'এ বিশ্বনিখিলের সকল শুভ কাজে যাঁর প্রসন্নকল্যাণ আঁখি অনিমিখ হয়ে জেগে রয়েছে...তাঁর ঐ মহাকাশের মহাসিংহাসনের নীচে আমার মাথা নত করে আমি আপনাদের জানাচ্ছি যে আমার পরম আদরের কল্যাণীয়া ভাগ্নী নার্গিস আরা খানমের বিয়ে বর্ধমান জেলার ইতিহাস-প্রখ্যাত চুরুলিয়া গ্রামের দেশবিখ্যাত পরমপুরুষ, আভিজাত্যগৌরবে গৌরাবান্বিত, আয়মাদার, মরহুম মৌলবী কাজী ফকির আহমদ সাহেবের দেশবিশ্রুত পুত্র মুসলিম কুলগৌরব মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি, দৈনিক নবযুগের ভূতপূর্ব সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলামের সাথে। বাণীর দুলাল দামাল ছেলে, বাংলার এই তরুণ সৈনিক কবি ও প্রতিভান্বিত লেখকের নতুন করে নাম বা পরিচয় দেবার দরকার নেই। এই আনন্দঘন চিরশিশুকে যে দেশের সকল লেখকলেখিকা, সকল কবি-যুবকরা ভালোবাস দিয়েছিলেন সেই বাঁধনহারা যে দেশমাতার একেবারে বুকের কাছটিতে প্রাণের মাঝে নিজের আসনখানি পেতে চলেছে, এর চেয়ে বড়ো পরিচয় তার আর নেই।
আপনারা আমার বন্ধু, বড়ো আপনার জন। আমার এ গৌরব, আমার এ সম্পদের দিনে আপনারা এসে আনন্দ করে আমার এ কুটিরখানিকে পূর্ণ আনন্দ দিয়ে ভরাট করে তুলুন, তাই এ আমন্ত্রণ।...বিয়ের দিন আগামী ৩রা আষাঢ় শুক্রবার নিশীথ রাতে...আরজ
বিনীত আলী আকবর খান
এই চিঠি আলী আকবর খানের নামে লিখিত হলেও, মুজফ্ফর আহমেদ ধারণা চিঠিটি খসড়া তৈরি
করে দিয়েছিলেন নজরুল নিজেই। মুজফ্ফর আহমেদ এই নিমন্ত্রণ পত্র পেয়েছিলেন নজরুলের
আক্দের অনুষ্ঠান হয়ে যাওয়ার পর। তিনি এই চিঠি পড়ে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন সম্ভবত '
মুসলিম বঙ্গের 'রবি' কবি' দেখে। মুজফ্ফর আহমেদ এই দাবিকে অহঙ্কারের প্রকাশ হিসেবে
বিবেচনা করেছিলেন। এ বিষয়ে পরে (২৬ জুন) মুজফ্ফর আহমেদ নজরুলকে একটি পত্র
পাঠিয়েছিলেন। অবশ্য পত্রিকান্তরে, নজররুল- আলী আকবর খানের নিমন্ত্রণ পত্রের ক্ষুব্ধ
প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। নজরুলের এই প্রতিক্রিয়াটি ছাপা হয়েছিল- সাপ্তাহিক
বিজলী পত্রিকার ২২শে জুলাই সংখ্যায়।
[সূত্র:
১২ আষাঢ় (২৬ জুন ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দ)নজরুলকে লেখা মোজাফ্ফর আহমেদের চিঠি। কবি
পরিচিতি। আব্দুল কাদির।]
যথারীতি
১৭ই জুন ১৯২১ (শুক্রবার
৩রা আষাঢ় ১৩২৮) কুমিল্লার
দৌলতপুরে,
নজরুলের সাথে
নার্গিসের আক্দ আসর
বসে দৌলতপুরস্থ
আলী আকবর খানের বাসায়। এই অনুষ্ঠানে আলী আকবর খান কুমিল্লা থেকে
সপরিবারে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তকে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। বিবাহ অনুষ্ঠানে ইন্দ্রকুমারের পরিবারের প্রায় সকলেই দৌলতপুরে
গিয়েছিলেন। মুজাফ্ফর আহমদের 'কাজী নজরুল ইস্লাম স্মৃতিকথা' গ্রন্থে ইন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের সাথে আর যাঁরা দৌলতপুর গিয়েছিলেন তাঁর একটি তালিকা পাওয়া যায়। এঁরা
ছিলেন- ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্ত, বিরজাসুন্দরী দেবী (ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের স্ত্রী),
বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ছেলে, বীরেন্দ্রকুমারের স্ত্রী, বীরেন্দ্রকুমার
সেনগুপ্তের শিশুপুত্র প্রবীরকুমার সেনগুপ্ত, গিরিবালা দেবী (বীরেন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বিধবা জ্যেঠী মা),
কুমারী প্রমীলা সেনগুপ্তা (গিরিবালা দেবীর ১৩ বছরের কন্যা), কুমারী কমলা সেনগুপ্তা
(ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের ১২ বছরের মেয়ে), অঞ্জলি সেনগুপ্তা ওর্ফে জটু (ইন্দ্রকুমারের
৬ বছরের শিশুকন্যা) ও সন্তোষকুমার সেন (জ্ঞাতি কিশোর)। এ ছাড়া এই বিবাহে উপস্থিত
ছিলেন- দৌলতপুরের পার্শ্বস্থ বাঙ্গোরার জমিদার রায় বাহাদুর রূপেন্দ্র লোচন মজুমদার
এবং বাঙ্গোরা হাই স্কুলের হেড মাস্টার বাবু মোহন মজুমদার।
আক্দের আসরে প্রথম তর্ক শুরু হয় কাবিনের শর্ত নিয়ে। এছাড়া কন্যাপক্ষ
থেকে দাবি করা হয় যে, বিবাহের পর নজরুলকে ঘর-জামাই হয়ে থাকতে হবে।
এই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক উপস্থিত হলে, নজরুল বিবাহ-আসর থেকে
উঠে আসেন। অনেকে মনে করেন যে, আকদ সম্পন্ন হওয়ার আগেই নজরুল বিবাহের আসর ত্যাগ করেছিলেন।
এই কারণে সন্দেহ হয়, আদৌও নজরুলের সাথে নার্গিসের আনুষ্ঠানিক বিবাহ হয়েছিল কিনা।
বিয়ের আসর ত্যাগ করে, নজরুল প্রায় ১১ মাইল কাদা-বিছানো পথে হেঁটে
১৮ই জুন (শনিবার,
৪ঠা আষাঢ়) সকাল বেলায় কুমিল্লার কান্দিরপাড়ের ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের বাসায় উঠেছিলেন।
এই বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পর, নজরুল
আলী আকবর খানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। এই চিঠির ভাষা
এবং তারিখ নিয়ে
মুজাফ্ফর আহমেদ
সংশয় প্রকাশ করেছেন, তাঁর 'কাজী নজরুল স্মৃতিকথা' গ্রন্থে। এই চিঠিতে তারিখ ও
স্থানের উল্লেখ ছিল 'কান্দিরপাড়, কুমিল্লা
23rd July, 1921
(বিকেল বেলা)'। বাস্তবে এই সময়
মুজাফ্ফর
আহমদছিলেন কলকাতায়। সম্ভবত এই চিঠিটি লেখা হয়েছিল
২৩শে জুন। [চিঠি:
২৩ জুলাই আলী আকবর খানকে লেখা নজরুলের চিঠি]
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে
(ভাদ্র- আশ্বিন ১৩২৮) নজরুল এবং
মুজাফ্ফর আহমদ
থাকতেন ৩/৪-সি, তালতলা লেনে-
আলী আকবর খান নজরুলের সাথে দেখা করার জন্য আসেন। তিনি
এসেছিলেন নজরুলকে অর্থের দ্বারা বশ করে, নার্গিসের সাথে বিবাহটা বজায় রাখার
জন্য।
আলী আকবর
টাকার তোড়া বের করে
নজরুলকে
দেখিয়ে দেখিয়ে কথা বলেছিলেন।
নজরুলকে কোনোভাবেই বশ করতে না পেরে তিনি ফিরে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার পুরো
সময়
মুজাফ্ফর আহমদের
নীরব দর্শক হয়ে বসেছিলেন। পরের দিন, নজরুল বিরজাসুন্দরী দেবীকে লিখেছিলেন- 'মা, আলী
আকবর খান আমাকে নোটের তাড়া দেখিয়ে গেল'।
এরপর
নজরুলের
সাথে চিরকালের জন্য আলী আকবরের বিচ্ছেদ ঘটেছিল।
আলী আকবরের পরবর্তী জীবনবৃত্তান্ত সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু জানা
যায় না।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দের ১২ ডিসেম্বর আলী আকবর খান তাঁর বই
ব্যবসার ম্যানেজার আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে দিয়েছিলেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দেমৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয়েছে দৌলতপুরে।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ:
সূত্র: