গুয়ুক খান
(১২০৬-১২৪৮ খ্রিষ্টাব্দ)
মঙ্গোল সাম্রাজ্যের তৃতীয় শাসক। পিতা
ওগেদাই খান ছিলেন
চেঙ্গিশ খানের
তৃতীয় পুত্র
তোলুই খানের পুত্র।
মায়ের নাম তুরেগেন। ১২০৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ আগষ্ট জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম জীবনে তিনি
চেঙ্গিশ খানননের
সাথে বিভিন্ন সামরিক অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। এরপর পিতা
ওগেদাই খানের
সাথে তিনি ১২৩৬-১২৪১ খ্রিষ্টাব্দে
রাশিয়া
ও মধ্য ইউরোপ অভিযানে অংশ নেন।
রাইয়াজান অবরোধে তার সেনাদল অংশ নিয়েছে। ওশেতিয়ার রাজধানী মাগাস অবরোধেও তার বাহিনী অংশ নেয়।
অভিযানকালে বিজয় উদযাপনের ভোজ অনুষ্ঠানে গুয়ুকের সাথে তাঁর চাচাত ভাইবাতু খানের ঝগড়া বাধে
। গুয়ুক এবং চাগাতাই খানের নাতি বুরি উভয়ে রাগান্বিত হয়ে ভোজ উৎসব থেকে বেরিয়ে যান। এই খবর
সম্রাটের কাছে পৌছানোর পর,তাঁদেরকে মঙ্গোলিয়ায় তলব করা হয়।
ওগেদাই
তাঁদের সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকার করেন এবং
তার ছেলে গুয়ুককে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেন। পরে তিনি শান্ত হয়ে গুয়ুককে ডেকে
এনে পরিবারের সদস্যদের সাথে কলহের কারণে তিরস্কার করেন। এরপর গুয়ুককে পুনরায়
ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
১২৪১ খ্রিষ্টাব্দে ওগেদাই মারা যান। তাঁর মা স্ত্রী তুরগেন রাজ্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি
নানা কৌশলে পুত্র গুয়ুককে ক্ষমতায় বসানোর পথ প্রশস্ত করেন। ১২৪৬
খ্রিষ্টাব্দে তুরগেন তার ছেলে গুয়ুক খানকে
খাগান বা সম্রাট হিসেবে নির্বাচন করাতে সক্ষম হন। এরপর
চেঙ্গিশ খানের
ছোট ভাই তেমুগে ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করলে গুয়ুক খান মঙ্গোলিয়া ফিরে এসে নিজ অবস্থান সংহত করেন।
১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ আগস্ট মোঙ্গল রাজধানী কারাকোরামে গুয়ুক খানের অভিষেক হয়।
এই অনুষ্ঠানে অনেক দেশী-বিদেশী অতিথি, রাজদূত উপস্থিত ছিলেন। এ এঁদের মধ্যে
ছিলেন পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টের দূত জিওভান্নি দা পিয়ান, গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয়
ইয়ারোস্লাভ, আর্মেনিয়ার রাজার ভাই, চতুর্থ কিলিজ আরসালান, আব্বাসীয় খলিফা
আল-মুসতাসিমের দূত ও দিল্লির সুলতান আলাউদ্দিন মাসুদের দূত।
পোপের প্রতিনিধি ক্যাথলিক রাজ্যসমূহে মোঙ্গল হামলার প্রতিবাদ করার পর গুয়ুক
জানান যে তারা চেঙ্গিস খান ও ওগেদাই খানের যুগে মোঙ্গল প্রতিনিধিদের হত্যা করেছিল।
গির্জা ও মঙ্গোলদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি পোপকে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, "আপনাকে অবশ্যই স্বচ্ছ মন নিয়ে বলতে হবে: 'আমরা আপনার প্রজা হব; আমরা আপনাকে আমাদের সামর্থ্য প্রদান করব'। দায়িত্বপালন এবং আনুগত্য স্বীকারের জন্য আপনাকে অবশ্যই আপনাদের সব রাজাকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে হবে। শুধুমাত্র তখনই আমরা আপনার আত্মসমর্পণ মেনে নেব। এবং যদি আপনি ঈশ্বরের আদেশ মেনে না নেন এবং আমাদের নির্দেশের বাইরে যান আমরা আপনাকে আমাদের শত্রু হিসেবে ধরে নেব।"
পূর্বে তুরগেন কর্তৃক নিযুক্ত প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আরগুন আঁকা ছাড়া বাকিদের অব্যাহতি দেয়া হয়।
তিনি চাগাতাই খানাতের কারা হালাকুর বদলে ইয়েসু মংকেকে ক্ষমতায় বসান।
এছাড়াও তিনি তার বাবার কর্মকর্তা মাহমুদ ইয়ালাভাচ, মাসুদ বেগ এবং চিনকাইওকে প্রদেশের পদে পুনর্বহাল করেন।
ক্ষমতায় বসার পর গুয়ুক তার মায়ের বেশ কিছু অজনপ্রিয় ফরমান বাতিল করে দিয়েছিলেন।
এছাড়া চীনের সুং রাজবংশের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেয়া হয়। সেলজুক শাহজাদাদের মধ্যে ক্ষমতা
নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এসময় গুয়ুকের নির্দেশে রুকনউদ্দিন মসনদে বসেন।
এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ২,০০০ মঙ্গোল সৈনিক প্রেরণ করা হয়।
গুয়ুক জর্জিয়াকে দুইভাগে বিভক্ত করে ডেভিড উলুকে ক্ষমতায় বসান।
বাতু খান গুয়ুকের নেতা নির্বাচিত হওয়াকে সমর্থন না করলেও তাকে
অন্য সবাই মেনে নিয়েছিলেন।
১২৪৩ খ্রিষ্টাব্দের সিলিসিয়ান আর্মেনিয়ার রাজা প্রথম হেতুয়াম মঙ্গোলদের সাথে সন্ধি করে তার ভাইকে
মোঙ্গল দরবারে প্রেরণ করেন।
১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দে তার ফরমান অনুসারে বিভিন্ন বস্তুর উপর
১/৩০-১/১০ অংশ কর আরোপ করা হয়। জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার পুরুষদের উপর মাথাপিছু ৬০
সিলভার ড্রাম কর ধার্য করা হয়।
১২৪৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভ্লাদিমিরের আন্দ্রেই এবং
আলেক্সান্ডার নেভস্কিকে তাদের বাবার মৃত্যুর পর
কারাকোরামে প্রেরণ করেন। গুয়ুক খান আন্দ্রেইওকে
ভ্লাদিমির-সুজদাইয়ের এবং আলেক্সান্ডারকে কিয়েভের শাসক নিযুক্ত করেন।
১২৪৭ খ্রিষ্টাব্দে একটি চুক্তি অনুসারে সিলিসিয়ান
আর্মেনিয়া মোঙ্গল সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত হয়।
এই বছরেই মোঙ্গলরা ইওম-জুর কাছে শিবির স্থাপন করে। রাজা
গোজং তার রাজধানী কাংওয়া থেকে কাইসঙে স্থানান্তর করতে রাজি না হওয়ায়,
গুয়ুক কোরিয়া উপদ্বীপের অভিযান পরিচালনা করেন। উল্লেখ্য ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত
এই অভিযান অব্যাহত ছিল।
গুয়ুজ খান আব্বাসীয় ও ইসমাইলিদের পূর্ণ আত্মসমর্পণ দাবি করেছিলেন।
তার শাসনামলে উইঘুরদের এলাকা বৃদ্ধি পায়। তিনি
আমুকানকে কোরিয়ায় প্রেরণ করেন। তিনি সাম্রাজ্যব্যপী আদমশুমারির নির্দেশ
দিয়েছিলেন।
১২৪৮ খ্রিষ্টাব্দে গুয়ুক তার
সাথে সাক্ষাতের জন্য বাতু খানকে মঙ্গোলিয়ায় আসার নির্দেশ দেন। অনেকের কাছে একে
বাতুকে গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছিল। নির্দেশ পাওয়ার পর বাতু খান একটি বড়
আকারের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। গুয়ুকও পশ্চিমে যাত্রা করেন।
কিন্তু পথিমধ্যে গুয়ুক বর্তমান শিনজিয়াঙে মারা যান। তাকে বিষপ্রয়োগ করে
হত্যা করা হয়েছে এমন মত রয়েছে। তবে কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে তিনি
স্বাস্থ্যগত কারণে স্বাভাবিকভাবে মারা যান।
গুয়ুকের মৃত্যুর পর, তাঁর স্ত্রী ওগুল কাইমিশ রাজপ্রতিভূ হিসেবে ক্ষমতা নিলেও
গুয়ুক খানের সন্তানরা ক্ষমতাসীন হননি।
১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে
মঙ্গ্কে খান
তাঁর উত্তরসূরি হন।