নজরুল জীবনী
সূচনা
নজরুলের বাস্তুভিটা ও পূর্ব-পুরুষের কথা


অধিকাংশ নজরুল গবেষক এবং জীবনীকারদের মতে, নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা বিহারের পাটনা থেকে চুরুলিয়া অঞ্চলে এসেছিলেন মোগল সাম্রাজ্যের ষোড়শ সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় -এর আমলে। উল্লেখ্য, মোগল সাম্রাজ্যের ষোড়শ সম্রাট শাহ আলম দ্বিতীয় রাজত্ব করেছিলেন ১৭৬০-১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। এই বিচারে ধারণা করা যায়, নজরুলের পূর্বপুরুষরা চুরুলিয়ায় এসেছিলেন ১৭৬০ থেকে ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে। এঁদের পদবী ছিল কাজী। সম্ভবত নজরুলের পূর্ব-পুরুষরদের কেউ পাটনা থাকাকালে 'কাজী' পদবী লাভ করেছিলেন। বংশানুক্রমে এই পদ ধারণ করার সূত্রে- এঁদের উত্তরপুরুষরা কাজী পদবী ব্যবহার করা শুরু করেছিল। এই কাজী পরিবারের অংশবিশেষ যখন চুরুলিয়ায় আসেন, তখন তা ছিল হিন্দু-প্রধান এলাকা। এখানে মুসলমান শাসকদের আনুকূল্যে এঁরা নিষ্কর জমি পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য ভারতে মুসলিম শাসনামলে বিশিষ্ট ধার্মিক ব্যক্তিদেরকে সুলতান বা সম্রাটরা নিষ্কর ভূমি দান করতেন। এই নিষ্কর ভূমিকে বলা হতো আয়মা। আর আয়মা ভোগকারী ব্যক্তিকে বলা হতো আয়মাদার। এই বিচারে বলা যায়, চুরুলিয়ায় আসা নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা বিশিষ্ট ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছিলেন। এঁরা নিষ্কর জমি ভোগ করতেন। এঁরা ধর্মাচরণ এবং সম্ভবত ধর্ম প্রচারের জন্য মসজিদ ও মক্তব তৈরি করেছিলেন। স্থানীয় মুসলমান শাসকরা হয়তো এরূপ আয়মাদার তৈরি করে, হিন্দু-প্রধান এলাকায় ইসলাম ধর্মের বিস্তারে উৎসাহ দিয়েছিল। তারপরেও দেখা যায়, বর্ধমানে ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত শতকরা ১৭.১ জন ইসলাম ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

নজরুলের পূর্ব-পুরুষরা যখন চুরুলিয়ায় এসেছিলেন তখন নরোত্তম গড়ের ধ্বংসাবশেষে ছিল। জেসিকে পিটার্সন, ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দের
Bengal District Gazetteer, vol XXIII (Bwadwan)- এ প্রকাশিত তথ্যানুসারে জানা যায়, চুরুলিয়ায় আগত মুসলমানদের উৎসকে অজ্ঞাত । এঁরা নরোত্তমের ভেঙে পড়া দুর্গ থেকে ইঁট সংগ্রহ করে, ঘরবাড়ি মসজিদ তৈরি করেছিল। এর মধ্য দিয়ে হিন্দু প্রধান চুরুলিয়ায় গ্রামে মুসলিম মহল্লার সূত্রপাত হয়েছিল। এঁরা ছিলেন একক বা গুটি কয়েক পরিবার মাত্র। কাজীর মতো ভারিক্কি চালের বিচার ব্যবস্থার প্রয়োজনও ছিল না। তাছাড়া চুরুলিয়াতে কাজীর দরবার যে ছিল এমন কোনো প্রমাণও পাওয়া যায় না।

নরোত্তম সিংহের গড়
চুরুলিয়া গ্রামের যেখানে নজরুলের বাস্তুভিটা হিসেবে উল্লেখ করা হয়, তার পূর্ব দিকে ছিল রাজা  নরোত্তম সিংহের। এই গড় সম্পর্কে  দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর বৃহৎ বঙ্গগ্রন্থে- প্রসঙ্গক্রমে লিখেছেন- '...রাণীগঞ্জের অধীন চুরুলিয়া পল্লীতে রাজা নরোত্তমের দুর্গ‌‌...।'  [বৃহৎ বঙ্গ (দ্বিতীয় খণ্ড) - দীনেশচন্দ্র সেন। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯২৮। পৃষ্ঠ ১১৩৯।

যজ্ঞেশ্বর চৌধুরীর তাঁর 'বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি' গ্রন্থে 'চুরুলিয়া‌ এবং গড় সম্পর্কে লিখেছেন-

আসনসোল হতে ১১ কিলোমঢার উত্তর-পাশ্চমে বরাবানি এবং তথা হতে ৩ কিলোমিটার দূরে চুরুলিয়ার অবস্থিত। অজয় নদের দক্ষিণ ভাগে সেরগড় পরগণায় হিন্দু আমলে চুরুলিয়ায় একটি দুর্গ ছিল এবং এই দুর্গের সঙ্গে নরোত্তম নামক একজন স্থানীয় নৃপতির নাম বিজড়িত আছে। স্থানীয় লোকের নিকট দুর্গটি নরোত্তমের দুর্গ নামে খ্যাত ছিল। কিন্তু কোন সময়ে দুর্গটি মুসলমানের অধিকার করে এবং আয়মাদারগণের আগমনের সময়কাল জানা যায় না। আয়মাদারগণ দুর্গের মধ্যেই মসজিদ ও বাড়িঘর নির্মাণপূর্বক বসবাস শুরু করেন। ওল্ডহামের মতে নরোত্তম ছিলেন পঞ্চকোটের রাজবংশের কোন ব্যক্তি। একালে চুরুলিয়া প্রসিদ্ধির কারণ হল 'বিদ্রোহী কবি কাজী নজরল ইসলামের জন্মস্থানরূপে এবং কবির জন্মদিবস উপলক্ষে প্রতি বৎসর ১১ই জ্যৈষ্ঠ হতে সপ্তাহকালব্যাপী সাহিত্যের আসর ও সংস্কৃতি মেলা বসে। রুক্ষ পাথুরে অঞ্চলের মানুষেরা পাথরের কাজে বেশ পারদর্শী এবং তদ্দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে।

[বর্ধমান: ইতিহাস ও সংস্কৃতি। তৃতীয় খণ্ড। যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। পুস্তক বিপণি। কলকাতা। পৃষ্ঠা: ২৪১-২৪২]

নজরুল  সিয়ারসোল রাজ স্কুলে লেখাপড়া করার সময় ‌'‌‌ভগ্নস্তূপ' নামক একটি কবিতাটি রচনা করেছিলেন। এই কবিতায় কবি এই গড় নিয়ে অলীক কল্পনায় বিহার করেছেন।

নরোত্তম গড়

সম্ভবত এখানে নরোত্তম নামক কোনো ক্ষুদ্র নৃপতির কোনো ক্ষুদ্র সেনানিবাস ছিল। গড় বলতে যে দুর্গ বুঝায় তা গড়ে তুলবার মতো ক্ষমতা এই নৃপতির ছিল বলে মনে হয় না। বর্ধমানের ইতিহাসে দুর্গ গড়ে তোলার মতো নরোত্তম নামের নৃপতির নাম পাওয়া যায় না।  মুসলমানদের অভিযানের সূত্রে বহু স্থানীয় জমিদারদের ঘড়বাড়ি ধ্বংস বা পরিত্যক্ত হয়েছে। চুরুলিয়ার নরোত্তম গড় তেমনি একটি স্থাপনা মাত্র। এর উচ্চতা সমতল ভূমির চেয়ে কিছুটা উঁচু। পরিত্যক্ত এই গড় থেকে ইঁট নিয়ে গিয়ে লোকজন ব্যবহার করেছেন।

১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের পরে এই গড়ের কিছুটা কেটে ফেলা হয়েছে। তবে এখান থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি। এই গড়ের অপেক্ষাকৃত ঢালু জায়গায় সরকারি টাকায় দরিদ্র লোকের আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নজরুলের স্ত্রী প্রমীলা নজরুলের মৃত্যুর পর এই গড়ের পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে।

হাজি পালোয়ান ও পীর পুকুর
নরোত্তম সিংহের গড়ের পাশে বা নজরুলের বাস্তুভিটার পাশে রয়েছে একটি কবর। এই কবরটিকে অনেকে হাজি পালোয়ানের মাজার বলে থাকেন। হাজি পালোয়ান সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। সম্ভবত তিনি কাজী বংশের কেউ ছিলেন না। তিনি ধনবান  ব্যক্তি ছিলেন এবং হজ করে হাজি নাম পেয়েছিলেন। স্থানীয় জনগণের জলকষ্ট দূরীকরণের জন্য তিনি একটি পুকুর খনন করেছিলেন। নজরুলের পৈত্রিক বাস্তুভিটার দক্ষিণ দিকে অবস্থিত এই পুকুরের নাম 'পীরপুকুর'। সম্ভবত হাজি পালোয়ান ধার্মিক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। স্থানীয় মানুষের কাছে তিনি পীরের মর্যাদাও পেয়েছিলেন। তাই হাজী পালোয়ানের পুকুর হয়ে গিয়েছিল 'পীরের পুকুর'। হয়তো স্থানীয় লোকেরা হাজি পালোয়ানের কবরটিকে পীরের মাজার হিসেবে ভক্তিশ্রদ্ধা করতো। তবে এই মাজার শেষ পর্যন্ত তীর্থক্ষেত্রের হয়ে ওঠে নি।

মসজিদ ও মক্তব
নরোত্তমের গড় ও নজরুলের বাস্তুভিটার মধ্যবর্তী স্থানে ছিল একটি মসজিদ। এই মসজিদেই স্থানীয় মুসলমান শিক্ষার্থীরা ধর্মীয় পাঠ নিতে আসতো। এই কারণে একই সাথে মসজিদটিও মক্তবও ছিল।

নজরুলের পূর্ব-পুরুষ ও তাঁর পৈত্রিক পরিবার
পাটনা থেকে চুরুলিয়ায় আগত কাজী পরিবারের আদি-সদস্যদের নাম পাওয়া যায় না। নজরুলের বংশ লতিকা অনুসরণে নজরুল গ্রন্থাকাররা নজরুলের পূর্ব-পুরুষদের যে তালিকা তৈরি করেছেন, তাতে সরব-প্রাচীন নাম পাওয়া যায় কাজী খরবরাতুল্লাহ। এঁর চার পুত্রসন্তানরা ছিলেন- কাজী গোলাম হোসেন, কাজী আব্দুল জলিল, কাজী জয়নাল আবেদীন এবং কাজী কমরুদ্দিন।

কাজী গোলাম হোসেনের দুটি পুত্রের নাম পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- কাজী আমানুল্লাহ ও কাজী নাজিবুল্লাহ।
কাজী আমানুল্লাহর পুত্র ছিলেন কাজী ফকির আহমদ। কাজী ফকির আহমদ দুটি বিবাহ করেছিলেন।

নজরুলের সন্তানাদি ও উত্তর-পুরুষ
নজরুলের স্ত্রী নাম আশালতা সেনগুপ্ত (নজরুলের দেওয়া নাম প্রমীলা)। এঁদের চারটি সন্তান ছিল- এঁরা হলেন-


সূত্র: