মুকুন্দ দাস
(১৮৭৮-১৯৩৪)
চারণ কবি, পালা
রচয়িতা, পরিচালক ও অভিনেতা, স্বদেশী আন্দোলনকারী।
১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ২২শে ফেব্রুয়ারি
ঢাকা জেলার বিক্রমপুর পরগণার বানরী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম গুরুদয়াল দে।
মায়ের নাম শ্যামাসুন্দরী দেবী। স্ত্রীর নাম সুভাষিণী দেবী।
তাঁর পৈত্রিক নাম ছিল যজ্ঞেশ্বর দে। ডাক নাম ছিল যজ্ঞা। তাঁর জন্মের পরে বানরী গ্রাম পদ্মার
ভাঙনে বিলুপ্ত হয়ে গেলে, গুরুদয়াল সপরিবারে চাকরিস্থল বরিশাল শহরে চলে আসেন।
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে বীরেশ্বর গুপ্ত নামক এক বৈষ্ণবের কণ্ঠে গান শুনে
তিনি কীর্তনের দলে যোগ দেন। পরে নিজেই একটি কীর্তনের দল গঠন করেন।
১৯০২ খ্রিষ্টাব্দে রামানন্দ গোসাঁইজী বা
হরিবোলানন্দ নামে এক ত্যাগী সাধুর কাছে দীক্ষা গ্রহণ। সে সময় বৈষ্ণব সন্ন্যাসী রামানন্দ অবধূত
যজ্ঞেশ্বরের গলায় হরিসংকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে তাকে দীক্ষা দিয়ে তার নাম রাখেন মুকুন্দ দাস।
পরে এই নামেই তিনি সুপরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
এই সময় তিনি বরিশাল থেকে প্রকাশিত হিতৈষী পত্রিকায় লিখতেন। লেখাপড়া এবং লেখালেখির
পাশাপাশি তিনি স্থানীয় সখের যাত্রাগানে অংশ নিতেন। এই গানের সূত্রে তিনি বরিশালের
যাত্রাশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এসকল অনুষ্ঠানের অর্থপ্রাপ্তি ঘটেছিল
বিপুল পরিমাণ। এই টাকায় তিনি বরিশালের কাশীপুর
কালীমন্দিরের ৮৭ শতাংশ জায়গা কিনেন।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে 'সাধন সঙ্গীত' নামে
তাঁর একটি গানের বই বরিশাল থেকে প্রকাশিত হয়। তাতে শতাধিক গান স্থান পায়। যার অধিকাংশই
ছিল দেশাত্মবোধক।
এরই ভিতরে বরিশালের
অশ্বিনীকুমার দত্তের
সংস্পর্শে এসে মুকুন্দ দাস রাজনীতিতে আকৃষ্ট হন। তিনি গ্রামে গ্রামে
দেশাত্মবোধক গান গেয়ে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা শুরু করেন। এই
কর্মকাণ্ডে তাঁর অন্যতম সমর্থক এবং সহকর্মী হয়ে উঠেছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত।
এই সূত্রে সাধারণ মানুষের কাছে তিনি হয়ে উঠেছিলেন চারণ কবি।
১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় মুকুন্দ দাস একের পর এক গান,
কবিতা ও নাটক রচনা করে বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে নূতন উদ্দীপনার সঞ্চার করেন।
এর ফলে অচিরেই ইংরেজ সরকারের কোপানলে পড়েন। ১৯০৮
খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে
গ্রেফতার করা হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্তি লাভ করেছিলেন।
অশ্বিনীকুমার দত্তের
আগ্রহে মুকুন্দ দাস ‘মাতৃপূজা’ নামে একটি নাটক রচনা করেন।
দুর্গাপূজার মহাসপ্তমীতে নবগ্রামে এই নাটকের প্রথম প্রকাশ্য
মঞ্চস্থ হয়েছিল। ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে এই যাত্রাপালার জন্য
তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। বিচারে তাঁলে প্রায়
আড়াই বছরের
কারাদণ্ড ও জরিমানা
করা হয়েছিল। জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে গিয়ে
তিনি পৈতৃক দোকান বিক্রি করেন। মাতৃপূজা নাটকটি
সরকার বাজেয়াপ্ত করে। কারাবাসের সময়ে স্ত্রী সুভাষিণী দেবীর মৃত্যু হয়।
১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে কারগার থেকে মুক্তিলাভের পর
চিত্তরঞ্জন দাশ ও
সুভাষচন্দ্র বসু তাঁকে সান্ত্বনা দেন
এবং তাঁকে যাত্রা ও গান রচনায় উদ্বুদ্ধ করেন।
যার ফলে তিনি পুনরায় রচনায় মনোনিবেশ করেন।
১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে দেশবন্ধু
চিত্তরঞ্জন দাশের আমন্ত্রণে
মুকুন্দ দাস তার যাত্রার দল নিয়ে কলকাতা যান। কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউট হলে
তাঁর দল যাত্রাপালা মঞ্চস্থ করেন।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি
অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন।
১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দে মুকুন্দ দাস গান
রচনার পাশাপাশি আইন অমান্য করে সরাসরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই মে শুক্রবার মুকুন্দদাস মৃত্যু বরণ করেন।
তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালা ছিল- মাতৃপূজা, পথ, সাথী,
সমাজ, পল্লীসেবা ইত্যাদি। এর ভিতরে মাতৃপূজা, পথ ও সাথী ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত
করেছিল।