ইবরাহীম খাঁ
(ফেব্রুয়ারি ১৮৯৪ - ২৯ মার্চ ১৯৭৮)
প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক।
১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইল জেলার তৎকালীন
ভুঞাপুর থানার অন্তর্গত বিরামদী (বর্তমানে শাবাজনগর) গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম শাবাজ খাঁ
এবং মায়ের নাম রতন খানম।
১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ইব্রাহিম খাঁ, জামালপুরের সরিষাবাড়ির পিংনা উচ্চ বিদ্যালয়ে
ভর্তি হন। ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই স্কুল থেকে এন্ট্রাস পাশ করেন। এরপর তিনি
ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হন এবং ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে এফ এ
পরীক্ষায় পাশ করেন। এরপর তিনি উচ্চতর শিক্ষার জন্য কলকাতা আসেন এবং কলকাতার সেন্ট
পলস সিএম কলেজে ভর্তি হন। ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে এই কলেজ থেকে তিনি ইংরেজিতে অনার্সসহ
বিএ পাস করেন। এরপর তিনি আইন নিয়ে লেখাপড়া করেন এবং ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে আইন পাস
করেন।
১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রাইভেট পরীক্ষার্থী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে
এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। এই বছরেই তিনি
করটিয়া হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন।
১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় কংগ্রেস পার্টিতে যোগদান করেন। এই সূত্রে তিনি
ব্রিটিশ ভারতে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের (১৯২০-১৯২২) সময় তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ
করেন।
১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কিছুদিন ময়ময়নসিংহে ওকালতি শুরু করেন। ঐ সময় তিনি তরুণদের
সাহিত্য চর্চায় উদ্বুদ্ধ করার জন্য ময়মনসিংহে ‘আল হেলাল সাহিত্য সমিতি’ গঠন করেন।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে করোটিয়ার জমিদার
ওয়াজেদ আলী খান
পন্নীর অর্থ সাহায্যে
করোটিয়া সাদাত কলেজ
প্রতিষ্ঠিত হলে, ইব্রাহীম খাঁ এর প্রথম প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। এই সময়
থেকে তাঁর নামের পূর্বে প্রিন্সিপাল শব্দ যুক্ত হয়ে যায়।
১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কংগ্রেস পরিত্যাগ করে মুসলিম লীগে যোগদান করেন।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর আমন্ত্রণে অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী
আবুল কাশেম ফজলুল হক এই
কলেজটি পরিদর্শন করতে আসেন এবং কলেজের জন্যে মোটা অংকের অনুদান বরাদ্দ করেন। ওই
বছরই কলেজটি ডিগ্রি কলেজে উন্নীত করা হয়।
১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে মুসলীম লীগ থেকে মধুপুর-গোলাপপুর কেন্দ্র নির্বাচনে অংশ গ্রহণ
করেন এবং তিনি বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য হন। এই সময় তিনি করটিয়া সাদত কলেজ থেকে অবসর
গ্রহণ করেন।
১৯৪৭-১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সভাপতি এবং ১৯৪৮-১৯৫২
খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ছিলেন।
১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকায় ও ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে টাঙ্গাইলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার
সূত্রপাত হলে তিনি সর্বশক্তিতে দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেন।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সরকার তাকে ‘তঘমা-এ-কায়দে আযম’ খেতাব প্রদান করেন। পাক
বাহিনীর নৃশংসতার প্রতিবাদে তিনি তা পরে প্রত্যাখ্যান করেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে নাটাকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান
১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদক লাভ করেন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভূঞাপুর ‘সাহিত্য সংসদ’ গঠন করেন এবং একুশে পদকের সমুদয়
অর্থ ও কিছু জমি উক্ত সাহিত্য সংসদকে দান করেন।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে মার্চ তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তিনি ব্রিটিশ আমলে ‘খান সাহেব’ ও ‘খান বাহাদুর’ এবং পাকিস্তান আমলে
‘সিতারা-ই-ইমতিয়াজ’ উপাধি লাভ করেন। ইবরাহীম খাঁ স্মৃতিকথা,
শিক্ষা-সাহিত্য-ধর্ম-বিষয়ক প্রবন্ধ, নাটক, ভ্রমণ কাহিনী, রসরচনা, গল্প, উপন্যাস,
ইতিহাস ও জীবনচরিত, শিশু সাহিত্য, পাঠ্য বই ও অনুবাদ মিলিয়ে শতাধিক গ্রন্থ রচনা
করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-
- নাটক : কামাল পাশা (১৩৩৪), আনোয়ার পাশা
(১৩৩৭), ঋণ পরিশোধ (১৯৫৫), ভিস্তি বাদশা (১৯৫৭), কাফেলা।
- উপন্যাস : বৌ বেগম (১৯৫৮)।
- গল্পগ্রন্থ : আলু বোখরা (১৯৬০), উস্তাদ
(১৯৬৭), দাদুর আসর (১৯৭১), মানুষ, হিরকহার।
- স্মৃতিকথা : বাতায়ন (১৩৭৪)।
- ভ্রমণ কাহিনী : ইস্তাম্বুল যাত্রীর
পত্র (১৯৫৪), নয়া চীনে এক চক্কর, পাকিস্তানের পথে-ঘাটে।
- শিশু সাহিত্য : ব্যাঘ্র মামা (১৯৫১),
শিয়াল পণ্ডিত (১৯৫২), নিজাম ডাকাত (১৯৫০), বেদুঈনদের দেশে (১৯৫৬), ইতিহাসের
আগের মানুষ (১৯৬১), গল্পে ফজলুল হক (১৯৭৭), ছোটদের মহানবী, ছেলেদের শাহনামা,
ছোটদের নজরুল, গুলবাগিচা, নবী জীবনের ঝাণ্ডা বহিল যারা, তুর্কী উপকথা, নীল
হরিণ, সোহরাব রোস্তম ইত্যাদি।
- ধর্মবিষয়ক গ্রন্থ : মহানবী মুহাম্মদ,
ইসলামের মর্মকথা, ইসলাম সোপান, ছোটদের মিলাদুন্নবী।
- শিক্ষাবিষয়ক গ্রন্থ : আমাদের শিক্ষা
ব্যবস্থা, সংস্কৃতির মর্মকথা, নীতিকাহিনী।