যদুভট্ট (যদুনাথ ভট্টাচার্য)
১৮৪০ --১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দ
বাংলা ধ্রুপদ গানের অন্যতম শিল্পী এবং সঙ্গীতজ্ঞ।
তাঁর পুরো নাম যদুনাথ ভট্টাচার্য। সংক্ষেপে যদুভট্ট নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন।

১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত বিষ্ণুপুরের ভট্টপাড়া (বর্তমান বৈদিকপাড়া) অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা  মধুসূদন ভট্টাচার্য ওই অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতজ্ঞ এবং সুরবাহার ও সেতারবাদক ছিলেন। তিনি রাজা নীলমণি সিংহের সভাগায়ক হয়েছিলেন। দশ-এগারো বৎসর বয়সে তিনি তাঁর পিতার কাছে সেতার, সুরবাহার এবং পাখোয়াজে তালিম নেন।

তিনি অত্যন্ত সুকণ্ঠের অধিকারী ছিলেন। তাঁর কণ্ঠ শুনে বিষ্ণুপুর ঘরানা আদি ধ্রুপদিয়া রামশঙ্কর ভট্টাচার্য তাঁকে কণ্ঠসঙ্গীতে তালিম দেওয়া শুরু করেন। ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর গুরু রামশঙ্কর ভট্টাচার্য মৃত্যুবরণ করলে, তিনি কিছুদিন বিষ্ণুপুরেই সঙ্গীত চর্চা করতে থাকেন। এরপর সঙ্গীতের উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ১৮৫৫ খ্রিষ্টাব্দে বাড়ি থেকে পালিয়ে কলকাতায় চলে আসেন। শোনা যায়, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য এ সময় এক ধনীগৃহে কিছুদিন পাচকের কাজ করেছেন। ওই বাড়িতেই সে কালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ধ্রুপদিয়া গঙ্গানারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পরিচিত হন। যদুভট্টের কণ্ঠস্বরে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাঁকে স্বগৃহে (জোড়াসাঁকোর ৫৯ বলরাম দে স্ট্রিট) এনে তালিম দেওয়া শুরু করেন। তিনি এই গুরু কাছে খাণ্ডারবাণী রীতির ধ্রুপদ গান শেখেন। এই বাড়িতেই তিনি প্রায় ১০ বছর সঙ্গীত শিক্ষা করেন।

তিনি বাঁকুড়া জেলার অন্তর্গত কুচিয়াকোল নিবাসী রাজা রাধাবল্লভ সিংহের দরবারে সঙ্গীতগুরু হিসেবে কাটান। এরপর একবার তিনি পঞ্চকোট (কাশীপুর)-এর রাজা নীলমণি সিংহকে গান শোনাতে যান। রাজা তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে, রাজদরবারে থেকে যাওয়ার অনুরোধ করেন। রাজা তাঁকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। এই রাজদরবারে কিছুদিন থাকার পর, তিনি গোবরডাঙ্গায় চলে আসেন।

১৮৭০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তিনি সঙ্গীতে তাঁর নামডাক ছড়িয়ে পড়ে। এই সূত্রে তিনি ত্রিপুরার রাজদরবারে মহারাজা বীরচন্দ্র মাণিক্যের সভাগায়ক নিযুক্ত হন। এই সময় বিখ্যাত রবাব বাদক কাসেম আলি খাঁ এই দরবারের ছিলেন। এঁদের কাছ থেকেই তিনি পরে যথাক্রমে ও ‘তানরাজ’ উপাধি লাভ করেছিলেন। এই সময় তিনি সেতার ও সুরবাহারের পাশাপাশি মৃদঙ্গবাদনেও দক্ষতা অর্জন করেন। এই কারণে তাঁর রচিত গানের ভনিতা তানরাজ বা রঙ্গনাথ পাওয়া যায়। এই দুই রাজা ছাড়াও বর্ধমানের রাজা মহতাব চন্দ তাঁকে 'সুরসেন' উপাধি দিয়েছিলেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী লিখছেন, বঙ্কিমচন্দ্র ‘কয়েক বৎসর ধরিয়া যদুভট্টের নিকট গান শিখিতেন। একটি হারমোনিয়াম কিনিয়াছিলেন।’ গোপালচন্দ্র রায় জানিয়েছেন, ‘যদুভট্টই প্রথম বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম্ সংগীতে সুর দিয়ে তাঁকে শুনিয়েছিলেন।’ ১২৮২ বঙ্গাব্দ (১৮৭৫-৭৬ খ্রিষ্টাব্দ) যদুভট্ট 'আদি ব্রাহ্মসমাজ সঙ্গীত বিদ্যালয়'-এ তিনি কিছুদিন সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবে ছিলেন। সাধারণী পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, ১২৮৪ বঙ্গাব্দের (১৮৭৭-৭৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিকে তিনি চুঁচুড়ায় প্রতিষ্ঠিত একটি সঙ্গীত বিদ্যালয়ে কিছুদিন পাঠদান করেন।

তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার আষাঢ় ১২৮২-সংখ্যায়- ২২ জ্যৈষ্ঠ তারিখ দিয়ে একটি ‘বিজ্ঞাপন’-এ দেখা যায়। বিজ্ঞপনে বল হয়-
‘আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসঙ্গীতের স্থায়িত্ব ও উন্নতি সাধনের জন্য উক্ত সমাজ-মন্দিরের দ্বিতীয়তল গৃহে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছে। অদ্য হইতে তাহার কাৰ্য্য আরম্ভ হইবে। রবিবার ও বুধবার ব্যতীত প্রত্যহ সায়াহ্ন ৭ ॥ ঘণ্টা হইতে ১০ ঘণ্টা পর্য্যন্ত ছাত্রদিগকে বিনা বেতনে উচ্চ অঙ্গের কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের শিক্ষা দেওয়া হইবে। প্রসিদ্ধ গায়ক ও সঙ্গীত-শাস্ত্রবেত্তা শ্রীযুক্ত বাবু যদুনাথ ভট্ট অধ্যাপনা কার্য্যের ভার গ্রহণ করিয়াছেন।…’ [পৃ ৫৬]
১২৮২ বঙ্গাব্দে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সঙ্গীত-শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর পরে যদুভট্ট ছিলেন রবীনন্দ্রনাথের দ্বিতীয় শিক্ষক।  এই প্রসঙ্গে, প্রশান্তকুমার পাল- তাঁর রবিজীবনী প্রথম খণ্ডে [পৃষ্ঠা: ২১৬] লিখেছেন-
'ইনি ঠিক কবে ঠাকুরবাড়ির সংস্পর্শে আসেন বলা যায় না, তবে হিসাবখাতায় এঁর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ [বুধ 9 Jun 1875] তারিখে : ‘যদুনাথ ভট্টোর জন্য চা ক্রয় ও চায়ের দুগ্ধ ও মিছরি’। আবার ৯ শ্রাবণ [শনি 24 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘যদুনাথ ভট্টো গায়ক/দ° উহার বেতন গত আষাঢ় মাসের/এক বৌচর ৫০৲, মধ্যে/নিজবাটীর অংশে/শোধ ২৫৲’। এর থেকে বোঝা যায়, যদুভট্ট দেবেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথের পরিবারে মাসিক বেতনের বিনিময়ে সংগীত-শিক্ষা দিতেন। খাওয়া-দাওয়াও করতেন, তার হিসাবও পাওয়া যায়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের হিসাবেও তাঁর নাম পাওয়া যায়, কিন্তু এর পরে তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। তাই মনে হয় যদু ভট্ট খুব দীর্ঘদিন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।'
যদুভট্টের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে- রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে, ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার একটা গুণ আছে-- তখনো কিছু শিখি নি, মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত "পলাতকা' ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি-- কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব'লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে-- অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি-- এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি। সেজদাদা শিখতেন বটে-- তিনি সুর ভাঁজছেন তো ভাঁজছেনই, গলা সাধছেন তো সাধছেনই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হয়তো বর্ষাকাল-- মেঘলা হয়েছে-- আমার তখন একটু কবিত্ব [জাগল]। তবু যা শুনতাম হয়তো মনে থাকত।... [সূত্র: সঙ্গীতচিন্তা/গীতালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৩০ জুন, ১৯৪০, ১৬ আষাঢ়, ১৩৪৭, তারিখে কথিত বক্তৃতার অনুলেখন]

অন্যত্র বলেছেন-  'তিনি ওস্তাদজাতের চেয়ে ছিলেন অনেক বড়ো। তাঁকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর ছিল প্রতিভা, অর্থাৎ সংগীত তাঁর চিত্তের মধ্যে রূপ ধারণ করত। তাঁর রচিত গানের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল তা অন্য কোনো হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না।…যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ।’

বাহার রাগিণী ও তেওড়া তালে রচিত যদুভট্টের একটি গান ‘আজু বহত সুগন্ধ পবন সুমন্দ’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে’ গানটি রচনা করেন ।
 [সূত্র: রবীন্দ্রসঙ্গীত। শান্তিদেব ঘোষ। বিশ্বভারতী। আশ্বিন ১৪১৫]

জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অপর সঙ্গীতশিক্ষক শ্রীকণ্ঠ সিংহ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যদুভট্টের নাম উল্লেখ না করে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন এই ভাবে-

'আমাদের বাড়িতে একসময়ে একজন বিখ্যাত গায়ক কিছুদিন ছিলেন। তিনি মত্ত অবস্থায় শ্রীকণ্ঠবাবুকে যাহা মুখে আসিত তাহাই বলিতেন। শ্রীকণ্ঠবাবু প্রসন্নমুখে সমস্তই মানিয়া লইতেন, লেশমাত্র প্রতিবাদ করিতেন না। অবশেষে তাঁহার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সেই গায়কটিকে আমাদের বাড়ি হইতে বিদায় করাই স্থির হইল। ইহাতে শ্রীকণ্ঠবাবু ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিলেন। বারবার করিয়া বলিলেন, “ও তো কিছুই করে নাই, মদে করিয়াছে।

সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ২৫ বৈশাখ ১২৯০ [২৭। ২৫] তারিখের সংবাদ থেকে জানা যায়, ২২ চৈত্র ১২৮৯ (বুধবার ৪ এপ্রিল] মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে বিশিষ্ট গায়ক যদুনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়।


তথ্যসূত্র: