হালাকু খান
মঙ্গোলীয়: Хүлэгу хаан; চাগাতাই: ہلاکو; ফার্সি: هولاکو خان; চীনা: 旭烈兀;
(১২১৮ – ১২৬৫
খ্রিষ্টাব্দ)
মঙ্গোলীয় শাসক।
হালাকু খান ছিলেন
চেঙ্গিশ খানের অন্যতম পুত্র
তোলুই খানের
সন্তান। আরিক বোকে,
মঙ্গ্কে খান
ও কুবলাই
খান ছিলেন তার ভাই। ১২১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি জন্মগ্রহণ
করেন
তার বাহিনী মঙ্গোল সাম্রাজ্যের দক্ষিণপশ্চিম অংশ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করেছে। তারা
পারস্যের ইলখানাত স্থাপন করে। তার নেতৃত্বে মঙ্গোলরা মুসলিম ক্ষমতার কেন্দ্র বাগদাদ
ধ্বংস করে। বাগদাদের ধ্বংসের ফলে মামলুক শাসিত কায়রো মুসলিম বিশ্বের কেন্দ্র হয়ে
উঠে।
তার মা সোরগাগতানি
বেকি ছিলেন একজন প্রভাবশালি কেরাইত শাহজাদি। সোরগাগতানি ছিলেন একজন নেস্টরিয়ান
খ্রিষ্টান। হালাকু খানের স্ত্রী দকুজ খাতুন এবং তার ঘনিষ্ট বন্ধু ও সেনাপতি
কিতবুকাও খ্রিষ্টান ছিলেন। মৃত্যুর আগমুহূর্তে হালাকু খান বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন
বলে জানা যায়।
হালাকু খানের ভাই
মঙ্গ্কে খান ১২৫১ খ্রিষ্টাব্দে খাগান হন।
১২৫৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি হালাকুকে দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ার
মুসলিম অঞ্চল জয়ের জন্য প্রেরণ করেন।
আবাকা খান ১২৬৫ থেকে ১২৮২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত পারস্যের দ্বিতীয় ইলখান ছিলেন। এরপর তাকুদার
১২৮২ থেকে ১২৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইলখান ছিলেন।
তারাকাইয়ের পুত্র বাইদু ১২৯৫ খ্রিষ্টাব্দে ইলখান হন।
১৫শ শতাব্দীর ইতিহাসবিদ মীর খাওয়ান্দ আরো দুই সন্তানের নাম উল্লেখ করেছেন তারা
হলেন হিয়াক্সামাত ও তানদুন। হিয়াক্সামাত প্রথমে আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এবং
তানদুন দিয়ারবাকির ও ইরাকের গভর্নরের দায়িত্বে ছিলেন।
হালাকু খানের অভিযানের সময় হাসাসিনদের ধ্বংস করা হয় এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন
হয়। এই সময় মঙ্গ্কে খানের আদেশে সাম্রাজ্যে দুই-দশমাংশ
যোদ্ধা হালাকুর বাহিনীতে যোগ দেয়। তিনি
লুরদের পরাজিত করেন। আলামুতের হাসাসিনরা বিনাযুদ্ধে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল।
১২৫৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে হালাকু
খানের বাহিনী বাগদাদের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শহরের কাছে পৌছে তিনি তার
বাহিনীকে বিভক্ত করে দজলা নদীর পূর্ব ও পশ্চিম তীরে অবস্থান নিতে নির্দেশ দেন।
হালাকু খান আত্মসমর্পণ দাবি করলে খলিফা আল-মুসতাসিম তা ফিরিয়ে দেন।
১২৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ জানুয়ারি চীনা সেনাপতি গুয়ো
কানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা শহর অবরোধ করে। পরে খলিফা
আলোচনার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করার প্রস্তাব রাখেল মঙ্গোলরা
সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ১০ ফেব্রুয়ারি বাগদাদ
আত্মসমর্পণ করে। ১৩ ফেব্রুয়ারি মঙ্গোলরা শহরে ঝাপিয়ে ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করে।
বাগদাদের বাইতুল হিকমাহ ধ্বংস করে দেয়া হয়। ফলে চিকিৎসাসহ নানা বিষয়ের উপর লিখিত
অগণিত বই ধ্বংস হয়ে যায়। কথিত আছে বেঁচে যাওয়ারা জানায় যে বই নদীতে ফেলে দেয়ার কারণে
দজলা নদীর পানি কালির কারণে কালো হয়ে গিয়েছিল। ধারণা করা হয়,
হালাকু খানের বাহিনী বাগদাদের ২,০০,০০০ থেকে ১০,০০,০০০
মানুষ হত্যা করেছিল। একই সাথে প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন-সহ. মসজিদ, প্রাসাদ,
গ্রন্থাগার, হাসপাতাল ইত্যাদি মঙ্গোলরা ধ্বংস করে দেয়। খলিফাকে বন্দী করা হয়।
মার্কো পোলোর ভ্রমণকাহিনীতে থেকে পাওয়া যায়, এরা বন্দী
খলিফাকে অভুক্ত রেখে মেরে ফেলেছিল। মুসলিম
ঐতিহাসিকদের বিবরণে জানা যায়, খলিফাকে কম্বলে মুড়ে তার উপর ঘোড়া চালিয়ে দেয়া হয়েছিল।
বাগদাদের এই ঘটনার পর অন্যান্য ক্ষুদ্র রাজ্যগুলি
হালাকুর অধীনতা স্বীকার করে নেয়।
১২৫৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সিরিয়ায়
অভিযান চালান। ১২৬০ খ্রিষ্টাব্দে
মোঙ্গলদের সাথে খ্রিষ্টান সিলিসিয়ার আর্মেনীয় এবং
ফ্রাঙ্করা যোগ দেয়। এই বাহিনী আইয়ুবীয় শাসিত সিরিয়া জয় করে। ১২৬০
খ্রিষ্টাব্দে তারা আলেপ্পো দখল করে। সেই
বছরের ১ মার্চ খ্রিষ্টান সেনাপতি কিতবুকা দামেস্ক অবরোধ করেন।
এই অভিযানে আইয়ুবীয় সুলতান আন-নাসির
ইউসুফকে হালাকু খান।
এরপর মামলুকদের সাথে লড়াই করার জন্য হালাকু খান
ফিলিস্তিনের মধ্যে দিয়ে কায়রো যাওয়ার
মনস্থির করেন। তিনি মামলুক সুলতান কুতুজকে একটি চিঠি লিখে আত্মসমর্পণ করতে বলেন এবং
না করলে বাগদাদের মত কায়রো ধ্বংস করে দেয়া হবে বলে হুমকি দেন। তবে সেসময়
মঙ্গ্কে খানের মৃত্যুর খবর পৌছার ফলে হালাকু খান নতুন খাগান হিসেবে উত্তরসূরি নির্বাচনের
জন্য মঙ্গোলিয়া ফিরে যান। এসময় তিনি কিতবুকার অধীনে প্রায় ২০,০০০ সৈনিক রেখে
গিয়েছিলেন। সুলতান কুতুজ এরপর একটি বাহিনী নিয়ে ফিলিস্তিনের দিকে অগ্রসর হন।
বাইবার্স এসময় তার সাথে যোগ দেন। মোঙ্গলরা এসময় আক্কা কেন্দ্রিক ক্রুসেডার জেরুজালেম রাজ্যের অবশিষ্ট অংশের সাথে
মিলে ফ্রাঙ্কিশ-মঙ্গোল জোট গঠন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু পোপ চতুর্থ আলেক্সান্ডার
এতে স্মমতি দেন নি। এছাড়া সাইদার শাসক জুলিয়ানের কারণে কিতবুকার এক নাতির মৃত্যুর
ফলে দুই পক্ষে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। রাগান্বিত হয়ে কিতবুকা সাইদা আক্রমণ করেন।
আক্কার ব্যারনের সাথে মামলুক ও মঙ্গোল উভয় পক্ষ যোগাযোগ করে। মামলুকরা ফ্রাঙ্কদের
পুরনো শত্রু হলেও ফ্রাঙ্করা মোঙ্গলদের সাথে হাত না মিলিয়ে মামলুকদেরকে ক্রুসেডার
এলাকার মধ্য দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ দেয়।
মোঙ্গলদের অগ্রসর হওয়ার খবর পাওয়ার পর সুলতান কুতুজ তাদের মোকাবেলা করার জন্য আইন
জালুতের দিকে অগ্রসর হন। এখানে দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ সংঘটিত হয়।
বাইবার্স যুদ্ধে হিট-এন্ড-রান কৌশল ব্যবহার করেছিলেন যাতে মোঙ্গলরা পালিয়ে যাচ্ছে
ভেবে মামলুকদের অনুসরণ করে। বাইবার্স ও কুতুজ পাহাড়ের আড়ালে নিজেদের সেনাদের
লুকিয়ে রাখেন। মোঙ্গল সেনাপতি কিতবুকা মামলুকদের অনুসরণ করেন এবং বাহিনীর পুরো
শক্তি নিয়ে তাদের উপর ঝাপিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তারা মামলুকদের আক্রমণের
সীমানায় এসে পড়ার পর আক্রমণের সম্মুখীন হয়। যুদ্ধে সেনাপতি কিতবুকাসহ অধিকংশ
সৈনিক নিহত বা বন্দী হয়। যুদ্ধে মোঙ্গলদের পরাজয়ের ফলে পূর্ব ও দক্ষিণে তাদের
অভিযান থেমে যায়।
খাগান হিসেবে কুবলাই খানের ক্ষমতাপ্রাপ্তির পর ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে হালাকু খান আইন
জালুতের পরাজয়ের বদলা নেয়ার জন্য তিনি মনস্থির করেন। একই সময় তিনি বাতু খানের
ভাই বারকা খানের সাথে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। বারকা খান ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন এবং
হালাকু খান বাগদাদ ধ্বংস করার কারণে তার উপর বিরূপ হন। বারকা খান মামলুকদের সাথে
মিত্রতা স্থাপন করেন। তিনি নোগাই খানকে হালাকুর অঞ্চলে অভিযানের জন্য প্রেরণ
করেছিলেন। ১২৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ককেসাসের উত্তরে একটি অভিযানের সময় হালাকু খান পরাজিত হন। এটি
ছিল মঙ্গোলদের মধ্যকার প্রথম উন্মুক্ত যুদ্ধ।
মুসলিমদের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্ক-মঙ্গোল মৈত্রী গঠনের জন্য হালাকু খান বেশ কয়েকবার
ইউরোপের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ১২৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
তার সচিব রাইকাইদাসকে ইউরোপ পাঠান। তবে সিসিলির রাজা মেনফ্রেড তাদের বন্দী করেন।
মেনফ্রেডের সাথে মামলুকদের মিত্রতা ছিল এবং তিনি পোপ চতুর্থ আরবানের সাথে দ্বন্দ্বে
লিপ্ত ছিলেন। এরপর রাইকাইদাস ফিরে আসেন।
১২৬২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই এপ্রিল জন দ্য হাঙ্গেরিয়ানের মাধ্যমে ফ্রান্সের নবম লুইয়ের কাছে
মিত্রতা স্থাপনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি পাঠান। হালাকু খান এতে লিখেন যে তিনি পোপের লাভের জন্য জেরুজালেম দখল করতে
চান এবং মিশরের বিরুদ্ধে লুইয়ের কাছে নৌবহর পাঠানোর আবেদন করেন। তবে এসকল চেষ্টা
সত্ত্বেও দুইপক্ষে মৈত্রী স্থাপিত হয়নি।
১২৬৫ খ্রিষ্টাব্দে উর্মিয়া হ্রদের শাহি দ্বীপে মৃত্যু বরণ করেন।
উল্লেখ্য হালাকু খানের কমপক্ষে তিনজন সন্তান ছিল। এঁরা
হলেন আবাকা খান, তাকুদার ও তারাকাই। এদের ভিতরে এরপর রাজত্ব লাভ
করেছিলেন সন্তান
আবাকা খান।