গোকুলচন্দ্র
নাগ
(১৮৯৪-১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দ )
চিত্রশিল্পী,
কল্লোল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং এই পত্রিকার সহকারী
সম্পাদক।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন ব্রিটিশ ভারতের
কলকাতায়
জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম মতিলাল নাগ এবং মায়ের নাম কমলা
দেবী। উল্লেখ্য, এঁদের আদি নিবাস ছিল বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরে। শৈশবেই মাতৃপিতৃহীন হয়ে মানুষ হন মাতুলালয়ে
মামা বিজয় বসুর কাছে প্রতিপালিত হন। শৈশব থেকে তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল চিত্রাঙ্কন ও সাহিত্য।
তিনি প্রথমে সাউথ সুবার্বন স্কুলে
ভর্তি হন। কিন্তু পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হওয়ায় প্রধান শিক্ষকের তিরস্কারে স্কুল ত্যাগ
করেন। এরপর ঘাটশিলার একটি স্কুলে কিছুদিন লেখাপড়া করেন। শেষ পর্যন্ত অমনোযোগী
শিক্ষার্থী হিসেবে স্কুল ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
শৈশব থেকে তাঁর ছবি
আঁকার প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। এই কারণে তাঁকে সরকারি আর্ট
স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়। ছবি আঁকার পেশাকে তাঁর মামা খুব একটা ভাল চোখে দেখতেন
না। তাই মামার অমতেই তিনি অঙ্কনবিদ্যা চর্চা চালিয়ে গেছেন। আর্ট স্কুলের সূত্রে
তাঁর সাথে পরিচয় ঘটেছিল শিল্পী অতুল বসু, যামিনী
রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে। পরে তিনি পার্সি ব্রাউন ও যামিনীপ্রকাশ
গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে তিনি ছবি আঁকা শিখেছিলেন।
এখান থেকে পাশ করে তিনি রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহকারী
হিসেবে পুনেতে ভারতীয প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ওয়েস্টার্ন সার্কেলে কাজে যোগ দেন।
এখানে বছর খানেক কাজ করার পর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বম্বের জনৈক
সলিসিটার দম্পতির আনুকূল্যে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। কিন্তু শারীরিকভাবে অত্যন্ত
দুর্বল হয়ে পড়েন। পরে তিনি এই কাজ ছেড়ে
কলকাতায়
তাঁর বিধবা দিদির কাছে চলে আসেন।
কলকতার নিউ মার্কেটে তখন তাঁর মামা সুরেন বসুর ফুলের দোকান ছিল। এই দোকানে তিনি
মামার সাথে বসা শুরু করেন। এই সময় তিনি বুকের ব্যথায় মাঝে মাঝে কাতর হয়ে পড়তেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্ল ঘোষের সাথে অহীন্দ্র চৌধুরী বায়স্কোপ নাটকের প্রতিষ্ঠান ফটো প্লে সিন্ডিকেট প্রতিষ্ঠা করেন।
এই প্রতিষ্ঠান থেকে ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে মুক্তি পায় Soul of a Slave ।
ছবিটির পরিচালক ছিলেন হেমচন্দ্র মুখার্জ্জি। এই ছবিতে নায়ক 'ধর্মপালে'র ভূমিকায় ছিলেন অহীন্দ্র চৌধুরী আর সহচর 'বাহুসেন'র
ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেনগোকুলচন্দ্র।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার হাজরা রোডে 'চার শিল্প গোষ্ঠী' নামক একটি সাহিত্য আড্ডায়
যুক্ত হন। এই আড্ডার অন্য তিনজন সদস্য ছিলেন।
দীনেশরঞ্জন দাশ,
সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু। উল্লেখ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এই আড্ডার সূচনা হয়েছিল
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ৪ঠা জুন। এই সাহিত্য আড্ডার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা সাহিত্য, ললিত
কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এই চার সদস্য 'ঝড়ের দোলা'
নামক একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন। এই সংকলনটি সাহিত্যিকমহলে বিপুলভাবে আদৃত হলে
'চার শিল্প গোষ্ঠী' একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন এবং ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে
'কল্লোল' নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন
দীনেশরঞ্জন দাশ।
আর গোকুলচন্দ্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক। তবে পত্রিকা প্রকাশের মূল নীতিনির্ধারক ছিলেন
গোকুলচন্দ্র। বাড়তি লোক রাখার সামর্থ না থাকায়- বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, গ্রাহক সংখ্যা
বৃদ্ধি, মুদ্রণ কার্যের তদারক সবই গোকুলচন্দ্র একাই করতেন।
এই পত্রিকার মাধ্যমে একটি নব্যধারার সাহিত্য-গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। এঁরা
প্রায় নিয়মিতভাবে
দীনেশরঞ্জন দাশের পটুয়াতলা লেনের বাড়িতে বসতেন।
এই পত্রিকার সূত্রে 'চার শিল্পী-গোষ্ঠী' কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠীতে
পরিণত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই পত্রিকা যে বাংলা সাহিত্যের
অধ্যায়টি রচনা করেছিল, তা 'কল্লোল সাহিত্য যুগ' নামে অভিহিত করা হয়।
তিনি যক্ষাতে আক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়েন। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাঁকে
দার্জিলিং নেওয়া হয়।১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪শে সেপ্টেম্বর দার্জিলিং-এর মৃত্যু হয়।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
- ঝড়ের দোলা (১৯২২)। ফোর আর্টস ক্লাবে'র চারজনের চারটি গল্প নিযে বইটি রচিত হয়। গোকুলচন্দ্র লিখেছিলেন 'মাধুরী' গল্পটি।
- 'রূপরেখা' (১৯২২)।
(কথিকা সংকলন: 'মালিনী', 'শিশির', 'বাতায়ন', 'জলছবি', 'মা', 'আলো', 'ছায়া', 'দুই সন্ধ্যা', 'পুজারিণী', 'অনন্ত' ও 'আশা' - এই দশটি রচনা গ্রন্থবদ্ধ হয়ে 'রূপরেখা' প্রকাশিত হয়। এই লেখাগুলি 'প্রবাসী', 'ভারতবর্ষ', 'নব্যভারত' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল)
- 'রাজকন্যা (১৯২২)। (টেনিসনের লেখা 'দি প্রিন্সেস' অবলম্বনে ছোটদের জন্য রচিত বই)।
- 'সোনার ফুল' (১৯২২)। এটি 'বঙ্গবাণী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল, শেষের কযেক অধ্যায় বাদ দিয়ে।
- 'পরীস্থান' (১৯২৪)। মেটারলিঙ্কের 'ব্লু বার্ড' নামক নাটকের কিছু নির্বাচিত অংশ নিয়ে ছোটদের জন্য রচিত হয়েছে এই গন্থটি।
- পথিক' (১৯২৫)। এই উপন্যাসটি 'কল্লোল' পত্রিকায় ১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা (১৩০০ বঙ্গাব্দ, বৈশাখ) ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যা পর্যন্ত (১৩৩১-এর জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন বাদে) ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে।
- ''মায়ামুকুল' (১৯২৭)। তিন খণ্ডে মোট ১৯টি গল্প নিয়ে এই গ্রন্থটি রচিত। লেখকের মৃত্যুর সময় এটি প্রকাশের কাজ চলছিল। সম্পূর্ণ গ্রন্থটি গোকুলচন্দ্র দেখে যেতে পারেন নি।