১৮২০ খ্রিষ্টাব্দে (আনুমানিক) ফৈজাবাদের এক আফ্রিকান বংশোদ্ভুত
দাস পরিবারে জন্মগ্রহণ। তাঁর পারিবারিক নাম মোহম্মদি খানম। পিতার নাম মীর গুলাম হুসেন। তাঁর গায়ের রঙ ছিল কালো। কিন্তু মুখশ্রী এবং অঙ্গসৌষ্ঠবের বিচারে
তিনি ছিলেন অসাধারণ সুন্দরী। তাঁর পিতা-মাতা যে মালিকের অধীনে দাস হিসেবে কাজ করতেন, সম্ভবত সেখানেই তিনি নাচের প্রাথমিক
পাঠ নিয়েছিলেন এবং হয়তো সে সময়ে নর্তকী হিসেবে কিছুটা খ্যাতিও পেয়েছিলেন। আর্থিক সঙ্কটের কারণে, তাঁর পিতা
কিশোরী মোহাম্মদি খানমকে অওধ রাজদরবারে নর্তকী হিসেবে বিক্রয় করে দেন।
রাজদরবারে আসার পর তাঁর নাচে আরও পারদর্শিনী হয়ে ওঠেন। এই সময় এক নাচের আসরে ওয়াজেদ
আলী তাঁর সৌন্দর্য এবং নৃত্যে মুগ্ধ হন। অন্দরমহলে তখন ‘মাহাক পরি’ বা সৌন্দর্যের পরি
নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। ওয়াজেদ আলীর আত্মজীবনীমূলক কবিতা ও চিত্র সঙ্কলন ‘ইশক-নামা’ থেকে জানা যায়, এই ‘কালো মেয়ে’র প্রতি নবাবের বেশ দুর্বলতা ছিল। হজরত মহলের রূপের প্রশংসাও
তিনি করেছেন।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দে
ওয়াজেদ আলী মোহম্মদি খানমকে বিবাহ করেন। বিবাহের পর তাঁর নতুন নাম হয়-
বেগম হজরত মহল। এঁদের একমাত্র পুত্র বিরজিস কদরের জন্ম হয় ১৮৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ২০
আগষ্ট (বৃহস্পতিবার ৫ ভাদ্র ১২৯২)।
১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াজেদ আলী শাহ
অওধের নবাব হিসেবে দায়িত্ব পেলে, হজরত মহলের প্রভাব প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। নিচে
নৃত্যশিল্পী ছিলেন, তাই লখনৌর দরবারের সঙ্গীতচর্চা উচ্চতর পৌঁছেছিল।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে
ওয়াজেদ আলী শাহএর
রাজ্য ব্রিটিশরা অধিকার করে নেয়। এই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশদের এই আদেশ
কার্যকর হয়। ইংরেজরা তাঁর একটি মাসোয়ার বরাদ্দ করেছিল। এই ঘটনা ঘটার পর,
ওয়াজেদ আলী শাহহারানো
রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তৎকালীন ভারতে
রাজধানী কলকাতায় আসার উদ্যোগ নেন। তিনি মনে করেছিলেন- যদি কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের
মন গলাতে না পারেন, তা হলে- ইংল্যান্ডে গিয়ে রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন করবেন।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ই মার্চ লখনৌ ত্যাগ করেন এবং ৬ মে
কলকাতার
মেটিয়াবুরুজে অস্থায়ীভাবে জীবনযাপন শুরু করেন।
ওয়াজেদ আলীর মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর
সহযোগীরা রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য, লণ্ডনে যান এঁরা রানি ভিক্টোরিয়ার সাথে যোগাযোগ
করার উদ্যোগ নেন। এই সময় হজরত মহল লখনৌতে থেকে যান এবং লখনৌর রাজদরবারকে সজীব রাখেন।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ (রবিবার, ১৭ চৈত্র ১২৬৩), কলকাতার বারকাপুরে
মঙ্গলপাণ্ডের নেতৃত্বে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ করে। পরে এই
বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ইতিহাসে এই বিদ্রোহটি
সিপাহি বিপ্লব নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এর ফলে ব্রিটিশ-জনমত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে
চলে যায়। এদিক লখনৌতে বেগম হজরত মহল, জুন মাসের প্রথম দিকে তাঁর ছেলে বিরজিস কদরকে
নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। এই সময় বিরজিস কদরের বয়স ছিল মাত্র ১৪
বৎসর। যদিও এর সাথে ওয়াজেদ আলীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে
ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে ঘোষণা দেন, এই ভয়ে ওয়াজেদ আলীকে তাঁর অস্থায়ী বাসস্থান
মেটিয়াবুরুজের থেকে গ্রেফতার বন্দী করে
ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা রাখা হয়।
বেগম হজরত মহল স্থানীয় বিদ্রোহী এবং নিজের অনুগত সৈন্যদের নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা
বাহিনী তৈরি করেন। ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ জুন (মঙ্গলবার, ১৭ আষাঢ় ১২৬৪), লখনৌ শহরের অদূরে যুদ্ধে
ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে বেগম হজরত মহলের সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে
ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়। এর হজরত মহল লখনৌকে স্বাধীন রাজ্য হিসেবে ঘোষণা দেন।
প্রাথমিক সাফল্যের পর, বেগম তাঁর পুত্র বিরজিস কদরের নামে একের পর এক ঘোষণা জারি করেন। ইংরেজদের এই মাটিতে আর ঘাঁটি গাড়তে না দেওয়ার শপথ নেন।
একই সাথে ইংরেজদের নানা ছল-চাতুরি কথা সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন। হজরত মহলকে সাহায্য করার জন্য একটি বিশেষ দল গঠন করা
হয়েছিল। এই সময় শরাফ-উদ-দৌলা দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলে প্রধানমন্ত্রী এবং ওয়াজিদ আলি শাহ-র বিশ্বস্ত রাজা বালকৃষ্ণ হয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাজা জয়লাল সিংহকে। বিদ্রোহী সৈন্যদের যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে উমরাও সিংহ, রঘুনাথ সিংহ, রাজমুণ্ড তেওয়ারি ও ঘামাণ্ডি সিংহকে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন শাখার প্রধান করা হয়েছিল। রাজা ব্রিজিস কদর মুঘল বাদশা বাহাদুর শাহ জাফরকে তাঁর সম্রাট বলে মেনে নিলেন। তীরন্দাজ গুরু বখশ, নবাব আলি খানদের নিয়ে পরিকল্পনায় বসলেন তিন মূর্তি—রাজা জয়লাল সিংহ,
মৌলবি আহমদুল্লাহ শাহ ও মাম্মু খান। এই সময়ে হজরত মহলের অধীনস্থ সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৩৬ হাজার।
১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে ইংরেজর সৈন্যরা অধিকাংশ অঞ্চলের বিদ্রোহ দমন করতে
সক্ষম হয়। এ্ই সময়
লখনৌর কাছে আলমবাগ প্যালেসে জেমস উট্রাম-এর নেতৃত্বে ইংরেজদের একটা ঘাঁটি তৈরি করেছিল।
বিপ্লবী বাহিনী এই ঘাটি দখল করতে সক্ষম হয় নি। এই ঘাঁটকে ব্যবহার করে কলিন ক্যাম্পবেল উন্নত সামরিক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অওধ আক্রমণ করেন। বেগম হাতির পিঠে সামনে থেকে লড়াই চালিয়ে যান।
চিনহাট যুদ্ধের বীর বরকত আহমেদ পাথরওয়ালি-বারাদারিতে ব্রিজিস কদরের মাথায় রাজমুকুট
পরিয়েছিলেন।
এই সময় এই যুদ্ধে বিপ্লবী আহমদুল্লাহ ও নানাসাহেব একযোগে ইংরেজদের বিরুদ্ধে
করেছিলেন। যুদ্ধে আহমদুল্লাহ নিহত হন। এই সময় অর্থের লোভে রাজা লালমাধব সিংহ ও বেণীমাধব বিশ্বাসঘাতকতা
বেগমের সাথে বিশ্বাসঘতকতা করেন। ফলে বেগমের সেনার মনোবলও ভেঙে পড়ে। তবুও তিনি প্রায় এক বছর ধরে প্রতিরোধের লড়াই চালিয়ে
গিয়েছিলেন। পরে তিনি এবং তাঁর পুত্র বিরজিস কদরকে সাথে নিয়ে নেপালের কাঠমান্ডুতে আশ্রয় নেন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ এপ্রিল নেপালের কাঠমাণ্ডুতে মৃত্যুবরণ করেন।