‘আদি ব্রাহ্মসমাজের ব্রহ্মসঙ্গীতের স্থায়িত্ব ও উন্নতি সাধনের জন্য উক্ত সমাজ-মন্দিরের দ্বিতীয়তল গৃহে একটি সঙ্গীত বিদ্যালয় সংস্থাপিত হইয়াছে। অদ্য হইতে তাহার কাৰ্য্য আরম্ভ হইবে। রবিবার ও বুধবার ব্যতীত প্রত্যহ সায়াহ্ন ৭ ॥ ঘণ্টা হইতে ১০ ঘণ্টা পর্য্যন্ত ছাত্রদিগকে বিনা বেতনে উচ্চ অঙ্গের কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের শিক্ষা দেওয়া হইবে। প্রসিদ্ধ গায়ক ও সঙ্গীত-শাস্ত্রবেত্তা শ্রীযুক্ত বাবু যদুনাথ ভট্ট অধ্যাপনা কার্য্যের ভার গ্রহণ করিয়াছেন।…’ [পৃ ৫৬]১২৮২ বঙ্গাব্দে তিনি জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়িতে সঙ্গীত-শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। বিষ্ণুচন্দ্র চক্রবর্তীর পরে যদুভট্ট ছিলেন রবীনন্দ্রনাথের দ্বিতীয় শিক্ষক। এই প্রসঙ্গে, প্রশান্তকুমার পাল- তাঁর রবিজীবনী প্রথম খণ্ডে [পৃষ্ঠা: ২১৬] লিখেছেন-
'ইনি ঠিক কবে ঠাকুরবাড়ির সংস্পর্শে আসেন বলা যায় না, তবে হিসাবখাতায় এঁর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ২৭ জ্যৈষ্ঠ ১২৮২ [বুধ 9 Jun 1875] তারিখে : ‘যদুনাথ ভট্টোর জন্য চা ক্রয় ও চায়ের দুগ্ধ ও মিছরি’। আবার ৯ শ্রাবণ [শনি 24 Jul] তারিখের হিসাবে দেখা যায় : ‘যদুনাথ ভট্টো গায়ক/দ° উহার বেতন গত আষাঢ় মাসের/এক বৌচর ৫০৲, মধ্যে/নিজবাটীর অংশে/শোধ ২৫৲’। এর থেকে বোঝা যায়, যদুভট্ট দেবেন্দ্রনাথ ও গুণেন্দ্রনাথের পরিবারে মাসিক বেতনের বিনিময়ে সংগীত-শিক্ষা দিতেন। খাওয়া-দাওয়াও করতেন, তার হিসাবও পাওয়া যায়। শ্রাবণ ও ভাদ্র মাসের হিসাবেও তাঁর নাম পাওয়া যায়, কিন্তু এর পরে তাঁর কোনো উল্লেখ নেই। তাই মনে হয় যদু ভট্ট খুব দীর্ঘদিন ঠাকুরবাড়ির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।'যদুভট্টের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে- রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন-
বাল্যকালে আমাদের ঘরে ওস্তাদের অভাব ছিল না; সুদূর থেকে অযোধ্যা গোয়ালিয়র ও মোরাদাবাদ থেকে, ওস্তাদ আসত। তা ছাড়া বড়ো বড়ো ওস্তাদ ঘরেও বাঁধা ছিল। কিন্তু আমার একটা গুণ আছে-- তখনো কিছু শিখি নি, মাস্টারির ভঙ্গি দেখালেই দৌড় দিয়েছি। যদুভট্ট আমাদের গানের মাস্টার আমায় ধরবার চেষ্টা করতেন। আমি তাঁর ঘরের সামনে দিয়ে দৌড় দিতাম। তিনি আমাদের কানাড়া গান শিখাতে চাইতেন। বাংলাদেশে এরকম ওস্তাদ জন্মায় নি। তাঁর প্রত্যেক গানে একটা originality ছিল, যাকে আমি বলি স্বকীয়তা। আমি অত্যন্ত "পলাতকা' ছিলুম বলে কিছু শিখি নি, নইলে কি তোমাদের কাছে আজকে খাতির কম হত? এ ভুল যদি না করতুম, পালিয়ে না বেড়াতুম, তা হলে আজকে তোমাদের মহলে কি নাম হত না? সেটা হয়ে উঠল না, তাই আমি এক কৌশল করেছি-- কবিতার-কাছঘেঁষা সুর লাগিয়ে দিয়েছি। লোকের মনে ধাঁধা লাগে; কেউ বলে সুর ভালো, কেউ বলে কথা ভালো। সুরের সঙ্গে কথা, কবি কিনা। কবির তৈরি গান, এতে ওস্তাদি নেই। ভারতীয় সংগীত ব'লে যে-একটা প্রকাণ্ড ব্যাপার আছে, আমার জন্মের পর তার নাকি ক্ষতি হয়েছে-- অপমান নাকি হয়েছে। তার কারণ আমার অক্ষমতা। বাল্যকালে আমি গান শিখি নি-- এতে সহজে শেখা যায় না, শিখতে কষ্ট হয়, সেই কষ্ট আমি নেই নি। সেজদাদা শিখতেন বটে-- তিনি সুর ভাঁজছেন তো ভাঁজছেনই, গলা সাধছেন তো সাধছেনই, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত। হয়তো বর্ষাকাল-- মেঘলা হয়েছে-- আমার তখন একটু কবিত্ব [জাগল]। তবু যা শুনতাম হয়তো মনে থাকত।... [সূত্র: সঙ্গীতচিন্তা/গীতালি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ৩০ জুন, ১৯৪০, ১৬ আষাঢ়, ১৩৪৭, তারিখে কথিত বক্তৃতার অনুলেখন]
অন্যত্র বলেছেন- 'তিনি ওস্তাদজাতের চেয়ে ছিলেন অনেক বড়ো। তাঁকে গাইয়ে বলে বর্ণনা করলে খাটো করা হয়। তাঁর ছিল প্রতিভা, অর্থাৎ সংগীত তাঁর চিত্তের মধ্যে রূপ ধারণ করত। তাঁর রচিত গানের মধ্যে যে বিশিষ্টতা ছিল তা অন্য কোনো হিন্দুস্থানী গানে পাওয়া যায় না।…যদুভট্টর মতো সংগীতভাবুক আধুনিক ভারতে আর কেউ জন্মেছে কিনা সন্দেহ।’
বাহার রাগিণী ও তেওড়া তালে রচিত যদুভট্টের একটি গান ‘আজু বহত সুগন্ধ পবন সুমন্দ’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘আজি বহিছে বসন্তপবন সুমন্দ তোমারি সুগন্ধ হে’ গানটি রচনা করেন ।
[সূত্র: রবীন্দ্রসঙ্গীত। শান্তিদেব ঘোষ। বিশ্বভারতী। আশ্বিন ১৪১৫]
জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথের অপর সঙ্গীতশিক্ষক শ্রীকণ্ঠ সিংহ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যদুভট্টের নাম উল্লেখ না করে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন এই ভাবে-
'আমাদের বাড়িতে একসময়ে একজন বিখ্যাত গায়ক কিছুদিন ছিলেন। তিনি মত্ত অবস্থায় শ্রীকণ্ঠবাবুকে যাহা মুখে আসিত তাহাই বলিতেন। শ্রীকণ্ঠবাবু প্রসন্নমুখে সমস্তই মানিয়া লইতেন, লেশমাত্র প্রতিবাদ করিতেন না। অবশেষে তাঁহার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সেই গায়কটিকে আমাদের বাড়ি হইতে বিদায় করাই স্থির হইল। ইহাতে শ্রীকণ্ঠবাবু ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিলেন। বারবার করিয়া বলিলেন, “ও তো কিছুই করে নাই, মদে করিয়াছে।
সোমপ্রকাশ পত্রিকায় ২৫ বৈশাখ ১২৯০ [২৭। ২৫] তারিখের সংবাদ থেকে জানা যায়, ২২ চৈত্র ১২৮৯ (বুধবার ৪ এপ্রিল] মাত্র ৪২ বৎসর বয়সে বিশিষ্ট গায়ক যদুনাথ ভট্টাচার্যের মৃত্যু হয়।