ওগেদাই খান
(১১৮৬-১২৪১ খ্রিষ্টাব্দ)
মঙ্গোলীয় শাসক। তোলুই খান ছিলেন
চেঙ্গিশ খানের তৃতীয় পুত্র। ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে
চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর, নির্বাচনের মাধ্যমে মঙ্গোলিয়ার সিংহাসন লাভ করেন।
যদিও চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর তত্ত্বাবধায়ক শাসক হিসেবে
চেঙ্গিশ খানের চতুর্থ পুত্র
তোলুই খান মনোনীত
হয়েছিলেন। কিন্তু ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সম্রাট নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়ে
মোঙ্গল সিংহাসনে বসেন। এই বিচারে চেঙ্গিশ-রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে ওগেদাই
খানকে বিবেচনা করা হয়।
১১৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৭ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। মায়ের নাম বোরতে উজিন। শৈশব থেকে
চেঙ্গিশ খানের অন্যান্য সন্তানদের মতই তিনিও সামরিক শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং যৌবনে
পিতার সাথে এবং এককভাবে বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।
১২০৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে (চেঙ্গিশ খানের উত্থানের সময়), জামুখার নামক এক বাহিনীর
সাথে
চেঙ্গিশ খানের যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে
চেঙ্গিশ খান পরাজিত হন। যুদ্ধক্ষেত্রে ওগেদাই আহতাবস্থায় নিখোজ হন।
পরে তাঁকে উদ্ধার করা হয়।
১২১১ সালের নভেম্বরে ওগেদাই তার ভাইদের সাথে প্রথমবার জিন রাজবংশের বিরুদ্ধে
অভিযানে স্বাধীনভাবে অংশ নিয়েছেন। তাকে দক্ষিণে ও পরে উত্তরে প্রেরণ করা হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ১২১৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে অনুষ্ঠিত লড়াইয়ে
চেঙ্গিশ খান বাহিনী চীন রাষ্ট্রের সৈন্যদের কাছ থেকে তিন
হাজার ঘোড়া ও অজস্র মূল্যবান জিনিস ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর, চীনের
রাজা জুনডু থেকে পালিয়ে বিনলিয়েন নামক একটি জায়গায় চলে যান।
১২১৯ খ্রিষ্টাব্দে
চেঙ্গিশ খান প্রায় দুই লক্ষ সৈন্য নিয়ে পারশ্য এবং মধ্য এশিয়া অভিযান চালান এবং
প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি জয়ী হন। এই যুদ্ধে তিনি ওগেদাই এবং তাঁর অপর ভাই চাগাতাই
পূর্ব পারশ্যের ওতরার নগরী পাঁচ মাস অবরোধ করে রাখেন এবং পরে এই নগরী অধিকার করে
নগরীর সকলা বাসিন্দাদের হত্যা করেন। পরে তিনি তাঁর অপর ভাই উরগঞ্জে জোচির সাথে যোগ দেন। সামরিক
কৌশল নিয়ে জোচির সাথে চাগাতাইয়ের বনিবনা না হওয়ায়, চেঙ্গিস খান উভয় ভাইকে বাদ
দিয়ে উরগঞ্জ অবরোধের
জন্য ওগেদাইকে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ১২২১ খ্রিষ্টাব্দে এই শহরটি দখলে আসে। এই সময়ে
দক্ষিণপূর্ব পারস্য ও আফগানিস্তানে বিদ্রোহ দেখা দিলে, বিদ্রোহ দমনে
চেঙ্গিশ খান ওগেদাইকে পাঠান। ওদেগাই কঠোর হস্তে গজনির বিদ্রোহ দমন করেন।
১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে
চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর, নির্বাচনের মাধ্যমে মোঙ্গলিয়ার সিংহাসন লাভ করেন।
যদিও চেঙ্গিশ খানের মৃত্যুর পর তত্ত্বাবধায়ক শাসক হিসেবে
চেঙ্গিশ খানের চতুর্থ পুত্র
তোলুই খান মনোনীত
হয়েছিলেন। কিন্তু ১২২৯ খ্রিষ্টাব্দে অনুষ্ঠিত সম্রাট নির্বাচনে তিনি জয়ী হয়ে
মোঙ্গল সিংহাসনে বসেন। এই বিচারে চেঙ্গিশ-রাজবংশের দ্বিতীয় সম্রাট হিসেবে ওগেদাই
খানকে বিবেচনা করা হয়।
তৎকালীন পারশ্যের খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের শেষ শাসক জালালউদ্দিন খোয়ারিজম শাহ
১২২৬ খ্রিষ্টাব্দে সাম্রাজ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালান। ১২২৭ খ্রিষ্টাব্দে বাহিনী
খোয়ারিজম শাহকে
পরাজিত করেন।
ওগেদাইয়ের নির্দেশে চোরমাকান ৩০,০০০ থেকে ৫০,০০০ সৈনিক নিয়ে পারস্য ও
খোরাসান দখল করে নেন।
১২৩০ খ্রিষ্টাব্দে মোঙ্গল বাহিনী
আমুদরিয়া অতিক্রম করে এবং খোরাসান দখল
করে। এরপর পশ্চিম আফগানিস্তানে হামলার জন্য তাঁর বাহিনী একটি অংশ চোরমাকানের
নেতৃত্বে রেখে, মূল বাহিনী নিয়ে পারস্যের উত্তর দিক দিয়ে
অগ্রসর হন। চোরমাকান তাঁর বাহিনী নিয়ে উত্তর পারস্যের
বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালান।
১২৩০ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ওগেদাই চীনের শানশি প্রদেশের দিকে অগ্রসর হন। তিনি
জিন বাহিনীকে পরাজিত করে ফেংশিয়াং শহর দখল করেন।
১২৩১-৩২ খ্রিষ্টাব্দের ওগেদাইয়ের বাহিনী জিনদের অধিকাংশ প্রতিরক্ষা ভেদ করেন।
কিন্তু হঠাৎ ওগেদাই অসুস্থ হয়ে পড়লে, মোঙ্গলীয় বাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। চিকিৎসকরা
কোনো ভাবে ওগেইদাকে সুস্থ করতে না পেরে ওঝা'র শরণাপন্ন হন। ওঝারা জানান যে, চীনের
মাটি ও পানির প্রেতাত্মার কারণে ওগেদাই অসুস্থ হয়েছেন। পরিবারের কেউ নিজেকে উৎসর্গ
করলে ওগেইদা সুস্থ হয়ে উঠবেন। এই সময় ওগেইদার চতুর্থ ভাই
তোলুই খান
বিষাক্ত পানীয় পান করে নিজেকে উৎসর্গ করেন এবং ওগেদাই সুস্থ হন। অনেকর মতে
অত্যধিক মদ্যপানের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল।
১২৩২ খ্রিষ্টাব্দে জিন সম্রাট তার রাজধানী কাইফেঙে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েন। এরপর ওগেদাই
তার সেনাপতিদেরকে দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যান। ১২৩৪ খ্রিষ্টাব্দে জিনরা
পরাজিত হয়।
১২৩২ সালে চোরমাকানের নেতৃত্বাধীন মোঙ্গলরা ককেসাস ফিরে আসে। ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে
মোঙ্গলবাহিনী ইরবিল অবরোধ করেন। এই নগরীর বাসিন্দারা মোঙ্গলদেরকে
বার্ষিক কর দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়ার পর, মোঙ্গলরা এখান থেকে ফিরে যায়। এরপর চোরমাকান তিফলিস দখল করেন। ১২৪০
খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে চোরমাকান ট্রান্সককেসিয়া বিজয়
সম্পন্ন করেন। এরপর জর্জিয়া আত্মসমর্পণ করেছিল।
১২২৪ খ্রিষ্টাব্দে চেঙ্গিশ খানের আমলে কোরিয়া কর প্রদান বন্ধ করে দেয় এবং এক
মঙ্গোল দূত নিহত হয়। এরপর দীর্ঘদিন, চীন ও মঙ্গোলিয়া নিয়ে মোঙ্গলরা ব্যস্ত থাকায়,
কোরিয়ার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করে নি। ১২৩১ খ্রিষ্টাব্দে ওগেদাই কোরিয়া
অভিযানে সারিতাইকে প্রেরণ করেন। এরপর কোরিয়ার রাজা সাময়িকভাবে আত্মসমর্পণ করেলেও পরে
এরা শর্ত ভঙ্গ করে। এরপর ওগেদাই কোরিয়া,
দক্ষিণ সুং ও কিপচাকদের বিরুদ্ধে অভিযানের পরিকল্পনা করেছিলেন। ১২৩৮ খ্রিষ্টাব্দে
কোরিয়া শান্তি প্রস্তাব দেয়া হয়। ওগেদাই রাজাকে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হওয়ার শর্ত দেন।
শেষপর্যন্ত কোরিয়ার রাজা জিম্মি হিসেবে কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যাক্তিকে মোঙ্গলিয়ায়
প্রেরণ করেন।
এরপর ওগেদাই ইউরোপ অভিযানে
বাতু খানের নেতৃত্বে একটি বিশাল বাহিনী পাঠান। বাতু খান প্রায় সমগ্র রাশিয়া, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, সার্বিয়া ও বুলগেরিয়া
দখল করেন।
১২৩৫ থেকে ১২৪৫ সালের মধ্যে মোঙ্গলরা সুংদের এলাকার অনেক ভেতরে প্রবেশ করে। কিন্তু
আবহাওয়া ও সুংদের সৈন্যসংখ্যাধিক্যের কারণে তারা পুরোপুরি সফল হয়নি। ওগেদাইয়ের
ছেলে খোচু অভিযানকালে মারা যান। ১২৪০ খ্রিষ্টাব্দে ওগেদাইয়ের আরেক ছেলে খুদান তিব্বত
অভিযান চালিয়েছিলেন।
১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মোঙ্গল বাহিনী কাশ্মিরে হামলা করে। পরবর্তীতে কাশ্মির
মোঙ্গলদের অধীনস্ত রাজ্যে পরিণত হয়েছিল। ১২৩৫-৩৮ খ্রিষ্টাব্দে ওগেদাই খান
মোঙ্গলিয়ায় যাযাবরদের যাত্রাপথের বিভিন্ন অবতরণস্থলে প্রাসাদ ও স্থাপনা নির্মাণ
করেছেন। ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে কারাকোরাম শহর নির্মাণ সম্পন্ন হয়।
শহরের চারদিক দেয়াল দ্বারা ঘেরা ছিল। এখানে একটি দুর্গও অবস্থিত ছিল।
১২৪১ খ্রিষ্টাব্দের শীতকালে মোঙ্গলরা ভারতে সিন্ধু অববাহিকায় হামলা করে। অভিযানের
সময় তারা লাহোর অবরোধ করেছিল। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনের পূর্বে মঙ্গোলরা এখানে
ব্যাপক হত্যাকাণ্ড চালায়।
১২৪১ খ্রিষ্টাব্দে ওগেদাই খান মঙ্গোলিয়ায় মৃত্যুবরণ করেন।
১২৪৬ খ্রিষ্টাব্দ তার ছেলে গুয়ুক খান
পরবর্তী সম্রাট হন।