![]() |
বাম থেকে- রবীন্দ্রনাথ, সোমেন্দ্রনাথ, শ্রীকণ্ঠ সিংহ ও সত্যপ্রসাদ |
'...সম্ভবত মাঘ মাসে জোড়াসাঁকোয় আগমন করেন। ২৬ মাঘ [শুক্র 7 Jan 1873] তারিখের হিসাবে দেখছি: ‘শ্রীকণ্ঠ বাবুর দাঁত বাঁধাইবার জন্য ব্যয়’ ১৭৫ টাকা সরকারী তহবিল থেকেই দেওয়া হয়েছে। আবার ৯ ফাল্গুন [বুধ 19 Feb] ‘শ্রীকণ্ঠবাবুর জন্য মশারি একটা ও বিছানার চাদর একখানা তৈয়ারি’ করানো হয়েছে অর্থাৎ জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে তিনি প্রায় স্থায়ী অতিথিতে পরিণত হয়েছেন। অবশ্য এই সময়ে রবীন্দ্রনাথ পিতার সঙ্গে বোলপুর ও হিমালয় ভ্রমণেরত, সেখান থেকে ফিরে আসার পরই তাঁর সঙ্গে শ্রীকণ্ঠ সিংহের অসমবয়সী বন্ধুত্বের সূচনা।'রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে শ্রীকণ্ঠ সম্পর্কে যে সরস বর্ণনা দিয়েছেন, তা হলো-
‘...বৃদ্ধ একেবারে সুপক্ক বোম্বাই আমটির মতো—অম্লরসের আভাসমাত্রবর্জিত—তাঁহার স্বভাবের কোথাও এতটুকু আঁশও ছিল না। মাথা-ভরা টাক, গোঁফদাড়ি-কামানো স্নিগ্ধ মধুর মুখ, মুখবিবরের মধ্যে দন্তের কোনো বালাই ছিল না, বড়ো বড়ো দুই চক্ষু অবিরাম হাস্যে সমুজ্জ্বল। তাঁহার স্বাভাবিক ভারী গলায় যখন কথা কহিতেন তখন তাঁহার সমস্ত হাত মুখ চোখ কথা কহিতে থাকিত। তাঁহার বামপার্শ্বের নিত্যসঙ্গিনী ছিল একটি গুড়গুড়ি, কোলে কোলে সর্বদাই ফিরিত একটি সেতার, এবং কণ্ঠে গানের আর বিশ্রাম ছিল না।'রবীন্দ্রনাথ যে তাঁর প্রিয় শিষ্য ছিলেন- এই বিষয় জীবনস্মৃতিতে তিনি লিখেছেন
'গান সম্বন্ধে আমি শ্রীকণ্ঠ সিংহের প্রিয়শিষ্য ছিলাম। তাঁহার একটি গান ছিল ‘ময়্ ছোড়োঁ ব্রজকি বাসরী’'। এই গানটি আমার মুখে সকলকে শোনাইবার জন্য তিনি আমাকে ঘরে ঘরে টানিয়া লওয়া বেড়াইতেন। আমি গান ধরিতাম, তিনি সেতারে ঝংকার দিতেন এবং গানের প্রধান ঝোঁক ‘ময় ছোড়োঁ, সেইখানটাতে মাতিয়া উঠিয়া তিনি নিজেও যোগ দিতেন ও ‘অশ্রান্তভাবে সেটা ফিরিয়া ফিরিয়া আবৃত্তি করিতেন এবং মাথা নাড়িয়া মুগ্ধদৃষ্টিতে সকলের মুখের দিকে চাহিয়া যেন সকলকে ঠেলা দিয়া ভালোলাগায় উৎসাহিত করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিতেন।'
রবীন্দ্রনাথ তাঁর
জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন- তিনি
দেবেন্দ্রনাথের বন্ধু ছিলেন। তাঁর দেওয়া
হিন্দি গানের সুর অবলম্বনে
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন- '
অন্তরতর অন্তরতম তিনি যে'।
জীবনস্মৃতিতে শ্রীকণ্ঠ সিংহ-প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ
যদুভট্টের
নাম উল্লেখ না করে একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন
এই ভাবে-
'আমাদের বাড়িতে একসময়ে একজন বিখ্যাত গায়ক কিছুদিন ছিলেন। তিনি মত্ত অবস্থায় শ্রীকণ্ঠবাবুকে যাহা মুখে আসিত তাহাই বলিতেন। শ্রীকণ্ঠবাবু প্রসন্নমুখে সমস্তই মানিয়া লইতেন, লেশমাত্র প্রতিবাদ করিতেন না। অবশেষে তাঁহার প্রতি দুর্ব্যবহারের জন্য সেই গায়কটিকে আমাদের বাড়ি হইতে বিদায় করাই স্থির হইল। ইহাতে শ্রীকণ্ঠবাবু ব্যাকুল হইয়া তাঁহাকে রক্ষা করিবার চেষ্টা করিলেন। বারবার করিয়া বলিলেন, “ও তো কিছুই করে নাই, মদে করিয়াছে।'
জীবনের শেষ লগ্নে তিনি দেবেন্দ্রনাথের সাথে দেখা করার জন্য, বীরভূমের রায়পুর থেকে চূঁচুড়ার বাগান বাড়িতে এসেছিলেন। বহুকষ্টে তিনি তাঁর কন্যাকে সাথে নিয়ে এখানে আসেন এবং দেবেন্দ্রনাথের পদধূলি নিয়ে রায়পুর চলে যান। এর কিছুদিনের মধ্যে তাঁর মৃত্য হয়। তাঁর কন্যার কাছে থেকে রবীন্দ্রনাথ জেনেছিলেন- তিনি কী মধুর তব করুণা প্রভো' গানটি গেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।