ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী
(১৮২৩-১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দ)
বিষ্ণুপুর ঘরানা সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ এবং দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপির প্রবর্তক ।

১৮১৩ খ্রিষ্টাব্দে মেদিনীপুর জেলার চন্দ্রকোণা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম রাধাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ক্ষেত্রমোহনের পূর্ব-পুরুষরা কথক ছিলেন। এই কারণে তাঁর পিতা তাঁকে কথক বানানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই কারণে তিনি শৈশব থেকে একটু বড় হয়ে ওঠা পর্যন্ত পারিবারিকভাবে কথক-শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু সঙ্গীতের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখে, তাঁর পিতা তাঁকে বিষ্ণুপুরী ঘরানার পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর কাছে গান শেখার জন্য পাঠান। তারপর গুরুগৃহে থেকে তাঁর সঙ্গীতশিক্ষা শুরু হয়।

তিনি রামশঙ্কর ভট্টাচার্য- এর কাছে মূলত ধ্রুপদ শেখেন। তাঁর গীতগোবিন্দের স্বরলিপি (১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ) থেকে জানা যায়, জয়দেবের গীতাবলী থেকে গান শেখেন এই গুরুর কাছে। রামশঙ্কর ভট্টাচার্য-এর কাছে সঙ্গীতের পাঠ নেওয়ার পর তিনি গুরুর অনুমতি নিয়ে, সঙ্গীতকে পেশা হিসেবে গ্রহণের উদ্দেশ্য কলকাতায় আসেন। কলকাতায় এসে কলকাতার পাথুরিয়াঘাটার রাজা যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের সাথে পরিচিত হন। পরে তিনি এই সভায় সভা-গায়ক হিসেবে যোগদান করেন। এই সভাতে তিনি পরিচিত হন বারাণসীর বীণাকার লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্রের সাথে। লক্ষ্মীপ্রসাদের বীণা বাদন এবং সঙ্গীতে অগাধ জ্ঞান দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁর শিষ্যত্ব বরণ করেন। এই সময় লক্ষ্মীপ্রসাদ-এর অপর দুই ভাই সারদাসহায় এবং গোপালাপ্রসাদের কাছেও তিনি সঙ্গীতের পাঠ নেন। লক্ষ্মীপ্রসাদ-এর কাছে তিনি মূলত যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। তবে এর পাশপাশি তিন তাঁর কাছে ধ্রুপদও শেখেন।

যতীন্দ্রমোহনের সূত্রে তিনি পাইকপাড়ার রাজা প্রতাপচন্দ্র ও ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে পাইকপাড়ার রাজারা বেলাগাছিয়ায় একটি নাট্যশালা স্থাপন করেন। বেলগাছিয়া নাট্যাশালা'র প্রথম নাটক 'রত্নাবলী' অভিনয়ের জন্য তিনি ঐকতান বাদন প্রবর্তন করেন। এক্ষেত্রে তাঁকে বিশেষভাবে সহায়তা দান করেন যদুনাথ পাল নামক একজন সঙ্গীতজ্ঞ। আর এই ঐক্যতান বাদন তথা অর্কেস্ট্রার জন্য তিনি স্বরলিপি তৈরি করেছিলেন। বেলগাছিয়া নাট্যশালায় অভিনীত রত্নাবলীর সাথে সুর-সংযোগের সময় – যন্ত্রীরা ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী -কৃত স্বরলিপি সামনে রেখে বাজাতেন। সে সময় এই ঐক্যবাদনের নাম ছিল সেখানে 'কনসার্ট'। এই ঐকবাদনের জন্য সৃষ্ট স্বরলিপি পদ্ধতিই পরবর্তী দণ্ডমাত্রিক স্বরলিপি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। উল্লেখ্য ১৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৩ সেপ্টেম্বর 'রত্নাবলী' নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়।

১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাইকপাড়ার রাজা ঈশ্বরচন্দ্র সিংহের মৃত্যুর পর, বেলগাছিয়া নাট্যশালা বন্ধ হয়ে যায়। ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দে রাজা যতীন্দ্রমোহনের ছোট ভাই শৌরীন্দ্রমোহনের সহায়তায়, তাঁদের প্রাসাদে 'পাথুরিয়াঘাটা বঙ্গ-নাট্যালয়' প্রতিষ্ঠিত হয়। এই নতুন নাট্যালয়ের কনসার্টও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী-এর তত্ত্বাবধানে হতো। এই সময় কনসার্টের নাম পরিবর্তন করে 'ঐকতান' করা হয়।

১৮৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ক্ষেত্রমোহন লক্ষ্মীপ্রসাদ মিশ্র কলকাতায় সঙ্গীত সম্মেলনের আয়োজন করেন। এই আয়োজনকে সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য তিনি সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন।

১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর  প্রথম স্বরলিপি গ্রন্থ 'ঐকতানিক স্বরলিপি' প্রকাশিত হয়। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় সঙ্গীতসার কৃষ্ণধন বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত সঙ্গীতসূত্রসার প্রকাশের আগ-পর্যন্ত এই বইটি সে আমলের সঙ্গীতবিষয়ক শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর এবং কিছু সঙ্গীতগুণী কলকাতায় 'বঙ্গ সঙ্গীতবিদ্যালয়' স্থাপন করেছিলেন। ওই সঙ্গীত বিদ্যালয়ের প্রচার এবং সঙ্গীতশিক্ষার্থীদের সহায়তা দানের জন্য ' সঙ্গীত সমালোচনী ' নামক একটি পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পত্রিকাটির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। এই বৎসরেই প্রকাশিত হয় তাঁর করা গীতগোবিন্দের স্বরলিপি।

১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে শৌরীন্দ্রমোহন 'বেঙ্গল এ্যাকাডেমী অব মিউজিক' নামক সঙ্গীত শিক্ষকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই প্রতিষ্ঠানেও তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। শেষ বয়সে তিনি এই একাডেমী থেকে 'সঙ্গীত-নায়ক' উপাধি ও স্বর্ণ কেয়ুর পুরস্কার লাভ করেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

গ্রন্থাবলী
  • ঐকতানিক স্বরলিপি । ১৮৬৮ খ্রিষ্টাব্দ।
  • সঙ্গীতসার। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দ।
  • গীতগোবিন্দের স্বরলিপি। ১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দ।
  • কণ্ঠকৌমুদী ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দ।
  • আশুরঞ্জনী তত্ত্ব । ১৮৮৫।
তথ্যসূত্র :
সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান (প্রথম খণ্ড)। জানুয়ারি ২০০২।
হারমোনিয়াম ও সঙ্গীতশিক্ষা। শ্রীনেপালচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজেন্দ্র লাইব্রেরি।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চ্চা। দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায়।