চন্দ্রশেখর,
সুব্রহ্মণ্যন
জ্যোতির্বিজ্ঞানী, নোবেল
পুরস্কার বিজয়ী।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লাহোররে এক তামিল
পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
চন্দ্রশেখর ইতিমধ্যে সামারফেল্ডের বিখ্যাত বই এটমিক স্ট্রাকচার এন্ড স্পেকট্রা লাইন্স পড়েছিলেন। তাই বিশেষ আগ্রহ নিয়ে তিনি সামারফেল্ডের বক্তৃতা শোনেন এবং পরের দিন তিনি হোটেলে তাঁর সাথে গিয়ে দেখা করেন। এত অল্প বয়সে পরমাণু সম্পর্কে চন্দ্রশেখরের গভীর জ্ঞান দেখে সামারফেল্ড মুগ্ধ হন। এরপর সামারফিল্ড অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে তৎকালীন পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে আলোচনা করেন। এই সময় সামারফেল্ড কোয়ান্টাম মেকানিক্সের আলোকে ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিস্টিক্স সম্পর্কিত তাঁর প্রকাশিতব্য একটা গবেষণাপত্রের প্রুফ পড়তে দিলেন চন্দ্রশেখরকে। কোয়ান্টাম তত্ত্বের আলোকে পদার্থের ইলেকট্রন তত্ত্বের ওপর সামারফেল্ড-এর লিখিত গবেষণাপত্রটি, প্রকাশিত হওয়ার আগেই তাঁর পড়ার সুযোগ ঘটেছিল।
চন্দ্রশেখর সীমা (Chandrasekhar limit) কোন তারার ভর আমাদের সূর্যের চাইতে দেড় গুণ বেশি ভর সম্পন্ন হলে, তা নিউট্রন তারা বা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হবে। আর এর চাইতে কম ভরবিশিষ্ট তারা শ্বেতবামনে পরিণত হবে। বর্তমানে এই ১.৪৪ সৌরভর-কে আদর্শ হিসাবে ধরা হয়। এর মান ১.৪৪ (২.৮৬৪ ×১০৩০ কেজি) |
কেমব্রিজে তিনি ট্রিনিটি কলেজে (
Trinity College) ভর্তি হন। এবং প্রফেসর রাল্ফ ফাওলারের (R. H. Fowler) তত্ত্বাবধানে গবেষণা শুরু করেন। কয়েকদিন পর তিনি ফাওলারকে তাঁর জাহাজে লেখা নক্ষত্র সম্পর্কিত দুটি গবেষণাপত্র দেখান। এর ভিতর প্রথম পত্রটি রয়েল সোসাইটির প্রসিডিংস পাঠানো হলেও, দ্বিতীয় পত্রটি প্রকাশে ফাওলার গড়িমসি করেন। কারণ তিনি 'চন্দ্রশেখর সীমা' অংশটুকু মেনে নিতে পারছিলেন না। তাই তিনি এই বিষয়ের মতামতের জন্য দ্বিতীয় পত্রটি এডওয়ার্ড মিলনি'র কাছে পাঠান। পরবর্তী কয়েক মাস এই দুই বিজ্ঞানী কোনো মতামত না জানালে, তিনি এর একটা সংস্করণ আমেরিকার এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে পাঠান। পরের বছর এস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে চন্দ্রশেখরের বিখ্যাত গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়।রিলেটিভিস্টিক আয়োনাইজেশান ও মহাকাশ নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাবার সময় চন্দ্রশেখরের সাথে বিশিষ্ট নভোপদার্থবিজ্ঞানী এডওয়ার্ড মিল্নির পরিচয় ঘটে। প্রফেসর মিলনি চন্দ্রশেখরের গবেষণার বিষয়ে আগে থেকেই জানতেন। এরপরে উভয়ই উভয়ে গবেষণার সহযোগী হয়ে উঠেন। এই গবেষণার সূত্রে ট্রিনিটি কলেজ থেকে একটি সম্মানজনক পুরস্কার পান। এই পুরস্কার প্রাপ্তির পর পদার্থ বিজ্ঞানী এডিংটন চন্দ্রশেখরকে অভিনন্দন জানান এবং ১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ মে-তে তাঁর অফিসে এসে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। উল্লেখ্য এই সময় এডিংটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সবগুলো অবজারভেটরির পরিচালক ছিলেন। ২১ মে তারিখে চন্দ্রশেখর তাঁর মায়ের মৃত্যু সংবাদ টেলিগ্রাম মাধ্যমে পান। প্রথমে ভেবেছিলেন তিনি দেশে ফিরে যাবেন। পরে সিদ্ধান্ত পাল্টিয়ে ২৩মে-তে এডিংটনের সাথে দেখা করেন। প্রাথমিকভাবে এডিংটনের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। পরবর্তী সময়ে এই এডিংটনই 'চন্দ্রশেখর সীমা'র তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন।
মায়ের মৃত্যুর পর কেমব্রিজে মন বসাতে না পেরে, তিনি গ্রীষ্মের ছুটি নিয়ে ইউরোপে ঘুরে বেড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। ঘুরে বেড়াতে এসে, জার্মানির গটিনগেন ইউনিভার্সিটিতে ম্যাক্স বর্নের সাথে তাঁর দেখা হয় এবং তাঁর সাথে কিছুদিন গবেষণার কাজে জড়িয়ে পড়েন। ফলে তাঁর ইউরোপ ভ্রমণ অসমাপ্তই থেকে যায়। সেপ্টেম্বরে মাসে জার্মানি থেকে ফিরে এসে তিনি আগের কাজে যোগ দেন। কিন্তু এই গবেষণায় তাঁর কাছে বিরক্তির মনে হওয়ায়, তিনি ডিরাককে তাঁর মনের অবস্থা জানান। ডিরাক তাঁকে কোপেনহেগেনে নিল্স বোরের ইনস্টিটিউটে গিয়ে কিছুদিন কাজ করার জন্য পরামর্শ দিলেন। চন্দ্রশেখর ডিরাকের পরামর্শ মেনে কোপেনহেগেনে এসে নবোদ্যমে কাজ শুরু করেন।
ডিরাক ফার্মি-ডিরাক সংখ্যায়নের একটা সমস্যার কথা তিনি আগে থেকেই জানতেন, কিন্তু কখনো সমাধান করার চেষ্টা করেন নি। কোপেনহেগেনে এসে চন্দ্রশেখর সমস্যাটির সমাধান করতে বসলেন। বেশ কিছুদিন কাজ করার পর চন্দ্রশেখর সমস্যাটির সমাধান করে ফেললেন এবং একটি প্রতিবেদন তৈরি করলেন। নিল্স বোর প্রতিবেদন পাঠ করে সন্তুষ্ট হয়ে, রয়েল সোসাইটিতে তা প্রকাশের জন্য পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু এই গবেষণা পত্রের একটি ভুল ধরিয়ে দেন ডিরাক। চন্দ্রশেখর ব্যাপারটা বুঝতে পারার পর, রয়েল সোসাইটি থেকে তাঁর গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহার করে নেন।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তাঁর ট্রিনিটি কলেজ স্কলারশিপ শেষ হবে, তাই তিনি তার আগেই পিএইচডি থিসিস জমা দেওয়ার জন্য তাঁর নিজের প্রকাশিত গবেষণাপত্রগুলো নিয়ে পুনরায় বসলেন। অবশ্য প্রফেসর ফাওলার জানতেন চন্দ্রশেখরের জন্য পিএইচডি ডিগ্রি পাওয়াটা শুধু একটা আনুষ্ঠানিকতা। কারণ চন্দ্রশেখর ছাত্রাবস্থায় যতগুলো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন, কেমব্রিজের অনেক অধ্যাপকেরও ততগুলো গবেষণাপত্র নেই। সুতরাং তাঁর পিএইচডি পাওয়া নিয়ে ভাবনার চেয়ে তাঁর কাছে বড় বিষয় ছিল, স্কলারশিপ শেষ হলে তিনি ইউরোপে থাকবেন কিভাবে। এর মধ্যে একদিন ট্রিনিটি কলেজের ফেলোশিপের বিজ্ঞপ্তি দেখে, তিনি এই ফেলোশিপের জন্য আবেদন করেন এবং শেষপর্যন্ত ফেলোশিপ পেয়ে পান। উল্লেখ্য রামানুজনের পরে চন্দ্রশেখরই হলেন দ্বিতীয় ভারতীয়, যিনি এই ফেলোশিপ পেয়েছিলেন। ট্রিনিটি ফেলো হিসেবে তিনি পরে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিরও ফেলোশিপ পান।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে তিন রাশিয়া ভ্রমণ করেন। এই সময় নক্ষত্র বিষয়ক তাঁর পুরনো গবেষণার বিষয়ে তিনি বিশেষভাবে আগ্রহী হয়ে উঠেন। রাশিয়ায় তিনি শ্বেত বামন তারার ভরের সীমা বিষয়ক বক্তৃতা দেন। এই সময় রাশিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভিক্টর এম্বার্টসুমিয়ান চন্দ্রশেখরের এই বক্তৃতায় খুব উৎসাহ দেখালেন এবং চন্দ্রশেখরকে বললেন এ ব্যাপারে বিস্তারিত ফলাফল প্রকাশ করতে। এরপর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দ শেষ হওয়ার আগেই, তিনি দুটো গবেষণাপত্র তৈরি করেন এবং তা রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটিতে জমা দেন। এরপর ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি সোসাইটির মাসিক সভায় বক্তৃতা দেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন স্যার এডিংটন। তিনি চন্দ্রশেখরকে তাঁর প্রবন্ধের বিষয়ে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করলেন। তিনি চন্দ্রশেখরের তত্ত্বের তীব্র বিরোধিতা করেন। সে কালে এডিংটনের মতের বিরোধিতা করার মতো কারো বিদ্যা বা সাহস ছিল না। তাই চন্দ্রশেখরের মতামত সোসাইটি অগ্রাহ্য করে, এডিংটনের মতামতকেই গুরুত্ব দিয়েছিল।
১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে প্যারিসে অনুষ্ঠিত শ্বেত-বামন তারা সংক্রান্ত কনফারেন্সেও একই অবস্থা হলো। ডিরাক-সহ আরো অনেক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীর চন্দ্রশেখরের তত্ত্বের প্রতি সমর্থন জানালেও, এডিংটনের সাথে প্রকাশ্যে বিরোধে জড়াতে চাইলেন না। ডিরাক ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে রিলেটিভিস্টিক কোয়ান্টাম তত্ত্বের প্রতি এডিংটনের তাচ্ছিল্যের সমালোচনা করে, একটা গবেষণাপত্র লিখেছিলেন বটে, কিন্তু তাতে কোথাও চন্দ্রশেখরের সূত্রের কথা উল্লেখ ছিল না। চন্দ্রশেখর অভিমান করে, কারো সাথেই কোন বিরোধে জড়ালেন না। এর প্রায় দুই যুগ পর 'চন্দ্রশেখর লিমিট' নিজের যোগ্যতাতেই প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে প্রয়োজনীয় নক্ষত্রবিষয়ক সূত্র হিসেবে এই সূত্রকে বিবেচনা করা হয়। চন্দ্রশেখরের সীমার চেয়ে বেশি ভরের তারাগুলোর ভবিষ্যত কী? এডিংটনের এ প্রশ্নের উত্তর আজ সবাই জানে, যে এরা 'নিউট্রন তারা' কিংবা কৃষ্ণ-গহ্বরে-এ পরিণত হয়। এই কারণে এইসূত্রের সাথে বর্তমানে শ্বেত বামন তারার বিবর্তনকেও উল্লেখ করা হয়।
চন্দ্রশেখরের গবেষণার ব্যাপারে এডিংটনের ঋণাত্মক মনোভাব প্রকাশিত হয়ে পড়ার পর, কেমব্রিজে স্থায়ী কোন পদে নিয়োগ পাবার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ হয়ে পড়লো। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে পর তাঁর ট্রিনিটি ফেলোশিপ শেষ হয়ে গেলে কি করবেন, এ নিয়ে তিনি চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এসময় তাঁর কাকা রামন― ব্যাঙ্গালোরে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। চন্দ্রশেখর কাকার অধীনে গবেষণা করতে রাজি হলেন না। কারণ, তিনি ভেবেছিলেন, কাকার অধীনের গবেষণা করলে তাঁর স্বকীয় ভাবনা বিকশিত হবে না। এর পরিবর্তে তিনি লাহোর সরকারি কলেজে গণিতের অধ্যাপক পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেখে দরখাস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে জানতে পারলেন যে, সেই পদের জন্য ইতোমধ্যেই দরখাস্ত করেছেন চন্দ্রশেখরের বন্ধু চাওলা। চাওলা খুব ভালো গণিতবিদ। চন্দ্রশেখর চাওলাকে সুযোগ করে দেয়ার জন্য নিজের দরখাস্ত প্রত্যাহার করে নিলেন। কিন্তু পরে জানতে পারেন যে, সেখানে চাওলার বদলে অন্য কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড কলেজ অবজার্ভেটরির পরিচালক হারলো শ্যাপলি তিন মাসের জন্য হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার পদে আমন্ত্রণ জানান চন্দ্রশেখরকে। চন্দ্রশেখর এই আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ পর্যন্ত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি শিক্ষকতা ও গবেষণা করলেন। এই সময় তিনি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে আমেরিকান এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির সভায় যোগ দেন। পরে সেখানকার অবজারভেটরির পরিচালকের আমন্ত্রণে দশটি বক্তৃতা দেন। এই সময় তিনি উইসকনসিনে উইলিয়াম্স বে'র ইয়ের্ক্স অবজারভেটরি পরিদর্শন করলেন। চন্দ্রশেখরের সাথে কথা বলে এখানকার পরিচালকদের সবাই খুব মুগ্ধ হলেন। পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় তাদের অবজারভেটরিতে যোগ দেয়ার জন্য তাঁকে অনুরোধ করেন। অন্যদিকে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ইয়ের্ক্স অবজারভেটরিতে রিসার্চ এসোসিয়েট হিসেবে যোগ দেয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। পরে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ের্ক্স অবজারভেটরিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কাজে যোগ দেওয়ার আগে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দেশে ফিরে আসেন। এই সময় তাঁর বাগদত্তা ললিতা, তখন পদার্থবিজ্ঞানে এমএসসি পাস করে ব্যাঙ্গালোরে রামনের ইনস্টিটিউটে কাজ করছিলেন। ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর ললিতার সাথে চন্দ্রশেখরের বিয়ে হয়।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে ললিতাকে সাথে নিয়ে চন্দ্রশেখর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আসেন এবং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের ইয়ের্ক্স অবজারভেটরিতে কাজ শুরু করেন। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার কিছুদিন পর, তিনি জ্যোতির্বিদ্যা ও নভোপদার্থবিজ্ঞানের গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম চালু করেন চন্দ্রশেখর।
১৯৩৬ সাল পর্যন্ত কেমব্রিজে নক্ষত্রের গঠন ও ধর্মাবলী নিয়ে যে গবেষণাপত্রগুলো (৪৩টি গবেষণাপত্র) প্রকাশিত হয়েছিল, ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে সেগুলোর ভিত্তিতে একটি বই রচনা করেন। এই বইটির নাম এন ইন্ট্রোডাকশান টু দি স্টাডি অব স্টেলার স্ট্রাকচার”। শিকাগো ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে বইটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে। উল্লেখ্য এটিই ছিল তাঁর রচিত প্রথম গ্রন্থ।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ অধ্যাপক হন । ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি 'মরটন ডি হাল ডিস্টিংগুইস্ড সার্ভিস প্রফেসর' হন। এই সময় হার্ভার্ড, কেমব্রিজ, এম-আই-টি, প্রিন্সটন সহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমন্ত্রণ এলেও শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে আর কোথাও যান নি। ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে হোমি ভাবা যখন টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ গড়ে তুলছেন, তখন চন্দ্রশেখরকে আহ্বান জানিয়েছিলেন সেখানে যোগ দেয়ার জন্য। প্রাথমিকভাবে রাজিও হয়েছিলেন। কিন্তু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হয়ে যাবার পর, তিনি এই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
তারপর ১৯৩৮ থেকে ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি গবেষণা করেছেন মহাকাশের গতিপ্রকৃতি নিয়ে। এই ছয় বছরে তাঁর ৩৭টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। চন্দ্রশেখর পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে হিসেব করে মহাকাশের আপাত বিশৃঙ্খল গতিকে গাণিতিক শৃঙ্খলায় উপস্থাপন করে একটি গবেষণাপত্র তৈরি করেন। তাঁর গবেষণার ভিত্তিতে ১৯৪৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর দুটো বই― প্রিন্সিপলস অব স্টেলার ডায়নামিক্স এবং স্টকাস্টিক প্রবলেমস ইন ফিজিক্স এন্ড এস্ট্রোনমি।
১৯৪৩ থেকে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত চন্দ্রশেখর গবেষণা করেন মহাকাশের আবহাওয়া ও পরিবেশ নিয়ে। এক নক্ষত্র থেকে অন্য নক্ষত্রে মহাকাশে শক্তির বিকিরণ কীভাবে সঞ্চালিত হয়― তার উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেন। এতে যুক্ত হয় মহাকাশের পরিবেশ, হাইড্রোজেনের ঋণাত্মক আয়নের কোয়ান্টাম তত্ত্ব, সূর্যালোকের উপস্থিতিতে মহাকাশে আলোর দীপ্তি ও মেরুকরণ। এই বিষয়ে তাঁর ৬৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। আর এসবের ভিত্তিতে ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর চতুর্থ বই রেডিয়েটিভ ট্রান্সফার ।
এইসব কাজের মধ্যে, ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে ললিতা ও চন্দ্রশেখর আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। ভারতে তখনো দ্বৈতনাগরিকত্ব গ্রহণযোগ্য ছিল না। ফলে আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করার সাথে সাথে ললিতা ও চন্দ্রশেখরের ভারতীয় নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। চন্দ্রশেখরের বাবা তাঁদের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেন নি। বাবার সাথে আর দেখাও হয় নি চন্দ্রশেখরের। উল্লেখ্য ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে চন্দ্রশেখরের বাবা মারা যান। এরপর ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের জাতীয় অধ্যাপক পদে যোগ দেয়ার জন্য আহ্বান করা হয় তাঁকে। কিন্তু তিনি 'আমেরিকান নাগরিক' এই অজুহাতে এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বিমান দুর্ঘটনায় হোমি ভাবার মৃত্যুর পর, ভারতের পারমাণবিক শক্তি কমিশনের চেয়ারম্যান পদে যোগ দেয়ার জন্যও তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয় চন্দ্রশেখরকে। এবারেও চন্দ্রশেখর প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন। পরে তিনি নিজে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর কাছে প্রত্যাখ্যানের কারণ ব্যাখ্যা করেচিলেন। ভারতের এটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হতে গেলে ভারতের রাজনীতিকদের সাথে ভালো বোঝাপড়া থাকা দরকার এবং তার সাথে প্রশাসনিক কাজে অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা দরকার। চন্দ্রশেখরের তা নেই। সর্বোপরি ওই পদ নিতে গেলে তাঁকে আমেরিকান নাগরিকত্ব ত্যাগ করে আবার ভারতীয় নাগরিকত্ব নিতে হতো।
১৯৫০ থেকে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত গবেষণা তিনি করেন হাইড্রোডায়নামিক ও হাইড্রোম্যাগনেটিক স্থায়ীত্ব বিষয়ে। চৌম্বকক্ষেত্রের উপস্থিতিতে, মহাকাশে গ্রহাণু থেকে শুরু করে গ্যালাক্সির গতিপ্রকৃতি কেমন হবে সে বিষয়ে গবেষণা করেন। এই দশ বছরে তাঁর ৮৫টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এসকল বিষয় নিয়ে, ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় হাইড্রোডায়নামিক এন্ড হাইড্রোম্যাগনেটিক স্ট্যাবিলিটি নামক বই।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তাঁর আরো ৬৪টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়। এই গবেষণাপত্রগুলোর ভিত্তিতে ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ইয়েল ইউনিভার্সিটি থেকে এলিপসোইডাল ফিগার্স অব ইকুইলিব্রিয়াম নামক বইটি প্রকাশিত হয়। একাডেমিক জীবনের শেষের দিকে এসে, তিনি আপেক্ষিকতার সার্বিক তত্ত্ব ও আপেক্ষিক জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত গবেষণায় মন দেন। এর ভিত্তিতে ব্ল্যাক-হোলের গাণিতিক তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে, তাঁর শারীরীক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকে। তারপরও ১৯৬৯ থেকে ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে তিনি আরো ৬৬টি গবেষণা পত্র রচনা করেন তিনি। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় তাঁর সপ্তম বই দি ম্যাথমেটিক্যাল থিওরি অব ব্ল্যাক হোল্স।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে তিনি নোবেল পুরস্কার পান।
১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপরেও এমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে আমৃত্যু শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়েই ছিলেন। ৪৮ বছরের শিক্ষকতা জীবনে একান্ন জন গবেষক পিএইচডি ডিগ্রি পান চন্দ্রশেখরের তত্ত্বাবধানে।
জীবনের শেষের দিকে এসে ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় গবেষণার বাইরে, ভিন্ন বিষয়ের বই ট্রুথ এন্ড বিউটি।
১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নিউটন'স প্রিন্সিপিয়া ফর দি কমন রিডার প্রকাশের পর― চন্দ্রশেখর মন্তব্য করেছিলেন 'আমার কাজ শেষ। অনেক দিন বাঁচা হলো। এবার মরে গেলেও কোন সমস্যা নেই'। এর কিছুদিন পর, এই বৎসরের ২১ আগস্টে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
বিবাহিত জীবনে চন্দ্রশেখর ও ললিতা নিঃসন্তান ছিলেন।
সম্মাননা, পুরস্কার ও প্রাপ্তি
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্ডিয়া গভমেন্টের বিশেষ স্কলারশিপ পান।
১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দে ট্রিনিটি ফেলোশিপ পান।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ইংল্যান্ডের রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাডাম'স পুরস্কার পান।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির ব্রুস গোল্ড মেডেল পান।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রয়েল এস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটির গোল্ড মেডেল পান।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের মেম্বারশিপ লাভ করেন।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান একাডেমি অব আর্টস এন্ড সায়েন্সের রামফোর্ড মেডেল পান।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে রয়েল সোসাইটির রয়েল মেডেল এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমির শ্রীনিবাস রামানুজন মেডেল পান।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট কর্তৃক ন্যাশনাল মেডেল অব সায়েন্স পান।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পদ্মবিভূষণ লাভ করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের হেনরি ড্রেপার মেডেল পান।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পোলিশ ফিজিক্যাল সোসাইটির স্মোলুকাউস্কি মেডেল পান।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির ড্যানি হেইনম্যান প্রাইজ পান।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পান
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল পান। জুরিখের ডক্টর টোমালা প্রাইজ, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল এসোসিয়েশানের বিড়লা মেমোরিয়েল এওয়ার্ড পান।
তথ্যসূত্র :
বাংলা বিশ্বকোষ। দ্বিতীয় খণ্ড। নওরোজ কিতাবিস্তান। ডিসেম্বর ১৯৭৫।
http://blog.bdnews24.com/duranta/41080