আর্যভট্ট
আনুমানিক ৪৭৬-৫৫০ খ্রিষ্টাব্দ।
প্রাচীন ভারতীয় গণিতবিদ, পদার্থবিদ এবং জ্যোতির্বিদ

আর্যভট্টের রচনার অন্যতম ভাষ্যকার প্রথম ভাস্করের ভাষ্য অনুযায়ী তার জন্ম হয়েছিল অশ্মকা নামের একটি স্থানে। প্রাচীন বৌদ্ধ এবং হিন্দু গ্রন্থাদির বিবরণ অনুসারে অনুমান করা হয়- অশ্মকা  ছিল নর্মদা এবং গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী স্থানে। স্থানটিকে বর্তমানে দক্ষিণ গুজরাত এবং উত্তর মহারাষ্ট্রের আশেপাশের একটি জায়গা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

ভাষ্যকার প্রথম ভাস্করের মতে তিনি পাটালিপুত্র নগরীতে উচ্চাশিক্ষার জন্য গিয়েছিলেন। স্থানাটিকে কুসুমপুরা নামে অভিহিত করা হয়। তিনি কুসুমপুরে আর্যভ নামে খ্যাত ছিলেন। তিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষাশেষে তিনি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন। কেউ কেউ বলেছেন, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান হিসেবেও আর্যভট্ট দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

আর্যভট্টের রচনা
তাঁর অধিকাংশ রচনাই হারিয়ে গিয়েছে। একমাত্র তাঁর রচিত 'আর্যভট্টীয়' গ্রন্থটি যেটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। মাত্র ২৩ বৎসর বয়সে তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেছিলেন। এতে মোট ১১৮টি স্তোত্র রয়েছে।

গ্রন্থটি চারটি অধ্যায়‌ দশগীতিকা, গণিতপাদ, কালক্রিয়াপদ ও গোলপাদ নামে অভিহিত করা হয়েছে। এর  দশগীতিকা, কালক্রিয়া ও গোলপাদ অধ্যায়ে গোলীয় ত্রিকোণমিতি ও জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত বিষয়াবলী রয়েছে। অন্যদিকে গণিত পাদে আছে পাটীগণিত, বীজগণিত, সমতল ত্রিকোণমিতি, দ্বিঘাত সমীকরণ। এতে আছে প্রথম n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার ঘাতবিশিষ্ট পদ সমূহের বর্গ ও ঘনের সমষ্টি এবং একটি সাইন অনুপাতের সারণি রয়েছ। তাছাড়া এই অধ্যায়ে সে সময়কার জনপ্রিয় জ্যোতিষচর্চার প্রয়োজনীয় ৩৩টি গাণিতিক প্রক্রিয়ার বর্ণনা রয়েছে। গণিতপাদে আর্যভট্ট পাই-এর মান তথা বৃত্তের পরিধির সঙ্গে এর ব্যাসের মান ৩.১৪১৬ হিসাবে চিহ্নিত করেন।

তাঁর রচিত অপর গ্রন্থ- 'আর্য-সিদ্ধান্ত'-এর কোন পাণ্ডুলিপি খুঁজে পাওয়া যায় নি। এই গ্রন্থটি বরাহমিহির , ব্রহ্মগুপ্ত এবং প্রথম ভাস্করের রচনায়। 

আর্যভট্টের শূন্য ধারণা
আর্যভট্ট সরাসরি শূন্য শব্দটি ব্যবহার করেন নি। তিনি শূন্যের সমতূল্য 'খ' -এর কথা বলেছেন।  এর উপর ভিত্তি করে দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির পূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন। আর্যভট্ট সে সময়ের প্রচলিত ব্রাহ্মীলিপির পরিবর্তে সংখ্যাবাচক তিনি একটি নিজস্ব লিখন পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন। সেখানে সংখ্যাকে শব্দের আকারে উপস্থাপন করা হয়েছে। ব্যঞ্জনবর্ণগুলোকে তিনি ব্যবহার করতেন বিভিন্ন অঙ্ক হিসেবে। আর স্বরবর্ণগুলোর সাহায্যে বুঝিয়ে দিতেন যে কোন অঙ্কটি কোন অবস্থানে রয়েছে। সে দিক থেকে তার ব্যবহৃত দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থা ঠিক আজকের দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থার মত ছিল না। তবে পদ্ধতিগত বিবেচনায় আজকের দশমিক সংখ্যার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল।

দশমিক পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তিনিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ গাণিতিক প্রক্রিয়া বর্ণনা করেছেন। এরই সাহাষ্যে তিনি সংখ্যার বর্গমূল ও ঘনমূল নির্ণয় বর্ণনা করেছেন।  সে সময় সবচেয়ে জরুরি ছিল দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করে পদ্ধতিগত সাধারণীকরণ নিশ্চিত করা। এই কাজটি সর্বপ্রথম করেছিলেন আর্যভট্ট। এই বিচারের তিনিই পূর্ণাঙ্গ দশমিক সংখ্যা পদ্ধতি প্রবর্তনের দাবিদার হতে পারেন। আর্যভট্টের রচনায় দশমিক সংখ্যা ব্যবস্থার বিবৃতিতে স্থানম স্থানম দশ গুণম বাক্যাংশটি পাওয়া যায়। এর অর্থ হল- স্থান থেকে স্থানে দশ গুণ করে পরিবর্তিত হয়। এখান থেকে স্পষ্টতই বর্তমান দশমিক সংখ্যা পদ্ধতির মূল বৈশিষ্ট্যের স্বীকৃতি মেলে।

আর্যভট্টের ত্রিকোণমিতি
ত্রিকোণমিতির ব্যবহারে আর্যভট্ট সাইন, ভারসাইন (Versine = ১ - Cosine), বিপরীত সাইনের ব্যবহার করেন।
সূর্যসিদ্ধান্তে এ সংক্রান্ত কিছু কাজ থাকলেও আর্যভট্টের কাজে তাঁর পূর্ণাঙ্গ বিবরণ মেলে। সাইন ফাংশনের জন্য যুগ্ম ও অর্ধ কোণের সূত্রগুলো তিনি জানতেন বলে ধারণা করা হয়। আর্যভট্টের ব্যবহার করা গুরুত্বপূর্ণ ত্রিকোণমিতিক সম্পর্কগুলোর একটি হল- sin (n+১)x কে sin x এবং sin (n-১)x এর সাহায্যে প্রকাশ করা। আর্যভট্ট একটি সাইন টেবিল তৈরি করেছিলেন, যেটিতে ৩ ডিগ্রি ৪৫ মিনিট পার্থক্যে ৯০ ডিগ্রি পর্যন্ত সাইন এবং ভারসাইনের মান উল্লেখ করা ছিল। তাঁর এই বিষয়ের সূত্র ছিল- 

sin (n + ১) x - sin nx = sin nx - sin (n - ১) x - (১/২২৫)sin nx

আর্যভট্ট তার সাইন টেবিলে সরাসরি sinθ এর বদলে Rsinθ ব্যবহার করেছেন। এখানে R দ্বারা একটি নির্দিষ্ট বৃত্তের ব্যাসার্ধ বোঝানো হচ্ছে। আর্যভট্ট এই ব্যাসার্ধের মান ব্যবহার করেছিলেন ৩৪৩৮, এর সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে আর্যভট্ট এক মিনিট পরিমাণ কোণের জন্য একক ব্যাসার্ধের বৃত্তে বৃত্তচাপের দৈর্ঘ্যকে এক একক হিসেবে ধরে নিয়েছিলেন। একটি বৃত্তের সম্পূর্ণ পরিধি তার কেন্দ্রে (৩৬০ × ৬০) = ২১৬০০ মিনিট কোণ ধারণ করে। সে হিসেবে বৃত্তের পরিধি হল ২১৬০০ একক এবং ঐ বৃত্তের ব্যাসার্ধ হবে ২১৬০০/২π, আর্যভট্টের হিসেবে পাওয়া π = ৩.১৪১৬ ব্যবহার করলে ব্যাসার্ধের মান প্রায় ৩৪৩৮ হয়।

ক্রমিক নং কোণের মান (A)
ডিগ্রি,মিনিট
আর্যভট্টের নিজস্ব সংখ্যাপদ্ধতিতে উল্লিখিত মান প্রচলিত দশমিক পদ্ধতি অনুসারে R(sin nx - sin (n-১)x) এর আর্যভট্ট প্রদত্ত মান আর্যভট্ট প্রদত্ত
(R × sinA) এর মান

(R × sinA) এর প্রকৃত মান
   ১
০৩°   ৪৫.
মখি
২২৫
২২৫'
২২৪.৮৫৬০
   ২
০৭°   ৩০'
ভখি
২২৪
৪৪৯'
৪৪৮.৭৪৯০
   ৩
১১°   ১৫'
ফখি
২২২
৬৭১'
৬৭০.৭২০৫
   ৪
১৫°   ০০'
ধখি
২১৯
৮৯০'
৮৮৯.৮১৯৯
   ৫
১৮°   ৪৫'
ণখি
২১৫
১১০৫'
১১০৫.১০৮৯
   ৬
২২°   ৩০'
ঞখি
২১০
১৩১৫'
১৩১৫.৬৬৫৬
   ৭
২৬°   ১৫'
ঙখি
২০৫
১৫২০'
১৫২০.৫৮৮৫
   ৮
৩০°   ০০'
হস্ঝ
১৯৯
১৭১৯'
১৭১৯.০০০০
   ৯
৩৩°   ৪৫'
স্ককি
১৯১
১৯১০'
১৯১০.০৫০৫
   ১০
৩৭°   ৩০'
কিষ্গ
১৮৩
২০৯৩'
২০৯২.৯২১৮
   ১১
৪১°   ১৫'
শ্ঘকি
১৭৪
২২৬৭'
২২৬৬.৮৩০৯
   ১২
৪৫°   ০০'
কিঘ্ব
১৬৪
২৪৩১'
২৪৩১.০৩৩১
   ১৩
৪৮°   ৪৫'
ঘ্লকি
১৫৪
২৫৮৫'
২৫৮৪.৮২৫৩
   ১৪
৫২°   ৩০'
কিগ্র
১৪৩
২৭২৮'
২৭২৭.৫৪৮৮
   ১৫
৫৬°   ১৫'
হক্য
১৩১
২৮৫৯'
২৮৫৮.৫৯২৫
   ১৬
৬০°   ০০'
ধকি
১১৯
২৯৭৮'
২৯৭৭.৩৯৫৩
   ১৭
৬৩°   ৪৫'
কিচ
১০৬
৩০৮৪'
৩০৮৩.৪৪৮৫
   ১৮
৬৭°   ৩০'
স্গ
৯৩
৩১৭৭'
৩১৭৬.২৯৭৮
   ১৯
৭১°   ১৫'
ঝশ
৭৯
৩২৫৬'
৩২৫৫.৫৪৫৮
   ২০
৭৫°   ০০'
ঙ্ব
৬৫
৩৩২১'
৩৩২০.৮৫৩০
   ২১
৭৮°   ৪৫'
ক্ল
৫১
৩৩৭২'
৩৩৭১.৯৩৯৮
   ২২
৮২°   ৩০'
প্ত
৩৭
৩৪০৯'
৩৪০৮.৫৮৭৪
   ২৩
৮৬°   ১৫'
২২
৩৪৩১'
৩৪৩০.৬৩৯০
   ২৪
৯০°   ০০'
৩৪৩৮'
৩৪৩৮.০০০০

আর্যভট্টের বীজগণিত

একাধিক অজানা রাশি সংবলিত সমীকরণ (সাধারণভাবে ডায়োফ্যান্টাইন সমীকরণ নামে পরিচিত) সমাধান করার একটি সাধারণ পদ্ধতি তৈরি করেছিলেন আর্যভট্ট। এটির নাম ছিল 'কুত্তক'। প্রথম ভাস্করের কাজে কুত্তক পদ্ধতির ব্যাখ্যা দেবার সময় একটি উদাহরণ ব্যবহার করা হয়েছে- "এমন সংখ্যা নির্ণয় কর যাকে ৮ দিয়ে ভাগ করলে ৫, ৯ দিয়ে ভাগ করলে ৪ এবং ৭ দিয়ে ভাগ করলে ১ অবশিষ্ট থাকে।" পরবর্তীকালে এ ধরনের সমস্যা সমাধানের জন্য ভারতবর্ষে কুত্তক পদ্ধতিটিই আদর্শ পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। আর্যভট্টের কাজে প্রথম n সংখ্যক স্বাভাবিক সংখ্যার ঘাতবিশিষ্ট পদ সমূহের বর্গ ও ঘনের সমষ্টির সূত্রের উল্লেখ পাওয়া যায়।

আর্যভট্টের পাইয়ের মান
আর্যভট্টীয় বইটির দ্বিতীয় অধ্যায়ে আর্যভট্ট লিখেছেন- 'চার এর সাথে একশ যোগ করে তাকে আট দিয়ে গুণ করে তার সাথে বাষট্টি হাজার যোগ করা হলে বিশ হাজার একক ব্যাসের বৃত্তের পরিধি পাওয়া যায়'। সে হিসেবে আর্যভট্ট পাই এর মান নির্ণয় করেছিলেন ((4+100)×8+62000)/20000 = 62832/20000 = 3.1416, যেটা তার সময় পর্যন্ত যেকোন গণিতবিদের বের করা মানগুলোর মাঝে সবচেয়ে সঠিক।

আর্যভট্টের জ্যোতির্বিদ্যা
আর্যভট্টীয় গ্রন্থের গোলপাদ অধ্যায়ে উল্লেখ করেছিলেন, পৃথিবী নিজ অক্ষের সাপেক্ষে ঘোরে। তিনি পৃথিবীর আক্ষিক গতির হিসাবও করেছিলেন। তার হিসেবে পৃথিবীর পরিধি ছিল ৩৯,৯৬৮ কিলোমিটার, যেটা সে সময় পর্যন্ত বের করা যেকোন পরিমাপের চেয়ে শুদ্ধতর (ভুল মাত্র ০.২%)। সৌর জগতে গ্রহগুলোর কক্ষপথের আকৃতি তার ভাষ্যে ছিল উপবৃত্তাকৃতির।  এক বছর সময়কালের প্রায় সঠিক একটি পরিমাপ করেছিলেন তিনি। আর্যভট্ট সূর্যগ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের হিন্দু পৌরাণিক ধারণার পরিবর্তে প্রকৃত কারণগুলো ব্যাখ্যা করে গেছেন। সেই সাথে তিনি সূর্য গ্রহণ এবং চন্দ্রগ্রহণের সময়কাল নির্ণয়ের পদ্ধতিও বের করেছিলেন। আর্যভট্ট বলেছিলেন যে চাঁদের আলো আসলে সূর্যের আলোর প্রতিফলনেরই ফলাফল।

তিনি সৌরজগতের পৃথিবীকেন্দ্রিক নাকি সূর্যকেন্দ্রিক মডেল ব্যবহার করেছিলেন সেটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।
B.L. van der Waerden, Hugh Thurston এর লেখায় আর্যভট্টের জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত হিসাব নিকাশের পদ্ধতিকে সরাসরি সূর্যকেন্দ্রিক বলে দাবি করা হয়েছে। Noel Swerdlow-এর মতে  আর্যভট্টের ধারণায় সৌরজগৎ পৃথিবীকেন্দ্রিকই ছিল।