আব্বাসউদ্দীন আহমদ
১৯০১- ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ
সঙ্গীতশিল্পী সঙ্গীত পরিচালক, সুরকার।
১৯০১ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে অক্টোবর,
ভারতের
পশ্চিমবঙ্গের
কুচবিহার জেলার তুফানগঞ্জ মহকুমার বলরামপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
পিতা জাফর আলী আহমদ ছিলেন তুফানগঞ্জ মহকুমা আদালতের উকিল। মাতা হিরামন নেসা ছিলেন
গৃহবধূ। শৈশবের নাম শ্রী সেখ আব্বাসউদ্দীন আহমদ। ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের দিকে কুচ
বিহারের মুলসমানদের এক আন্দোলনের সূত্রে সেখ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়েছিল। কারণ সেখ
শব্দট সে সময়ে শিয়া মুসলমানরা ব্যবহার করতো।
শৈশবে বলরামপুরের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আব্বাসউদ্দীনের শিক্ষা জীবন শুরু হয়। শৈশবে
তাঁর গানের প্রতি অনুরাগ জন্মেছিল স্থানীয় সিয়াদের মর্সিয়া গানের মধ্য দিয়ে। এছাড়া
গানের প্রতি প্রবল অনুরাগে ভাওয়াইয়া ও যাত্রা পালার গান তিনি শুনে শুনে শিখেছিলেন।
কুচবিহারের প্রাথমিক বিদ্যালয় পাশ করার পর তিনি ট্রান্সফার সার্টিফিকেট নিয়ে
তুফানগঞ্জ স্কুলে ভর্তি হন। এখানে তিনি সরকারি ডাক্তার মোবারক হোসেনের কাছে
রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনার সৌভাগ্য লাভ করেন। তিনি গানের টানে প্রতিদিন তাঁর কাছে যেতেন।
এখানে মোবারক হোসেনের কাছ থেকে তাঁর পছন্দের কিছু গান শেখেন। ফিফথ ক্লাসে তিনি প্রথম স্থান
অধিকার করেছিলেন। স্কুলের বার্ষিক বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে, স্কুল কমিটির
সদস্য হিসেবে মোবারক হোসেন তাৎক্ষণিকভাবে একটি গানের প্রতিযোগিতার প্রস্তাব করেন।
এই প্রতিযোগিতায় আব্বাসউদ্দীন গান গেয়ে দশ টাকা মূল্যের একগাদা বই উপহার পান। এই
অনুষ্ঠানে তিনি গেয়েছিলেন রবীন্দ্রসঙ্গীত 'অমল ধবল পালে লেগেছে'। তাঁর গাওয়া অপর গানটি ছিল 'সভা যখন ভাঙবে তখন শেষের গানটি যাব
গেয়ে'।
আব্বাসউদীন স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে ভালো ফলাফল করার সূত্রে বহুবার পুরস্কৃত হয়েছেন
এবং নানা গানের অনুষ্ঠানে তিনি গান গেয়ে প্রসংশিত হয়েছেন। সব মিলিয়ে স্কুল জীবনেই
তুফানগঞ্জে তিনি সর্ব-পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। এই সময় তুফানগঞ্জে প্রতি বৎসর দোলের মেলা
হতো। এসব মেলায় যাত্রাগানের দল আসতো। এই যাত্রাপালার সূত্রে তাঁর মুকুন্দদাসের গান
শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তুফানগঞ্জ স্কুল থেকে তিনি প্রবেশিকা করে কুচবিহার কলেজ ভর্তি হন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। এই সময় আব্বাসউদ্দীন খেয়ালের
বশে কুচবিহারে পুলিশ সাব-ইন্সপেক্টর পদের জন্য আবেদন করেন। পরীক্ষায় পাশ করে তিনি
নিয়োগপত্র পান। কিন্তু কুচবিহারের দারোগা রাধাশ্যাম চক্রবর্তী এই নিয়গে বাধা দেন।
উল্লেখ্য, তুফানগঞ্জে থাকার সময় এই দারোগা এবং তাঁর পরিবারের সকলের সাথে প্রগাঢ়
সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। রাধাশ্যাম চক্রবর্তী আব্বাসউদ্দীনকে পুত্রের মতো স্নেহ করতেন।
পুলিশের চাকরি করে আব্বাসউদ্দীন ভবিষ্যত জীবন নষ্ট করুক. সেটা তিনি চান নি। ফলে
আব্বাসউদ্দীন শেষ পর্যন্ত এই চাকরিতে যোগদান করেন নি।
আইএ পাশ করার পর, তিনি লক্ষ্ণৌ মরিস মিউজিক কলেজে ভর্তি হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু
পারিবারিক আপত্তিতে এই ইচ্ছা পূরণ হয় নি। এরপর তিনি বিএ পড়ার জন্য রংপুর আসেন।
রংপুর কলেজে ভর্তি হওয়ার আয়োজনও করেছিলেন, কিন্তু সেখানকার মশার উপদ্রবে তিনি এই
ইচ্ছা ত্যাগ করে রাজশাহী কলেজে ভর্তি হন। এই কলেজে পড়ার সময় প্রফুল্ল রায় রাজশাহীতে
এলে, তাঁর জনসভায় তিনি পরিবেশন করেছিলেন নজরুলের রচিত চরকার গান- 'ঘোর ঘোর রে আমার
সাধের চড়কা'। এই কলেজ থেকে তিনি বি.এ পরীক্ষা দেন।
কিন্ত পাস করতে না পেরে তিনি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাঠ ছেড়ে দেন।
কলকতায় আসার পর ওস্তাদ জমিরউদ্দীন খাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন।
এছাড়া
নজরুল ইসলামের
কাছে গানের তালিম নিয়েছেন।
নজরুলের রচিত ইসলামী গান গেয়ে খ্যাতি লাভ করেছিলেন।
নজরুলের সহায়তায় তিনি কলকাতায় এসে গ্রামোফোন রেকর্ডে গান রেকর্ড করার সুযোগ
পান। খ্যাতি লাভের পর তিনি জসিম উদ্দিন এবং গোলাম মোস্তাফার লেখা ইসলামী গানও রেকর্ডে গেয়েছিলেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয়। এই রেকর্ডের গানগুলোর রচয়িতা ছিলেন
শৈলেন রায়। গান দুটি ছিল- 'স্মরণ পারের ওগো প্রিয়' এবং 'কোন বিরহীর নয়নজলে বাদল ঝরে
গো।'
সম্ভবত এই সময়ে তিনি রাইটার্স বিল্ডিংয়ে ডিপিআই অফিসে অস্থায়ী পদে একটি চাকরি পান। সেই সুবাদে ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কলকাতায় বসবাস করা শুরু করেন। পরে
কিছুদিন কৃষি দপ্তরে স্থায়ী পদে কেরানির চাকরি করেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিষ্ণুমায়া ছায়াছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মহানিশা ছায়াছবিতে অভিনয় করেন।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে
আবুল কাশেম ফজলুল হক
মন্ত্রীত্বের সময় তিনি রেকর্ডিং এক্সপার্ট হিসেবে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করেন।
চল্লিশের দশকে আব্বাস উদ্দিনের গান পাকিস্তান আন্দোলনের পক্ষে মুসলিম জনতার সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তিপ্রাপ্ত ঠিকাদার ছবিতে কুলির ভূমিকায় অভিনয় করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশ বিভাগের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং সরকারের প্রচার দপ্তরে এডিশনাল সং অর্গানাইজার হিসেবে চাকরি করেন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে ম্যানিলায় দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সঙ্গীত সম্মেলন
যোগদান করেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জার্মানিতে আন্তর্জাতিক লোকসংগীত সম্মেলনে যোগদান করেন।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে রেঙ্গুনে প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তিনি যোগদান করেন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন।
সম্মাননা
- ১৯৬০ প্রাইড অফ পারফরম্যান্স
পুরস্কার
- ১৯৭৯ শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার
- ১৯৮১ স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার শিল্পকলা
পুরস্কার (মরণোত্তর)
- ২০১৩ আরটিভি স্টার অ্যাওয়ার্ডস
(পরম্পরা পরিবার পদক, মরণোত্তর)
রেকর্ডে গীত
আব্বাসউদ্দীন আহমদের গানের তালিকা
সূত্র:
- আমার শিল্পী জীবনের কথা। আব্বাসউদ্দীন আহমদ। পরিবেশনা: হরফ প্রকাশনী,
কলিকাতা