মস্তিষ্ক
ইংরেজি : Brain
মেরুদণ্ডী বা অমেরুদণ্ডী প্রাণীর স্নায়ুতন্ত্রের কেন্দ্রীয় অংশ এবং যা জীবদেহকে নিয়ন্ত্রণ করে।

মানব মস্তিষ্ক
মানবদেহের শীর্ষদেশে মস্তিষ্কের অবস্থান। প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মস্তিষ্কের আয়তন ১৫০০ ঘন সেন্টিমিটার, গড় ওজন ১.৩৬ কেজি। মানদেহের কঙ্কালতন্ত্রের করোটির ভিতরে মস্তিষ্ক সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে। মানুষের দৈহিক ও মানসিক পরিচালনে মস্তিষ্ক কেন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে থাকে। এই পরিচালনের ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক পঞ্চেন্দ্রিয় এবং যোগাযোগ রক্ষাকারী স্নায়ুতন্ত্রকে ব্যবহার করে।

মস্তিষ্কের ক্রমবিকাশ:
মানুষের ভ্রূণদশায় মস্তিষ্ক সুষম্নাকাণ্ডের অগ্রভাগে থাকে। ভ্রূণদশায় মানুষের মস্তিষ্কের তিনটি স্তর থাকে। ভ্রূণের বৃদ্ধির সাথে সাথে মস্তিষ্কের মধ্যবর্তী স্তর বাইরের স্তরের দিকে নানা ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যাদি পাঠাতে থাকে। এর দ্বারা নলাকার
স্নায়ুকোষ (neurons) গঠিত হয়। এই পর্যায়ে মস্তিষ্কের আদি দশার উৎপত্তি ঘটে। মানবদেহের বিভিন্ন অংশের গঠন প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করে নানা ধরনের জিনঘটিত উপাদান। এরা সাধারণ নাম জিনোম (Genome)। মানবদেহে জিনের সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর ভিতরের অসংখ্য জিনের নিয়ন্ত্রণে মস্তিষ্ক গঠিত হয়। কোনো কারণে জিন নষ্ট হয়ে গেলেই জিনঘটিত রোগের সৃষ্টি হয়। মানবভ্রূণের আদিতে এই সকল জিন মস্তিষ্ক গঠনের যে নির্দেশ দেয়, তার সূত্রে তৈরি হয় স্নায়ুকোষ। মস্তিষ্কের বিভিন্ন অংশের ভিতরে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে এই স্নায়ুকোষগুলো তৈরি হয়। মস্তিষ্কের স্নাহুকোষের সংখ্যা প্রায় ০০,০০০,০০০,০০০। বলাই বাহুল্য এই সংখ্যা মানবদেহের মোট জিনের সংখ্যার চেয়ে বেশি। মানুষের মস্তিষ্কের ভিতরে স্নায়ুকোষ ছাড়াও থাকে, গিলাল কোষ এবং রক্তবাহী শিরা। স্নায়ুকোষ সমূহের মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গাকে বলা হয় সিন্যাপ্স। এর ভিতর দিয়ে বৈদ্যুত্যিক সঙ্কেত এবং রাসায়নিক সঙ্কেত সঞ্চালিত হয়।

মাতৃগর্ভে ভ্রূণের আদি দশায় কোনো অঙ্গকে সুনির্দিষ্টভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হয় না। প্রায় ১০০ দিন অতিক্রম করার পর ভ্রূণের মস্তিষ্ক অংশ দৃশ্যমান হয়ে উঠে। এই সময় মস্তিষ্কের ওজন দাঁড়ায় ১ আউন্স। আর ২৭০ দিন পর যখন শিশুর মস্তিষ্কের ওজন দাঁড়ায় ১৪ আউন্স। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় ১২৬০ ঘন সেন্টিমিটার, আর নারীর মস্তিষ্কের আয়তন প্রায় ১১৩০ ঘন সেন্টিমিটার। আর ওজন হয় প্রায় ১.৩৬ কেজি।

মাতৃগর্ভে মস্তিষ্কের এই ব্যাপক বিকাশ ঘটলেও, জন্মের সময় মানব শিশুর মস্তিষ্ক অপেক্ষাকৃত অপূর্ণ দশায় থাকে। যদি কোনো কম্পিউটারের সাথে মস্তিষ্কের তুলনা করা যায়, তাহলে মানবশিশুর মস্তিষ্কের সাথে সদ্য তৈরি কম্পিউটারে সাথে তুলনা করা যেতে পারে। সদ্য তৈরিকৃত কম্পিউটারে হার্ডঅয়্যারের অংশ হিসেবে থাকে মাইক্রোপ্রসেসর, র্যাম, হার্ডডিস্ক, বিদ্যুসঞ্চালন ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর পাশাপাশি কম্পিউটারে থাকবে সফটঅয়্যার হিসেবে কেন্দ্রিয় পরিচালক পদ্ধতি। কম্পিউটারে ভাষায় একে বলা হয় অপারেটিং সিসটেম। মানবশিশুর মস্তিস্কের সকল জৈবিক অংশই হলো এর হার্ডঅয়্যার। আর এর ভিতরে থাকে থাকে একটি অপারেটিং সিসটেম। জন্মের পর থেকে মানব মস্তিষ্কের উভয় উপকরণে উন্নয়ন ঘটতে থাকে প্রয়োজনের সাথে সমন্বয় করে ধারাবাহিকভাবে।
প্রাথমিকভাবে মানব মস্তিষ্কের হার্ডঅয়্যার এবং সফটঅয়্যারের উন্নয়নের ধারাকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

মস্তিষ্কের এই সকল কার্যক্রমের ভিতরে মানবশিশুর কিছু সহজাত ক্ষমতা লক্ষ্য করা যায়। এর ভিতরে কিছু বিষয় থাকে যেগুলোর উপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকে না। মূলত মানবশিশুর বেঁচে থাকা এবং বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া সচল থাকে এই সহজাত ক্ষমতার গুণে।

১. স্বয়ংক্রিয় ক্ষমতা: হৃদপিণ্ডের গতি নিয়ন্ত্রণ, শরীরে ঘামের সৃষ্টি। এমনকি শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ হিসেবে মলমুদ্র ত্যাগ এ সবই সহজাত ক্ষমতায় হয়ে যায়। এর ভিতরে কিছু ঘটে স্বাভাবিক কার্যক্রম হিসেবে।

২. তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া: কখনো কখনো শিশু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখায়। যেমন- শিশুর চোখে তীব্র আলো ফেললে সে দ্রুত চোখ বন্ধ করে ফেলে। এই তাৎক্ষণিক সাড়া দেওয়ার ক্ষমতা অনুসারে শিশু চিকিৎসকরা শিশুর স্নায়ুর স্বাভাবিক কার্যক্রমের ক্ষমতা নির্ধারণ করে থাকেন। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শিশু অন্যের সাহায্যের অপেক্ষায় থাকে না। মস্তিষ্ক স্বয়ক্রিয়ভাবে তাৎক্ষিণিক সমাধান করে ফেলে।
৩. অসহায় প্রকাশ ক্ষমতা: এই ক্ষমতার দ্বারা শিশু নিজে কোনো উপায় বের করতে পারে না, কিন্তু অনুভূতিকে প্রকাশ করতে পারে নিজের মতো করে। যেমন- স্বস্তি বোধে সে হাসে এবং অস্বস্তিতে সে কাঁদে। শিশুর ক্ষুধাজনীত কারণে শরীরে যে অস্বস্তির সৃষ্টি হয়, তার প্রকাশ ঘটে তার কান্নায়। সদ্যজাত শিশু জানে না, তার অস্বস্থি দূর করার জন্য তাকে অন্য কেউ সাহায্য করবে কি না। কিন্তু জীবজগতের ক্রমবিকাশের ধারায় যখন হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভব হয়েছিল, তখন তার প্রতিটি সদস্যের সমগ্র জীবনাযপানের ধারায় কিছু সহজাত ক্ষমতার বিকাশ ঘটেছিল। সেই ধারাতে প্রোগ্রামে যুক্ত হয়ে গেছে, মানবজীবনের শৈশব-দশায় কাঁদলে তাকে কেউ সাহায্য করবে। তাই তার পাশে কেউ থাক না বা থাক, সহজাত প্রবৃত্তিতে সে কাঁদবে। সে জানে ক্ষুধা নিবৃত্তের জন্য খাদ্য মুখ দিয়ে গ্রহণ করতে হয়। তাই ক্ষুধা পেলে যা মুখে দেওয়া যায়, তাকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করার চেষ্টা করে। অখাদ্য হলে সে মুখ ফিরিয়ে নেয়। ক্ষুধার্ত শিশুরে মুখে মাতৃস্তন্য দিলে পরম আগ্রহে তা গ্রহণ করে। এই আগ্রহের জন্ম হয়েছে  ক্রমবিবর্তনের ধারায়। এই আগ্রহ সকল মানবশিশুর সহজাত ক্ষমতার অংশ হয়ে গেছে।

মস্তিষ্ক সুরক্ষিত থাকে অস্থিময় একটি আবরকের ভিতরে। একে সাধারণভাবে মাথার খুলি বা খুলি বলা হয়। খুলির পরেই রয়েছে ত্রিস্তর বিশিষ্ট একটি শক্ত আবরণ। এই অংশও মস্তিষ্কের সুরক্ষার কাজ করে। দ্বিস্তরী ফাইবারাস টিস্যুর সন্নিবেশে গঠিত প্রথম স্তরের নাম ডুরা ম্যাটার, অনেকটা ঢিলা থলের মত যার ভিতরে থাকে মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ড। এরপর রয়েছে সূক্ষ্ম সংযোজক কলার খুব পাতলা একটি স্তর। একে বলা হয় অ্যারাকনয়েড স্তর। এর পর থাকে পিয়া ম্যাটার নামে আরেকটি স্তর।

অ্যারাকনয়েড স্তর এবং পিয়া ম্যাটারের মধ্যে থাকে সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড
(CSF) নামের একটি বর্ণহীন তরল দ্রবণ। এই দ্রবণে থাকে সোডিয়াম ক্লোরাইড-সহ নানা ধরনের লবণ। খুলিতে আঘাত পেলে এই অংশ সেই আঘাতকে অনেকখানি কমিয়ে দিতে পারে। এমনকি মস্তিষ্কের খানিকটা প্রসারণের প্রয়োজন হলে মাথার খুলিতে চাপ না দিয়ে যাতে প্রসারণ সম্ভব হয় এই দ্রবণের দ্বারা।

পিয়া ম্যাটার এই অংশও এক ধরনের সংযোজক কলার দ্বারা সৃষ্ট। এই অংশ তুলনামুলকভাবে একটু শক্ত। এই অংশের পরেই রয়েছে মূল মস্তিষ্ক। এই অংশও বাইরের আঘাত থেকে রক্ষার জন্য কাজ করে।

উপর থেকে দেখা মস্তিষ্ক

মস্তিষ্কের বহির্দর্শন
মাথার খুলি খুলে ফেললে বাইরের থেকে মস্তিষ্ককে একটি প্যাঁচালো জমাটবদ্ধ অংশ দেখা যায়। এই অংশের সাধারণ নাম সেরেব্রাম। এটি মস্তিষ্কের সবচেয়ে বড় অংশ। মানুষের সকল ঐচ্ছিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করে এই অংশ। এই ঐচ্ছিক অংশের ভিতরে রয়েছে চিন্তা করা, উপলব্ধি করা, পরিকল্পনা করা এবং ভাষা বুঝতে পারা ইত্যাদি এই অংশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়।

সেরেব্রাম দুটি খণ্ডে বিভক্ত। পুরো সেরেব্রামকে একটি গোলক হিসেবে ধরে নিলে, বিভাজিত সেরেব্রামকে বলা যেতে পারে অর্ধগোলক। এই বাইরের পাতলা আবরণকে বলা হয় সেরেব্রাল কর্টেক্স। এই
স্নায়ু কোষের লম্বা এক্সন থাকে। এর রঙ সাদা। তাই সেরেব্রাল কর্টেক্সকে সাদা দেখায়। কিন্তু এর ভিতরের অংশের রঙ হয় ধূসর।

মাথার উপরের অংশকে যদি উন্মুক্ত করা যায়, তাহলে ভাঁজ খাওয়া নলাকার নরম অংশ চোখে পড়ে। এর মাঝখান দিয়ে একটি গভীর খাঁজ লক্ষ্য করা যায়। এই খাঁজকে বলে লঙ্গিচ্যুডিনাল ফিসার। মস্তিষ্কের ডান এবং বাম পাশের খণ্ডের মধ্যে খুব সামান্য পার্থক্য আছে। সেই কারণে একে প্রায় দ্বিপ্রতিসম বলা যেতে পারে। মধ্যবর্তী এই খাঁজের উভয় পার্শ্বের অংশকে, প্রাথমিকভাবে ডান এবং বাম মস্তিষ্ক নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়া উভয় অংশের মস্তিষ্কে মধ্যাঞ্চল জুড়ে আরও একটি ভাঁজ লক্ষ্য করা যায়। এই ভাঁজকে বলা হয় মধ্য সেন্ট্রাল সালকাস। এই ভাঁজের সম্মুখভাগকে বলা হয় অগ্র খণ্ড আর পিছনের অংশকে বলা হয় পশ্চাৎ খণ্ড। পশ্চাৎ খণ্ডের শেষে থাকে অক্সিপেটাল খণ্ড।

সামনে থেকে দেখা মস্তিষ্ক

উভয় অংশের ভিতরে একগুচ্ছ তন্তু বা সুতোর মত কাঠামোওয়ালা টিসু এই দুই অর্ধগোলকের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে, যার নাম করপাস ক্যালোসাম। এই অংশে মস্তিষ্কের অন্য অংশের তুলনায় স্নায়ূতন্তুর ঘনত্ব বেশি। এই অংশে প্রায় ২০ কোটি স্নায়ূতন্তু সন্নিবিষ্ট থাকে।

মস্তিষ্ককে সামনে থেকে দেখলে প্রথমে চোখে পড়ে গাঢ় এবং হালকা দুই ধরনের অংশ। এদের বলা হয় ধূসর পদার্থ এবং সাদা পদার্থ। ধূসর পদার্থে থাকে প্রধানত স্নায়ূকোষ এবং রক্তনালী। আর সাদা পদার্থে থাকে স্নায়ু কোষের লম্বা এক্সন। এই অংশে চর্বি জাতীয় পদার্থের আধিক্য আছে।

এছাড়াও পাখির ডানার মত বিস্তৃত ল্যাটারাল ভেন্ট্রিকল নামে গহবর দেখা যাচ্ছে যায়। উল্লেখ্য মস্তিষ্কে মোট চারটি ভেন্ট্রিকল আছে, রাইট ল্যাটারাল ভেন্ট্রিকল, লেফট ল্যাটারাল ভেন্ট্রিকল, থার্ড ভেন্ট্রিকল, ফোর্থ ভেন্ট্রিকল। মস্তিষ্কের পার্শ্বদেশীয় ক্রসসেকশনাল ভিউতে তৃতীয় এবং চতুর্থ ভেন্ট্রিকলের দেখা মেলে। এরা মস্তিষ্কের মধ্যরেখা বরাবর থাকে।

কার্যকারিতার ভিত্তিতে সেরেব্রালকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা হয়। এই ভাগগুলো হলো।