রামশঙ্কর ভট্টাচার্য
(১৭৬১-১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দ)
বিশিষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ এবং বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা।

আনুমানিক ১৭৬১ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা গদাধর ভট্টাচার্য ছিলেন বিষ্ণপুর মহারাজার রাজসভার পণ্ডিত।

শৈশবে তিনি তাঁর পিতার কাছে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করেন। পরে তিনি সংস্কৃত ভাষা সাহিত্যে বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠেন। তাঁর সঙ্গীত শিক্ষকের নাম জানা যায় না। ধারণা করা হয় রাজসভার সঙ্গীত শিল্পীদের সঙ্গীত শুনে তিনি ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন। সঙ্গীতের প্রাথমিক পাঠ গ্রহণ করেছিলেন, পিতা গদাধরের কাছে। তবে উচ্চতর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠের সুযোগ ঘটেছিল জনৈক 'পণ্ডিতজী'র মাধ্যমে। এ বিষয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। ঘটনাটি ঘটে ঘটেছিল ১৭৮১-৮২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। কথিত আছে এই সময়ে আগ্রা-মথুরা অঞ্চলের এক সঙ্গীত গুরু তাঁর শিষ্যদের নিয়ে পুরীধামে যাচ্ছিলেন। এই সময় পথে দস্যুদের আক্রমণের ভয়ে এঁরা বিষ্ণুপুরে আসেন। এই সময় বিষ্ণুপুরের রাজা ছিলেন মল্লরাজবংশের ৫৬তম রাজা চৈতন্য সিংহ দেব (১৭৪৮-১৮০১)। বিষ্ণুপুরের রাজা চৈতন্যসিংহ এই দলকে তাঁর রাজদরবারের আমন্ত্রণ করেন। রাজা তাঁকে সভায় গান করার জন্য অনুরোধ করলে, তিনি পুরীতে গিয়ে পুরুষোত্তমকে গান না শুনিয়ে গান করবেন না এমন প্রতীজ্ঞার কথা জানান। তারপরেও রাজার বিশেষ অনুরোধে তিনি গান করেন। এরপর আগ্রার এই শিল্পী পুরীতে চলে চান। তবে তিনি রাজার কাছে অঙ্গীকার করেন যে, তিনি ফেরার পথে রাজসভায় আবার গান শোনাবেন। রাজসভার এই গান শুনেই রামশঙ্কর অত্যন্ত মোহিত হয়ে পড়েন এবং এই গান শেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেন। সভায় যা শুনেছিলেন, তার উপর ভিত্তি করে তিনি সঙ্গোপনে সঙ্গীতশিক্ষা শুরু করেন।

রাজার অনুরোধ রক্ষার জন্য আগ্রার শিল্পী পুরী থেকে ফেরার পথে বিষ্ণুপুরে আসেন। এবারে এই শিল্পী আসরে গান শুরুর আগে, রামশঙ্কর গান করার জন্য তাঁর পিতা গদাধরের কাছে অনুরোধ করলেন। গদাধর এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলে, রামশঙ্কর বারবার তাঁকে উত্যক্ত করতে থাকেন। একসময় গদাধর অতীষ্ট হয়ে রাজার কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন। রাজা সব শুনে রামশঙ্করকে গান করার অনুমতি দিলেন। পুত্রের গান সম্পর্কে তিনি এতটাই অজ্ঞ ছিলেন যে, রামশঙ্করের গান করার সময় তিনি সভা ত্যাগ করে চলে গিয়েছিলেন। যথাসময়ে রামশঙ্কর গান করলেন এবং শ্রোতাদের মুগ্ধ করতে সক্ষম হলেন। বিশেষ করে আগ্রার ওই শিল্পী বিশেষভাবে প্রশংসা করলেন। ওই শিল্পী বিষ্ণুপুরে কিছুদিন কাটান এবং তাঁর কাছে রামশঙ্কর গানের তালিম নেওয়া শুরু করেন। এরপর ওই গায়ক বিষ্ণুপুর ত্যাগ করলে, রামশঙ্কর বিষ্ণুপুর রাজসভার তিনি সঙ্গীত আচার্য পদ লাভ করেন। এই সময় বিষ্ণুপুরের রাজা চৈতন্যসিংহ তাঁকে ভূমি দান করে আর্থিক অভাব মোচনের ব্যবস্থা করে দেন। উল্লেখ্য রামশঙ্করের পরিবারিক সূত্রে জানা যায়, ওই সঙ্গীতশিক্ষকে রামশঙ্কর 'পণ্ডিতজী' নামে সম্বোধন করতেন। এই পণ্ডিতজীর কাছ থেকে তিনি ধ্রুপদের পাঠ নিয়েছিলেন। পরে তিনি হিন্দুস্থানী ভাষা ত্যাগ করে বাংলাতে ধ্রুপদ রচনা করেন এবং তা তাঁর শিষ্যদের শেখান। মূলত তাঁর সূত্রেই ভারতবর্ষের রাগসঙ্গীত জগতে বিষ্ণুপুরে ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল।

তিনি আবাসিক ব্যবস্থায় শিষ্যদের গান শেখানোর ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সূত্রে তিনি বেশ কিছু গুণী শিষ্য তৈরি করে যান। এঁদের ভিতরে উল্লেখযোগ্য ছিলেন — ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, যদুভট্ট,  অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়,  কেশবলাল ভট্টাচার্য প্রমুখ। তাঁর পুত্র মাধব ভট্টাচার্য প্রখ্যাত বীণাকার ছিলেন।

১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বিষ্ণুপুরে মৃত্যবরণ করেন।
তথ্যসূত্র :
সংসদ বাঙালি চরিতাবিধান (প্রথম খণ্ড)। জানুয়ারি ২০০২।
বাঙালির রাগসঙ্গীত চর্চা। দীলিপকুমার মুখোপাধ্যায়।