সোহরাব হোসেন
(১৯২২-২০১২খ্রিষ্টাব্দ)
বিশিষ্ট নজরুল সঙ্গীত শিল্পী।

১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার রানাঘাটের নিকটবর্তী আয়েশতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। তাঁর পরিবারে সবাই সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। সেই সূত্রে তিনিও শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি অনুরক্ত হয়ে উঠেন। ৯ বৎসর বয়সে তিনি জয়নুল আবেদীন নামক জনৈক সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে প্রথম সঙ্গীতে তালিম নেন। তিনি যখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র, সেই সময় তৎকালীন রাণাঘাট অঞ্চলের জমিদার ক্ষীরোদ পাল চৌধুরীর তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন এবং জমিদার তাঁকে কিরণ দে চৌধুরী নামের এক সঙ্গীত শিক্ষকের কাছে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন।

সে সময় তিনি নজরুল সঙ্গীত শিল্পী পূরবী দত্তের বাড়িতে, তাঁর দাদার গান-শিক্ষার আসরে তিনি গান শুনতে যেতেন। গ্রামোফোন রেকর্ডে কোন গান শুনে তিনি তা গলায় তুলে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। এই সময় তিনি এতটাই সঙ্গীত শিক্ষায় গভীরভাবে মনোনিবেশ করেন যে, তাঁর স্কুলের পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই কারণে পরিবারের লোকেরা গান বাদ দিয়ে স্কুলের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ জোর দিতে থাকেন। এই চেষ্টা সফল না হওয়ায়―  তাঁর বড়ভাই তাঁর লেখাপড়া বন্ধ করে দিয়ে তাঁর ব্যবসার কাজে তাঁকে নিয়ে নেন।

কিন্তু সোহরাব হোসেন এই প্রতিকূলতার মধ্যেও গান চালিয়ে যেতে থাকেন। ক্রমে ক্রমে তিনি স্থানীয় শিল্পীদের মধ্যে বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী হিসাবে স্থান করে নেন। এই সময় রাণাঘাটে একটি বিশাল সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেখানে গান শুনিয়েছিলেন সেকালের প্রখ্যাত শিল্পীরা। এর ভিতরে ছিলেন ― আব্বাসউদ্দিন, ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, জসিম উদ্দীন এবং তবলা বাদক বজলুল করিম। এই আসরে সোহরাব হোসেন স্থানীয় শিল্পী হিসাবে গান গাওয়ার সুযোগ পান। এর কিছুদিন পর তিনি কলকাতা চলে আসেন। পরে তিনি মোহাম্মদ হোসেন খসরুর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন।

তাঁর শিক্ষক কিরণ দে চৌধুরীর মাধ্যমে তিনি শ্রীরঙ্গম থিয়েটারে মাসিক ১২ টাকা বেতনে গান গাওয়ার কাজ পান। কলকাতায় তিনি ধীরে ধীরে শিল্পী হিসাবে পরিচিত হয়ে উঠতে থাকেন। ফলে অন্যান্য শিল্পীদের সাথে তাঁর বিশেষ হৃদ্যতা গড়ে উঠে। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা বেতারে তিনি প্রথম গান করার সুযোগ পান। ১৯৪৬ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন আব্বাসউদ্দিন তাঁকে 'সংগস অ্যান্ড পাবিলিসিটি' বিভাগে কাজের ব্যবস্থা করে দেন। এছাড়া আব্বাসউদ্দিনের সহায়তায় তিনি মেগাফোন রেকর্ডসের সাথে রেকর্ড বের করার চুক্তি করেন। কিন্তু সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে আর তাঁর গানের রেকর্ড করা হয়ে ওঠে নি। এরপর তিনি এইচএমভি রেকর্ড কোম্পানি ও রেডিওতে অডিশন দিয়ে পাশ করেন।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাজনের পর তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তিনি আব্বাস উদ্দীনের মাধ্যমে ৪১ জিন্দাবাজার লেনের একটি বাড়িতে ওঠেন। এই সময় তিনি আব্বাসউদ্দীনের সহায়তায় তথ্য বিভাগে চাকরি পান। চাকরির পাশাপাশি তিনি তিনি নিয়মিত রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। উল্লেখ্য বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনের জন্মলগ্ন থেকেই তিনি এ দুটো মাধ্যমের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরপর থেকে তিনি ঢাকাতে নজরুল সঙ্গীত শেখানো শুরু করেন। এই সময় আব্বাসউদ্দিনের সাথে বাংলাদেশের নানা স্থানে ঘুরেছেন এবং গান করেছেন। তিনি যে সকল চলচ্চিত্রে গান করেছ িলেন সেগুলো হলো- 'মাটির পাহাড়', 'যে নদী মরুপথে', 'গোধূলির প্রেম', 'শীত বিকেল', 'এ দেশ তোমার আমার', 'রাজধানীর বুকে' ইত্যাদি। তিনি মঞ্চ নাটকও করেছেন কার্জন হল, ব্রিটানিয়া হল ইত্যাদি স্থানে। তিনি তুলসী লাহিড়ীর ‘ছেঁড়া তাঁর’ নাটকেও অভিনয় করেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর প্রথম নজরুল সঙ্গীতের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন সনজীদা খাতুন-এর সঙ্গীত শিক্ষক এবং কাজী মোতাহার হোসেনের স্নেহভাজন। এই সূত্রে তিনি ছায়ানট সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকেই তিনি জড়িত ছিলেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে প্রথম বাংলা একাডেমীর বারান্দায় ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়। এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন সনজীদা খাতুন ও ফরিদা মালিক, আর নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন সোহরাব হোসেন। উল্লেখ্য এই বৎসরের  ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর থেকে আমৃত্য তিনি ছায়ানটের সাথে জড়িত ছিলেন। অসুস্থতার জন্য শেষ জীবনে তিনি সঙ্গীতের শিক্ষকতা ত্যাগ করলেও ছায়ানটের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল অটুট।

ছায়ানট ছাড়াও তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমী, শিল্পকলা একাডেমী ও নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট-এ শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন। নজরুলসংগীত প্রমাণীকরণ পরিষদ ও নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। নজরুল সঙ্গীতে তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে ছিলেন― সনজীদা খাতুন, শাহীন সামাদ, লায়লা আর্জুমাদ বানু,  সাদিয়া আফরিন মল্লিক, মাহমুদুর রহমান বেনু, খায়রুল আনাম শাকিল, সুমন চৌধুরী, আতিকুল ইসলাম, ইসমত আরা প্রমুখ।

২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ নভেম্বর, ঘাড়ে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলে পরের দিন সোহরাব হোসেনকে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাঁর মূত্রথলিতে আণুজৈবিক সংক্রমণ ছাড়াও নানাবিধ অসুখ-বিসুখ পরিলক্ষিত হয়। ২০১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ছয়টায় স্কয়ার হাসপাতালে তিনি পরলোক গমন করেন।

পরিবার
স্ত্রীর নাম সুরাতুন্নেচ্ছা। তিন মেয়ে- রওশন আরা, রাহাত আরা ও রিফাত আরা। দুই ছেলে- মোয়াজ্জেম হোসেন, মারুফ হোসেন। এর ভিতর রওশন আরা সোমা ও রাহাত আরা গীতি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী।

সন্মাননা

তথ্যসূত্র:
http://www.bbc.co.uk/bengali/news/2012/12/121227_mb_sohrab_hussain_dies.shtml
http://bn.wikipedia.org/
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-28/news/316785