কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ।

১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গোবিন্দচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি উত্তর কলকাতার হোগলকুড়িয়ায় (ভীম ঘোষ লেন) শৈশব কাটান। তিনি প্রথম হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। পরে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দের দিকে পাইকপাড়া রাজা ঈশ্বরচন্দ্র ও প্রতাপচন্দ্র সিংহের বেলগাছিয়া থিয়েটারে অভিনয় দিয়ে শিল্প-সংস্কৃতির জগতে পা রাখেন। থিয়েটারে তিনি শর্মিষ্ঠা নাটকে নায়িকার (শর্মিষ্ঠা) ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। প্রথম অভিনয়ে তিনি দর্শকদের প্রচুর প্রশংসা পান। বিশেষ করে তাঁর সুরেলা কণ্ঠস্বরে সবাই মুগ্ধ হন। এই নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর। এরপর তিনি বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চের সঙ্গীত পরিচালক ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী'র কাছে সঙ্গীত শিক্ষা শুরু করেন।

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ মার্চ পাইকপাড়ার জমিদার ঈশ্বরচন্দ্র সিংহ মৃত্যুবরণ করলে, বেলগাছিয়া নাট্যমঞ্চের চিরদনের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু কৃষ্ণধন
ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী'র কাছে সঙ্গীত শিক্ষা চলতেই থাকে। এই কলেজ থেকে তিনি ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিয়ে পাশ করেন।

কলকাতার পাথুরিয়া জমিদার যতীন্দ্রমোহন ও শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর -এর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় 'পাথুরিয়া বঙ্গ নাট্যালয়'। এই দলের বিদ্যাসুন্দর নাটকে কৃষ্ণধন ' হীরা মালিনী' চরিত্রে অভিনয় করেন। এই নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়েছিল ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ ডিসেম্বর। হীরার চরিত্র রূপায়ণের সময় তিনি কয়েকটি গান পরিবেশন করেন।

১৮৬৫ বৎসর বয়সের দিকে দিনে গোয়ালিয়রে চলে যান। ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে কোলকাতায় ফিরে আসেন। এই বৎসরে তিনি 'বঙ্গৈকতান' নামক স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। বাংলা ভাষা তো বটেই যে কোন ভারতীয় ভাষায় এটাই ছিল মুদ্রিত আকারে প্রথম কোনো স্বরলিপি গ্রন্থ। তবে বেলাগাছিয়ায় একটি নাট্যশালা'র কনসার্ট-এর জন্য স্বরলিপি এর আগেই তৈরি করেছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। এই স্বরলিপিটি ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি তৈরি করেছিলেন। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর -এর উদ্যোগে ঐকতানিক স্বরলিপি নামে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ঐকবাদনের জন্য সৃষ্ট স্বরলিপি পদ্ধতিই পরবর্তী দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশের বিচারে কৃষ্ণধন এগিয়ে থাকলেও, প্রথম স্বরলিপি উদ্ভাবনের কৃতিত্ব ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-কেই  দেওয়া হয়।  উল্লেখ্য পাশ্চাত্য পদ্ধতির অনুসরণে তাঁর স্বরলিপিটি রেখামাত্রিক নামে অভিহিত হয়ে থাকে।

'বঙ্গৈকতান' প্রকাশের পর তিনি আবার গোয়ালিয়রে ফিরে যান। এই সময় কুচনিহারের মহারাজা রাজ্য স্ট্যাম্প অফিসার কর্নেল কটন-এর সাথে পরিচিত হন। এই সূত্রে তিনি কুচবিহারে চলে যান ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে। এই বৎসরে প্রকাশিত হয় সঙ্গীত বিষয়ক দুটি গ্রন্থ। এই গ্রন্থ দুটি হলো '
Hindusthan Airs arranged for the Piano Forte সঙ্গীত শিক্ষা

১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি কুচবিহারে কাটান। এরপর তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি পান। তাঁর কর্মস্থল ছিল দার্জিলিং।  ১৮৭২ থেকে ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এরই মধ্যে তাঁর চতুর্থ সঙ্গীত বিষয়ক গ্রন্থ সেতার শিক্ষা প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে।

ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি এবং সঙ্গীত সাধনা এই দুইয়ের টান-পোড়নে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় চলে আসেন ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে। কলকাতায় এসে তিনি তাঁর নিজস্ব ভাবনা অনুসারে একটি সঙ্গীত বিদ্যায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটতে তিনি তাঁর মনের মতো আগ্রহী শিক্ষার্থী না পেয়ে বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দেন। এই সময় তিনি আর্থিক সঙ্কটে পড়ে যান। তিনি এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য নাট্যজগতে কাজ করার চেষ্টা করেন। এই সূত্রে তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ভুবনমোহন নিয়োগীর কাছ থেকে তৎকালীন গ্রেট ন্যাশনাল থিয়েটার ইজারা নেন। কৃষ্ণধন এই মঞ্চের নাম পরিবর্তন করে নতুন নাম দেন 'ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল থিয়েটার'। এই মঞ্চে অভিনীত হয়েছিল মহেন্দ্রলাল বসুর 'পদ্মিনী', ;নীলদর্পণ', উপেন্দ্রনাথ দাস-এর 'শরৎ সরোজিনী', 'বৃত্রসংহার' ইত্যাদি। কৃষ্ণধনের ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতা ছিল না। চারমাসের মধ্যে তিনি ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়েন। ফলে, ভুবনমোহন নিয়োগী পুনরায় এই মঞ্চের দায়িত্ব গ্রহয়য় করেন। আর্থিক কারণে তিনি কলকাতা ত্যাগ করে আবার কুচবিহারে চলে যান।

১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে কুচবিহার এ্সটেটে কাজ শুরু করেন। এই নতুন চাকরিতে তাঁকে বেশি সময় দিতে হত না। সেকারণে তিনি সঙ্গীতের জন্য সময় ব্যয় করতে পারেতন। এখানকার দেওয়ানী আছিলদার রামচন্দ্র ঘোষ ছিলেন একজন সঙ্গীতজ্ঞ। এছাড়া রামচন্দ্র নাক একজন চৌকশ তবলাবাদক পেয়েছিলেন। এখানে থাকাবস্থায় তিনি তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ সঙ্গীতসূত্রসার রচনা করেছিলেন। ১৮৮৫ এবং ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে দুই খণ্ডে এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল কুচবিহার স্টেটের মুদ্রণযন্ত্রে। এক্ষেত্রে তাঁকে আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কুচবিহার স্টেটে চাকরির পর তিনি অবসর নেন। এই বৎসরেই কুচবিহার থেকে প্রকাশিত হয় তাঁর সর্বশেষ গ্রন্থ হারমোনিয়ম শিক্ষা

এরপর তিনি আসামের গৌরীপুরে চকলে যান।১৯০৪ খ্রিষ্টাব্দে গৌরীপুরেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

গ্রন্থাবলী

  • বঙ্গৈকতান । ১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দ।
  • Hindusthan Airs arranged for the Piano Forte, 1868
  • সঙ্গীত শিক্ষা। ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দ।
  • সেতার শিক্ষা। ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দ।
  • গীতসূত্রসার প্রথম খণ্ড । ১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দ
  • গীতসূত্রসার দ্বিতীয় খণ্ড । ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দ
  • হারমোনিয়ম শিক্ষা। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দ।

তথ্যসূত্র :
সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান (প্রথম খণ্ড)। জানুয়ারি ২০০২।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চ্চা। দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়।