কল্লোল পত্রিকা
১৯২৩ থেকে ১৯২৯ বঙ্গাব্দের ভিতরে তৎকালীন অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের কলকাতা থেকে প্রথম প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা। এই পত্রিকার মাধ্যমে রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিকাশের পথকে উন্মুক্ত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের নব্যধারার ক্রমোত্তরণে এই পত্রিকাটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে।

এই পত্রিকার সূত্রপাত হয়েছিল ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতার হাজরা রোডে 'চার শিল্প গোষ্ঠী' নামক একটি সাহিত্য আড্ডার মাধ্যমে। এই আড্ডার চার সদস্য ছিলেন- গোকুলচন্দ্র নাগ, দীনেশরঞ্জন দাশ, সুনীতা দেবী এবং মনীন্দ্রলাল বসু। আনুষ্ঠানিকভাবে এই আড্ডার সূচনা হয়েছিল ৪ঠা জুন।

এই সাহিত্য আড্ডার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা সাহিত্য, ললিত কলা, সংগীত ও নাটক সৃষ্টি ও চর্চা। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এই চার সদস্য 'ঝড়ের দোলা' নামক একটি সাহিত্য সংকলন প্রকাশ করেন।

এই সংকলনটি সাহিত্যিকমহলে বিপুলভাবে আদৃত হলে 'চার শিল্প গোষ্ঠী' একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন এবং ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে 'কল্লোল' নামক পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটির প্রথম সম্পাদক ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশ। আর গোকুলচন্দ্র ছিলেন সহকারী সম্পাদক তবে পত্রিকা প্রকাশের মূল নীতিনির্ধারক ছিলেন গোকুলচন্দ্র। বাড়তি লোক রাখার সামর্থ না থাকায়- বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, গ্রাহক সংখ্যা বৃদ্ধি, মুদ্রণ কার্যের তদারক সবই গোকুলচন্দ্র একাই করতেন?

এই পত্রিকার মাধ্যমে একটি নব্যধারার সাহিত্য-গোষ্ঠী সৃষ্টি হয়। এঁরা প্রায় নিয়মিতভাবে দিনেশচন্দ্রের পটুয়াতলা লেনের বাড়ীটি নির্দিষ্ট ছিল। এই পত্রিকার সূত্রে 'চার শিল্পী-গোষ্ঠী' কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছিল। বাংলা সাহিত্যের ক্রমবিবর্তনের ধারায় এই পত্রিকা যে বাংলা সাহিত্যের অধ্যায়টি রচনা করেছিল, তা 'কল্লোল সাহিত্য যুগ' নামে অভিহিত করা হয়। এই ধারার অনুসরণে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলো হলো উত্তরা (১৯২৫), প্রগতি (১৯২৬) এবং কালিকলম (১৯২৬)।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে ২৪ নভেম্বর (বৃহস্পতিবার, ৮ আশ্বিন ১৩৩২) পত্রিকার অন্যতম সংগঠক ও সহ-সম্পাদক গোকুলচন্দ্র নাগ, দার্জিলিং-এ মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে পত্রিকার মূল দায়িত্ব এসে পড়েছিল
সম্পাদক ছিলেন দীনেশরঞ্জন দাশের উপর

১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে কল্লোল পত্রিকা'র সাথে সম্পর্কিত কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠীর দীনেশরঞ্জন দাশ ও মুরলীধর বসুর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই সূত্রে অনেকেই কল্লোল গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে 'কালিকলম' নূতন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের ‌এপ্রিল মাসে। প্রথম বছরে সম্পাদক ছিলেন মুরলীধর বসু, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় এবং প্রেমেন্দ্র মিত্র।

পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৩০ বঙ্গাব্দের ১লা বৈশাখে (এপ্রিল ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দ)। সে সময় পত্রিকার অফিস ছিল ১০/২ পটুয়াটোলা লেনের দীনেশরঞ্জনের মেজদাদা বিভুরঞ্জনের দু'কামরার বাড়ি। ১৩৩১ বঙ্গাব্দের  ভাদ্র মাসে এর অফিস ২৭নং কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে স্থানান্তরিত হয়েছিল। তবে বছর দেড়েক পরেই আবার পুরানো ঠিকানায় ফিরে এসেছিল| সে সময় আমহার্স্ট স্ট্রিট ও বিবেকানন্দ রোডের সংযোগ স্থলের কাছে দীনেশরঞ্জন তার এক বন্ধুর প্রেসে ‘কল্লোল’ ছাপাবার ব্যবস্থা করেছিলেন| এরপর পত্রিকাটি বিভিন্ন ছাপাখানায় ছাপা হয়েছে। এই ছাপাখানাগুলো ছিল- ১১১/৪ মানিকতলা ষ্ট্রিটের কোহিনূর প্রেসে, ৩৩-এ মদন মিত্র লেনের বাণী প্রেসে, ২-এ অক্রুর দত্ত লেনের রহস্য লহরী প্রেসে, ২৯-এ রামকান্ত মিস্ত্রী লেনের ক্যালকাটা প্রিন্টিং ওয়ার্কসে।

এই পত্রিকাটি প্রকাশের পর, বিপুলভাবে আদৃত এবং নিন্দিত হয়েছিল। বিশেষভাবে সেকালের বিখ্যাত পত্রিকা 'শনিবারের চিঠি'র সাথে বহুদিন সাহিত্য লড়াই চলেছিল। এই সাহিত্যযুদ্ধে রবীন্দ্রনাথও জড়িয়ে পড়েছিলেন। তবে এই কল্লোল সাহিত্য গোষ্ঠীকে বিশেষভাবে শক্তি যুগিয়েছিলেন
প্রেমেন্দ্র মিত্র্, কাজনজরুল ইসলাম, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সাহিত্যিক।