যদুভট্ট
(১৮৪০-১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে)
বিষ্ণুপুর ঘরানা সঙ্গীতশিল্পী ও সঙ্গীতজ্ঞ। 'তানরাজ', 'রঙ্গনাথ' 'সুরসেন' নামে প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন। পুরো নাম যদুনাথ ভট্টাচার্য।
 সঙ্গীতচিন্তা/গীতালি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ৩০ জুন, ১৯৪০, ১৬ আষাঢ়, ১৩৪৭, তারিখে কথিত বক্তৃতার অনুলেখন ...বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে, ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার একটা গুণ আছে-- তখনো কিছু শিখি নি, মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত "পলাতকা' ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি-- কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব'লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে-- অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি-- এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি। সেজদাদা শিখতেন বটে-- তিনি সুর ভাঁজছেন তো ভাঁজছেনই, গলা সাধছেন তো সাধছেনই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হয়তো বর্ষাকাল-- মেঘলা হয়েছে-- আমার তখন একটু কবিত্ব [জাগল]। তবু যা শুনতাম হয়তো মনে থাকত।...

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরের ভট্টপাড়া (বর্তমান বৈদিকপাড়া) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মধুসূদন ভট্টাচার্য ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরবাহার ও সেতারবাদক ছিলেন। তিনি রাজা নীলমণি সিংহের সভাগায়ক হয়েছিলেন।

দশ-এগারো বৎসর বয়সে তিনি তাঁর পিতার কাছে সেতার, সুরবাহার এবং পাখোয়াজে তালিম নেন। তিনি অত্যন্ত সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠ শুনে বিষ্ণুপুর ঘরানার আদি ধ্রুপদিয়া ৰ রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম দেওয়া শুরু করেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গুরু রামশঙ্কর ভট্টাচার্য মৃত্যুবরণ করলে, তিনি কিছুদিন বিষ্ণুপুরেই সঙ্গীত চর্চা করতে থাকেন। এরপর সঙ্গীতের উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। শোনা যায়, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এ সময় এক ধনীগৃহে কিছুদিন পাচকের কাজ করেছেন। ওই বাড়িতেই সে কালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ধ্রুপদিয়া গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হন। যদুভট্টের কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে স্বগৃহে (জোড়াসাঁকোর ৫৯ বলরাম দে স্ট্রিট) এনে তালিম দেওয়া শুরু করেন। তিনি এই গুরু কাছে খাণ্ডারবাণী রীতির ধ্রুপদ গান শেখেন। এই বাড়িতেই তিনি প্রায় ষোলো বছর সঙ্গীত শিক্ষা করেন।

তিনি বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত কুচিয়াকোল নিবাসী রাজা রাধাবল্লভ সিংহের দরবারে সঙ্গীতগুরু হিসেবে কাটান। এরপর তিন পঞ্চকোট (কাশীপুর)-এর রাজা নীলমণি সিংহকে গান শোনাতে যান। রাজা তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে, রাজদরবারে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। রাজা তাঁকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এই রাজদরবারে কিছুদিন থাকার পর, তিনি গোবরডাঙ্গায় চলে আসেন।

১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সঙ্গীতে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এই সূত্রে তিনি ত্রিপুরার রাজদরবারে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সভাগায়ক নিযুক্ত হন। এই সময় বিখ্যাত রবাব বাদক কাসেম আলি খাঁ এই দরবারের ছিলেন। এঁদের কাছ থেকেই তিনি পরে যথাক্রমে ও ‘তানরাজ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। এই সময় তিনি সেতার ও সুরবাহারের পাশাপাশি মৃদঙ্গবাদনেও দক্ষতা অর্জন করেন। এই কারণে তাঁর রচিত গানের ভনিতা তানরাজ বা রঙ্গনাথ পাওয়া যায়। এই দুই রাজা ছাড়াও বর্ধমানের রাজা মহতাব চন্দ তাঁকে 'সুরসেন' উপাধি দিয়েছিলেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, ১২৮২ বঙ্গাব্দ (১৮৭৫-৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) যদুভট্ট 'আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়'-এ তিনি কিছুদিন সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। এখানে তাঁর কাছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান শেখেন। সাধারণী পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭-৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিকে তিনি চুঁচুড়ায় প্রতিষ্ঠিত একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে কিছুদিন পাঠদান করেন।

তিনি কাঁঠাল পাড়া গ্রামে বিবাহ করেছিলেন। তাঁর একটি কন্যা সন্তান ছিল।

১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ চৈত্র ১২৮৯ [বুধবার ৪ এপ্রিল ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দ] তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
তথ্যসূত্র :