তারপরেও কোথাও কোথাও ব্রিটিশদের উস্কানিতে সাম্প্রদয়িক সৃষ্টি হলে, তা
নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়েছেন। ইতিহাসবিদ সর্বপল্লী গোপালের লেখা থেকে জানা যায়, ১৮৫৫
খ্রিষ্টাব্দে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময় অযোধ্যায় অবস্থিত হনুমান গঢ়ী মন্দিরকে রক্ষা করেছিলেন
রক্ষা করেছিলেন ওয়াজেদ আলী।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তার রাজ্য ব্রিটিশরা অধিকার করে নেয়।
এই বছরের ৭ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশদের এই আদেশ কার্যকর হয়। ইংরেজরা তাঁর একটি মাসোয়ার বরাদ্দ
করেছিল। এই ঘটনা ঘটার পর, ওয়াজেদ হারানো রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য ইংরেজদের সাথে
সুসম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তৎকালীন ভারতে রাজধানী কলকাতায় আসার উদ্যোগ নেন। তিনি
মনে করেছিলেন- যদি কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের মন গলাতে না পারেন, তা হলে- ইংল্যান্ডে গিয়ে
রানি ভিক্টোরিয়ার কাছে আবেদন করবেন।
১৮৫৬ খ্রিষ্টাব্দের
১৩ই মার্চ লখনৌ ত্যাগ করেন। জাহাজে করে তিনি কলকাতায় পৌঁছেছিলেন ৬ মে। তাঁর বাসের
উপযোগী বাড়ির ব্যবস্থা করতে না পারায়, এক রাত্রি জাহাজেই কাটান। এই সময় হুগলি থেকে
২-৩ মাইল দূরে সম্ভ্রান্ত ইউরোপিয়দের ১৩টি বাগান বাড়ি ছিল। এর মধ্যে ১১ নম্বর বাড়ি
ছিল বর্ধমানের রাজা নবাব বাহাদুরের। তিনি ৫০০টাকার মাসিক ভাড়ার বিনিময়ে অযোধ্যার নবাবকে থাকতে দেন।
ওয়াজেদ আলীর মা বেগম আউলিয়া আর তাঁর সহযোগীরা রাজ্য ফিরে পাওয়ার জন্য, লণ্ডনে যান
এঁরা রানি ভিক্টোরিয়ার সাথে যোগাযোগ করার উদ্যোগ নেন। এই উদ্যোগ সফল হওয়ার আগেই, ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ (রবিবার, ১৭ চৈত্র ১২৬৩), কলকাতার বারকাপুরে মঙ্গলপাণ্ডের নেতৃত্বে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতীয় সেনারা বিদ্রোহ করে।
পরে এই বিদ্রোহ ভারতের বিভিন্ন সেনানিবাসে ছড়িয়ে পড়ে। উল্লেখ্য, ইতিহাসে এই
বিদ্রোহটি
সিপাহি বিপ্লব
নামে অভিহিত হয়ে থাকে। এর ফলে ব্রিটিশ-জনমত ভারতীয়দের বিরুদ্ধে চলে যায়। এদিক লখনৌতে
থাকে ওয়াজেদ আলীর বেগম
হজরত মহল, তাঁর ছেলে বিরজিস কদরকে নতুন নবাব ঘোষণা করে বিদ্রোহ
ঘোষণা করেন। এর সাথে ওয়াজেদ আলীর কোনো সম্পর্ক ছিল না। পাছে বিদ্রোহীরা জোর করে ওয়াজিদকে নেতা হিসাবে
ঘোষণা দেন, এই ভয়ে ওয়াজেদ আলীকে তাঁর অস্থায়ী বাসস্থান মেটিয়াবুরুজের থেকে গ্রেফতার
বন্দী করে
ফোর্ট উইলিয়ামে গৃহবন্দি করা রাখা হয়।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জুলাইয়ে দিকে
সিপাহি বিপ্লব-এর
সমাপ্তি ঘটে। প্রায় ২৫ মাস বন্দী দশায় ছিলেন। ১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই
মুক্তি পাওয়ার পর গার্ডেনরিচ-এ, ১১ নম্বর বাংলোতে ফিরে আসেন। তাঁকে বন্দী করে রাখার
বিষয়ে লর্ড ক্যানিং ভুল স্বীকার করেন এবং ১ লক্ষ টাকার মাসোহারা প্রদানের
সমঝোতায় নবাবকে ছোট্ট রাজ্য গড়ে তোলার অনুমতি দেন। গার্ডেনরিচের সাউথ-ইস্টার্ন রেলওয়ের হেডকোয়ার্টারের কাছে বি.এন. আর হাউস তার থাকার জন্য বরাদ্দ হয়, যা পরিখানা নামেই খ্যাত ছিল।
এরপর পুরানো বাড়িগুলো সংস্কার করে বা নতুন বাড়ি তৈরি করেন লখনৌর নির্মাণ শৈলীতে।
মেটিয়া বা মাটিয়াবুরুজ-এর আক্ষরিক অর্থ হলো- মাটির কেল্লা। ওয়াজেদ আলীর প্রাসাদ তৈরি
হয়েছিল কাঁচা ইট দিয়ে। তাই এর এরূপ নামকরণ করা হয়েছিল।
১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তৈরি
করেছিলেন ইমামাবাড়া। মৃত্যুকালে ২৫৭ বিঘা জমি এবং ১৯ টি বাড়ি ছিল নবাবের।
ওয়াজেদ আলী'র মাসোয়ারা নির্ধারিত হয়েছিল ১ লক্ষ টাকা। তিনি একটি ছোট রাজত্ব গড়ে
তুলেছিলেন। এই রাজত্বের প্রজা সংখ্যা ছিল প্রায় ৬ হাজার। সাথে ছিল ৩৭৫ জন স্ত্রী। এছাড়া ছিল- সভাসদ, পাইক এবং বহু সঙ্গীতশিল্পী।
নবাবের সেবা ও রক্ষার জন্য ছিল ৫০ জন আফ্রিকার দাস, ২৪৫ জন ‘বিশেষ রক্ষী’, ১২০ সশস্ত্র রক্ষী, ২০ জন দণ্ডবাহী, ১৮ জন খোজা। এ ছাড়াও ছিল কসাই, কামার, কুমোর, রসুইকর, জমাদার, ধোপা, নাপিত, ঘণ্টাপিটাই
ইত্যাদি পেশার বহু মানুষ।
তাঁর সঙ্গীতসভার জন ছিল ২৪ জন নটনটী, খাস মঞ্জিলের ১১ জন শিল্পী ছাড়াও
নকিওয়ালিয়াঁ বা ভাঁড়, তামাশাওয়ালিয়াঁ এবং মুহুররমে আবৃত্তিকার মারসিয়া দল। নাটকের
দলে ছিল ২১৬ জন নটনটী। গায়কের সংখ্যা ছিল ১৪৫ জন।
১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে ওয়াজিদ আলি স্বয়ং নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন।
সেই সাথে ঠুমরিও শোনান। উল্লেখ্য, নবাব নিজে কত্থক শিখেছিলেন মহারাজ ঠাকুর প্রসাদজীর কাছে।
ওয়াজেদ আলী তাঁর এই নির্বাসিত বাসস্থানকে ভারতীয় সঙ্গীত ও নাট্যচর্চার লীলাভূমিতে
পরিণত করেছিলেন । সে সময় সঙ্গীতের টানে
মেটিয়াবুরুজে সেকালের সকল বিখ্যাত সঙ্গীতগুরু এবং শিল্পীদের আগ্রহের জায়গা হয়ে
উঠেছিল। লখনৌর ঠুমরি খোদ লখনৌতে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে যখন নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল, তখন
মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ঠুমরি গানের লীলাভূমি। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ঠুমরি
শিল্পীরা মেটিয়াবুরুজের ডাকের অপেক্ষায় থাকতেন। নবাব নিজে ঠুমরি গাইতেন এবং নিজেও
গান রচনা করতেন। ‘আখতারপ্রিয়া’ ছদ্মনামে তিনি একাধিক ঠুমরি রচনা করেন। হেকিম মোহাম্মদ করিম ইমামের 'মাদুল মুসকি’ গ্রন্থে এর বিস্তারিত বিবরণ আছে। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয় যা মেটিয়াবুরুজ থেকে ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে।
শোনা যায় সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজ যেতেন লখনউ ঠুমরির টানে।
অন্যদিকে ওয়াজিদ আলির দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র।
ধ্রুপদী ধারার কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের এই কেন্দ্রে হামেশাই আসতেন যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী।
নবাব নিজে সেতার শিখেছিলেন ওস্তাদ কুতুব আলী খানের কাছে। শোনা যায় মেটিয়াবুরুজে রবাব ও সুরশৃঙ্গার যন্ত্র দুটির
প্রচলন করেছিলেন তিনি। ওয়াজিদের আহ্বানে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দরবারে সুরবাহার বাজিয়েছিলেন।
কথিত আছে এই দরবারেই ওস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর তিনি ওয়াজিদ আলির কাছে ছিলেন। ওয়াজিদ তবলা, সানাই, এসরাজকে
কলকতায় জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন।
১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি
সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই
আছে।
তিনি একটি চিড়িয়াখানা তৈরি করেছিলেন। এই চিড়ায়াখানায় ছিল বাঘ, সিংহ, চিতা ইত্যাদি
মিলিয়ে ২৩টি পোষা প্রাণী। অনেকের মতে কবুতর ছিল প্রায় ২৪ হাজার। এই চিড়িয়াখানার
পিছনে মাসে খরচ হতো প্রায় ৯ হাজার টাকা।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার, ৬ আশ্বিন ১২৯৪) কলকাতার
মেটিয়াবুরুজে মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: