই ছয়টি পর্যায়ের ভিতরই মহাকাল সম্প্রসারিত হওয়ার কথা। নাকি মহাজাগতিক
বিগব্যাং-এর পরে কিছু সময় এই সম্প্রসারণ স্তিমিত বা থেমে গিয়েছিল কি? এবং পরে এর
সম্প্রসারণের প্রক্রিয়া চালু হয়েছিল? এই জাতীয় প্রশ্নটি উঠতেই পারে। কোন একটি
বিশাল বিস্ফোরণের পর, কেন্দ্রে যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় এই স্থবিরতা
নেমে আসতেই পারে।
উপরের ধর্মীয় মতাদর্শগুলো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি সম্পর্কে ইঙ্গিত দিয়েছে মাত্র। এই
ইঙ্গিতকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করে নিতে হবে- এমন কঠোর নির্দেশই প্রদান করা হয়েছে।
এই নির্দেশ মানতে গিয়ে সত্য রক্ষিত হবে কিনা তা বিবেচ্য নয়। যে ক্ষেত্রে ধর্মীয় এই
বিশ্বাসের সাথে সত্যানুসন্ধানের ঐক্য হবে- সেখানে ধর্মবাদীরা ধর্মের সত্যনিষ্ঠ
শক্তির কথা সগৌরবে প্রচার করেন। কিন্তু যেখানে এই সত্য লঙ্ঘিত হয়- সেখানেই সৃষ্টি
হয় সত্যের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসের সংঘাত। যেমন, খ্রীষ্টান-পুরোহিতদের সাথে
গ্যালিলিওর মতবাদের সংঘাত।
মূলত ধর্মীয় দর্শনের সাথে সংঘাতের সূত্রপাত ঘটে বিজ্ঞানের আলোকময় পথে। প্রশ্ন হলো
বিজ্ঞান কি সর্বদা অভ্রান্ত। না তেমনটি ভাবার কোন কারণ নেই। কিন্তু বিজ্ঞানের
বিকাশ ঘটে চলে, ত্রুটি সংশোধনের ক্রমধারার মধ্য দিয়ে। কিন্তু ধর্মীয় বয়ানকে গোড়া
থেকে অভ্রান্ত ও চিরন্তন হিসাবে ধরে নেওয়া হয়। এর কোন অংশ সংশোধন করতে গেলেই-
ধর্মের এই চির সত্যের প্রাসাদ ভেঙে পড়ে। তাই বিজ্ঞানীরা যেখানে প্রতিনয়ত নিষ্ঠার
সাথে সত্যের কাছে পৌছার জন্য নিজেদের সত্যকেই অগ্রাহ্য করে নূতন সত্যকে উপস্থাপন
করে। সেখানে ধর্মীয় পুরোহিতরা মিথ্যা জেনেও পুরানো ধারণাকে নিষ্ঠার সাথে রক্ষা
করার চেষ্টা করেন।