কেদার রায়
১৫৬১-১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দ।
পূর্ব-বাংলার স্বাধীন বার ভুঁইয়াদের একজন।
১৫৬১ খ্রিষ্টব্দে বিক্রমপুর পরগণায়
জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষরা সেন শাসনামলের পঞ্চদশ শতাব্দীতে বিক্রমপুরের আড়া
ফুলবাড়িয়াতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। এই বংশের নিম রায় ছিলেন দেববংশীয় বঙ্গজ কায়স্থ। এই
বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ষাদব দে রায়ের পুত্র ছিলেন কেদার রায়। তাঁর অপর ভাইয়ের নাম ছিল
চাঁদ রায়।
কেদার রায়ের রাজ্য
এই দুই ভাইয়ের রাজধানী ছিল ঢাকার শ্রীপুর বা বিক্রমপুর। বর্তমানে দক্ষিণ বিক্রমপুর তথা শরীয়তপুর জেলার
অন্তর্গত কালীগঙ্গা নদীর তীরে এই রাজধানীর অবস্থান ছিল। মূলত কেদার রায় শাসন করতেন পদ্মার দুইপারের বিস্তীর্ণ জনপদ।
এঁদের রাজ্যের বিস্তার ছিল বিক্রমপুর, ইদ্রাকপুর, ইদিলপুর, কেদারপুর, চাঁদপুরের বৃহৎ অংশ জুড়ে। ইদিলপুরই
বর্তমানের বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলা। কালীগঙ্গা নদীর বুক দিয়ে পদ্মানদী প্রবাহিত হওয়ার
সময় কেদার রায়ের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাসমূহ পদ্মা নদীতে ভেসে গেছে। কেদার রায়ের রাজধানী শ্রীপুরের শেষচিহ্ন ১৯২৩
খ্রিষ্টাব্দে নদীতে বিলীন হয়। উল্লেখ্য শ্রীপুরের দক্ষিণে চণ্ডীপুরে ছিল কেদার রায়ের সবচেয়ে বড় যুদ্ধকুঠি।
মোগল বাহিনীর থেকে বিক্রমপুরের স্বাধীনতা বজায় রাখার জন্য শ্রীপুরে কয়েক মাইল দক্ষিণে কেদারপুরে তিনি প্রাসাদ নির্মাণ শুরু করেন।
এই প্রাসাদ সমাপ্ত হওয়ার আগেই- বর্তমান নড়িয়া উপজেলার ফতেহ্জঙ্গপুরে মোগলদের সাথে চতুর্থ যুদ্ধে কেদার রায় নিহত হন। তাঁর স্মৃতিচিহ্নকে কেন্দ্র করেই ফতেহ্জঙ্গপুর ও কেদারপুর গ্রামের নামকরণ হয়।
শরীয়তপুরে কেদার রায়ের প্রতিষ্ঠিত গ্রামের নাম ছিল রায়পুর। সেই গ্রামের নাম এখন পুটিজুরি।
বর্তামনে পাশের গ্রামে তাঁদের খনন করা দুটি বিশাল দীঘি রয়ে গেছে। এখানে দিগম্বরী দেবীর পূজা হয়। তাই এই দীঘিগুলোর বর্তমান নাম দিগম্বরীর দীঘি। দিগম্বরীর দীঘির একটু দূরেই
রয়েছে কিছু পোড়া ইটের বাড়ি। স্থানীয় লোকেরা বাড়িটাকে বলে ‘ভিয়া বাড়ি’।
কেদার রায়ের যুদ্ধ পরিচালনা
মোগল বিরোধিতার সূত্রে বাংলার অপর ভূঁইয়া
ঈসা খাঁয়ের সাথে কেদার রায়ের বন্ধুত গড়ে
উঠেছিল। এঁরা একসাথে আরাকান রাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয়ী হয়েছিলেন।
১৫৯৩ খ্রিষ্টাব্দে খাজা সুলায়মান লোহানীর সহযোগিতায় মুঘলদের কাছ থেকে
কেদার রায় ভূষণা দুর্গ দখল করেন। ১৫৯৬
খ্রিষ্টাব্দে দুর্জন সিংহের নেতৃত্বে
মোগল বাহিনী ভূষণা দুর্গ আক্রমণ করে। এই
আক্রমণের সময় দুর্গের অভ্যন্তরে কামানের গোলা বিস্ফোরণে সুলায়মান লোহানী নিহত হন এবং কেদার রায় আহত হয়ে সোনারগাঁওয়ে
ঈসা খাঁ নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন।
১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ঈশা খাঁ, কেদার রায়ের বিধবা কন্যা স্বর্ণময়ীকে অপহরণ করলে ক্রুদ্ধ কেদার রায় ঈসা খানের রাজধানী আক্রমণ করেন। কেদার রায়ের আক্রমণে ঈসা খান প্রাণভয়ে মেদিনীপুর পালিয়ে যান। কেদার রায় ঈসা খানের প্রায় সম্পূর্ণ জমিদারির দখল নিয়ে নেন।
পরে ঈসা খান অজ্ঞাত রোগে তার স্ত্রী ফাতেমা খানের বাড়ি ফুলহরি (ফুলদি) জমিদার বাড়িতে ১৫৯৯
খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে মারা যান।
১৬০২ খ্রিষ্টাব্দে মানসিংহ কেদার রায়ের বিরুদ্ধে এক বাহিনী প্রেরণ করে তাঁকে সম্রাট আকবরের আনুগত্য স্বীকারে বাধ্য করেন।
১৬০৩ খ্রিষ্টাব্দে
আরাকানের
রাজা বিশাল নৌবহর নিয়ে জলপথে ঢাকা অভিমুখে
আক্রমণ পরিচালনা করে এবং ত্রিমোহনীতে মুঘল দুর্গের ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। কিন্তু
মুঘল বাহিনী তাদের তাড়া করলে সংঘর্ষে বহুসংখ্যক মগ নিহত হয়। এ সময় কেদার রায় তাঁর
নৌবাহিনী নিয়ে মগদের সঙ্গে যোগ দেন এবং শ্রীনগরে মুঘল সেনাঘাঁটি আক্রমণ করেন।
বিক্রমপুরের অনতিদূরে দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে কেদার রায় আহত ও বন্দি হন।
মার্চ মাসে বন্দি অবস্থায় তাঁকে রাজা মানসিংহের কাছে নেওয়ার পরপরই তাঁর মৃত্যু হয়।