ফজিলাতুন্নেসা
১৮৯৯-১৯৭৭।
শিক্ষক। প্রথম বাঙালি মুসলমান ছাত্রী যিনি উচ্চ শিক্ষার্থে বৃত্তি নিয়ে বিদেশে যান।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইল জেলার টাঙ্গাইল সদর থানার নামদার কুমুল্লী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা ওয়াজেদ আলী খাঁ ছিলেন স্থানীয় মাইনর স্কুলের শিক্ষক। মায়ের নাম  হালিমা খাতুন।

১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের করটিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে ইডেন কলেজ থেকে আইএ পাস করেন।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে বিএ পাস করেন।
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে এমএ-তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট (গোল্ড মেডালিস্ট) হয়েছিলেন।

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের জুন মাসের জুন মাসের ২০ তারিখে (বুধবার ৬ আষাঢ় ১৩৩৫) কয়েকজন বন্ধুসহ কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় আসেন। এই সময় ফজিলাতুন্নেসা ঢাকার দেওয়ান বাজারস্থ হাসিনা মঞ্জিলে থাকতেন। কাজী মোতাহার হোসেন-এর মাধ্যমে নজরুলের পরিচয় ঘটে। নজরুল ফজিলাতুন্নেসার প্রেমে পড়েছিলেন। তবে ফজিলতুন্নেসা নজরুলের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন।  এই বিষয়ে জানা যায় কাজী মোতাহার হোসেনের রচিত 'আমার বন্ধু নজরুল: তাঁর গান' প্রবন্ধ থেকে। এই প্রবন্ধে তিনি লেখেছেন-

'...তিনি (ফজিলাতুন্নেসা) আমার বান্ধবী ছিলেন এবং আমার কাছ থেকে তিনি শুনেছিলেন যে কবি একজন সৌখিন হস্তরেখাবিদ। আমাকে তিনি কবির কাছে তাঁর হাতের রেখা দেখাবার জন্যে অনুরোধ করেন। যথারীতি একদিন কবিকে নিয়ে হাসিনা মঞ্জিলের কাছে দেওয়ান বাজার রাস্তার উল্টোদিকে অবস্থিত ফজিলাতুন্নেসার গৃহে আমি উপনীত হই। প্রায় আধঘণ্টা ধরে গভীর মনোযোগের সঙ্গে কবি ফজিলাতুন্নেসার হাতের মস্তিষ্ক রেখা, জীবনরেখা, হৃদয়রেখা, সংলগ্ন ক্ষুদ্র রেখাসমূহ এবং সেই সঙ্গে ক্রস, ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ সমন্বিত অন্যান্য মাউন্ট, শুক্র, শনি, রবি, বুধ, মঙ্গল ও চন্দ্রের অবস্থানগুলো নিরীক্ষণ করলেন; কিন্তু এগুলোর সম্বন্ধ-সূত্রের ফলাফল নির্ণয় করতে ব্যর্থ হলেন। তিনি একজন জ্যোতিষীর মত সূর্য, চন্দ্রের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত তারকার অবস্থান টুকে নিলেন এবং রাত্রিতে তিনি বিশদভাবে এটা নিয়ে পরীক্ষা করবেন বলে জানালেন।...'

কাজী মোতাহার হোসেনের লেখা এই রচনা থেকে জানা যায়, রাত্রিবেলায় নজরুল ফজিলাতুন্নেসা বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং তাঁকে প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যিত হন। এই প্রেমের সূত্রে তিনি রচনা করেছিলেন- বর্ষা বিদায়, তোমারে পড়ুছে মনে

১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে (আশ্বিন ১৩৩৫) উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ফজিলুতন্নেসা ইংল্যান্ডে যান। তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল সওগাত পত্রিকার অফিসে। নজরুল ফজিলুতন্নেসার বিদায় উপলক্ষে রচনা করেছিলেন একটি গান। গানটি হলো- জাগিলে পারুল কি গো [তথ্য] এই অনুষ্ঠানে এই গানটি নিজেই পরিবেশন করেন। এছাড়া নজরুল ফজিলতুন্নেসার বিলেত গমন উপলেক্ষে 'বর্ষা-বিদায়” নামক একটি কবিতা লেখেন।

নিখিল বঙ্গে তিনিই ছিলেন প্রথম মুসলিম মহিলা গ্র্যাজুয়েট। ইংল্যান্ডে লেখাপড়ার সময় খুলনা নিবাসী আহসান উল্ল্যাহর পুত্র জোহা সাহেবের সাথে ফজিলাতুন্নেছার পরিচয় হয়। পরে উভয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতায় প্রথমে স্কুল ইন্সপেক্টরের চাকুরিতে যোগদান করেন। এই বছরের আগস্ট মাসে কলকাতার অ্যালবার্ট হলে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় মুসলিম সমাজ-সেবক-সংঘে’র বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতি হিসেবে তাঁর বক্তব্যটি নারী জাগরণের মাইল ফলক হয়ে আছে।

১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বেথুন কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পাক-ভারত বিভাজনের সময় তিনি বেথুন কলেজের শিক্ষকতা ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকার ইডেন কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। অধ্যক্ষ হিসেবে বেগম ফজিলাতুন্নেছার অক্লান্ত পরিশ্রম ও চেষ্টায় বিজ্ঞান ও বাণিজ্যিক বিভাগসহ ইডেন কলেজ ডিগ্রি পর্যায়ে উন্নীত হয়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ইডেন কলেজের মেয়েরা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কলেজের অভ্যন্তর থেকে মিছিল বের করার প্রস্তুতি নিলে উর্দুভাষী এক দারোগা হোস্টেলে ঢুকে মেয়েদের ভয়ভীতি দেখাতে শুরু করে। এক পর্যায়ে খবর পেয়ে বেগম ফজিলাতুন্নেছা কলেজে এসে তার বিনা অনুমতিতে কলেজ প্রাঙ্গণে ঢোকার জন্য দারোগাকে ভর্ৎসনা করে নিজের দৃঢ়তা ও প্রশাসনিক ক্ষমতার বলে হোস্টেল থেকে বের করে দেন।

১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১ অক্টোবর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর স্মৃতি রক্ষার্থে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে ফজিলাতুন্নেছার নামে হল নির্মাণ করা হয়।

নারী শিক্ষা ও নারীমুক্তি সম্পর্কে সওগাতসহ অনেক পত্রিকায় তার বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প প্রকাশিত হয়।


সূত্র: