ছবি : মমিনুল হক দুলু। সৌজন্য: ছায়ানট সংস্কৃতি সম্ভার |
|
![]() |
সন্জীদা খাতুন | ওয়াহিদুল হক |
-লোকে কিনছে-খাচ্ছে-গল্প করছে-নববর্ষ-সম্মিলন হচ্ছে সরবে। পাকুড় গাছের পাতা দুলিয়ে বইছে প্রভাতের ঝিরিঝিরি বাতাস। তানপুরা নিয়ে শাহীক আকতার গাইছে 'ভোরের হাওয়ায় এলে ঘুম ভাঙাতে কি?' সমবেত কণ্ঠে গাইছি 'আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে'- মানবসমাজের কাজে যাবার জন্য নতুন শপথ নিচ্ছি ভক্তিনত চিত্তে।'ছায়ানটের সকলাবেলার অপর অনুষ্ঠান 'পয়েলা বৈশাখ'। এ-উৎসবের বাঁধা জায়গা রমনা। একটি পাকুড় গাছের নিচে মঞ্চ। পাকুর গাছ বট নাম দিয়ে বটমূলের অনুষ্ঠান বলতে ভালোবাসতাম। এখানে মানুষের মেলা জমত প্রতি বছর। খোলা মাঠে গান হয় না বলে বিজ্ঞ সঙ্গীজ্ঞরা আমাদের নিরুৎসাহিত ও নিরস্ত করতে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমরা জানতাম এ-দিনের গান কেবল গাইবার আনন্দে গাওয়া। কেউ শুনলো কি না তা আমাদের গ্রাহ্য করবার দায় নেই। নববর্ষের জলযোগের দোকান বসেছে একদিক
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দে সরকারি বাধার কারণে বিদ্যায়তনের কার্যক্রম অগ্রণী বালিকা
বিদ্যালয়ে স্থানান্তরিত হয়। এরপর সরকারি চাপের মুখে বিদ্যালয়টি স্থানান্তরিত হয়
লেক সার্কাস গার্লস হাই স্কুলে। ওই বছরই ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে
প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে পালিত হয় ছায়ানটের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ৭-১৩ নভেম্বর : একে
বলা হয় গ্রেড ভোলা
সাইক্লোন।
প্রাণহানি ঘটেছিল ৫ লক্ষ।
চট্টগ্রাম, ভোলা, চরফ্যাসন, মনপুরা, সন্দ্বীপ, বরগুনা, খেপুপাড়া, পটুয়াখালী,
বোরহানুদ্দিন, চর তজুমদ্দিন, দক্ষিণ মাঈজদী, হারিয়াঘাটা এলাকার ওপর দিয়ে এ সময়
২০৫ কিলোমিটার/ঘণ্টা বেগে ঝড় হয়েছিল। জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা ছিল প্রায় ১০.৫ মিটার।
২০ হাজার জেলে নৌকা নিখোঁজ হয়েছিল। ১০ লক্ষাধিক গবাদিপশু মারা গিয়েছিল অথবা
হারিয়ে গিয়েছিল জলোচ্ছ্বাসে। বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছিল চার লাখের বেশি।
এই সময় পাকিস্তানের সামরিক শাসক ছিলেন
ইয়াহিয়া
খান। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানের এই দুর্গের সময়- ইয়াহিয়া
সরকার দুর্গত মানুষের জন্য কোনো সাহায্য দেয় নি। এই সময় ক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ দুর্গত মানুষের
সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসে। সাহায্যের এই উদ্যোগে মূখ্য ভূমিকা রেখেছিল ছায়ানট।
সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে
ওয়াহিদুল
হক, স্থপতি মাজাহারুল আনোয়ার, পটুয়া কামরুল হাসান, সৈয়দ
হাসান ইমাম প্রমুখের
প্রচেষ্টায় শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতারা সমাজ রাজপথে অর্থ সংগ্রহের উদ্যোগ নেওয়া
হয়েছিল। এই সময়
আলতাফ
মাহমুদ হারমোনিয়াম গলায় ঝুলিয়ে গান গেয়েছিলেন 'কাঁদো বাংলার
মানুষ আজিকে কাঁদো'। রাজপথের মিছিলের বাইরে অর্থ সংগ্রহের জন্য বেশ কিছু
অনুষ্ঠান করা হয়েছিল। এরপর অর্থ ও ত্রাণ সমগ্রী নিয়ে উড়ির চর ও কুকর মিকরিতে
গিয়েছিলেন
ওয়াহিদুল
হক, আতিকুল ইসলাম, সৈয়দ হাসান ইমাম. কামরুল হাসান।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত লেক সার্কাস গার্লস হাই স্কুলেই ছায়ানট
সঙ্গীতবিদ্যায়তনের কার্যক্রম চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বিদ্যায়তন বন্ধ হয়ে যায়।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ছায়ানটের কর্মীদের অনেকেই ভারতে আশ্রয় নেন এবং মুক্তিযুদ্ধের
পক্ষে কাজ করেন। আগ্রহী সংস্কৃতিকর্মীদের নিয়ে মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা গড়ে
তাঁরা স্বাধীনতার পক্ষে গান গেয়ে প্রচারণা চালান এবং যুদ্ধের জন্য অর্থ সংগ্রহ
করেন। স্বাধীনতার পরে ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে আবার কাজ শুরু করে ছায়ানট সঙ্গীতবিদ্যায়তন।
ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের অধ্যক্ষ ড. নূরুন নাহার ফয়জুন্নেসা তাঁর স্কুলে
ছায়ানটকে কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী বিষয়টি অনুমোদন করেন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে ছায়ানট বিদ্যায়তনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ঢাকার
বেইলি সড়কস্থ মহিলা সমিতি মঞ্চে পরিবেশিত হয়েছিল- রবীন্দ্রনাথের 'মায়ার খেলা'
গীতিনাট্য'।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে
ছায়ানট বিদ্যায়তনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর ঢাকার বেইলি সড়কস্থ মহিলা সমিতি মঞ্চে
পরিবেশিত হয়েছিল- রবীন্দ্রনাথের 'শ্যামা' নৃত্যনাট্য'।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ অক্টোবর ঢাকা শহরের উপর
দিয়ে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। এই রাত পৌণে আটটার দিকে জগন্নাথ হলের ছাদ ধ্বসে পড়ে
৫০ জনের মত- ছাত্র-কর্মী নিহত হন। মর্মান্তিক ওই ঘটনার পরের দিন ছায়ানট ও সম্মিলিত
সাংস্কৃতিক জোট শোক মিছিল করে। এই শোক মিছিলে ছায়ানটের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও
স্বেচ্ছাকর্মীরা 'দুঃখের তিমিরে যদি জ্বলে তব মঙ্গল আলোক' গানটি শোক মিছিলে
গেয়েছিলেন।
১৯৮৬-৮৭ খ্রিষ্টাব্দের দিকে শেখ হাসিনা (বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি,
প্রধানমন্ত্রী এবং ছায়ানটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী), ছায়ানটের রমনা বটমূলের আয়োজিত
নববর্ষের অনুষ্ঠানে আসেন। তাঁর আগমনকে কেন্দ্র করে- বিএনপির সমর্থকরা হট্টগোল তৈরি
করে। ছায়ানটের স্বেচ্ছাকর্মীরা মানববন্ধন সৃষ্টি করে তাঁকে রক্ষা করেন। এক সময় তিনি
মঞ্চে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। পরে কোনো অঘটন ছাড়াই তিনি নিরাপতে ফিরে যেতে পেরেছিলেন।
১৯৯০ বা ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে চারুকলা ইন্স্টিটিউটের বকুল তলায় প্রথম শরৎ-উৎসব
অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এতে অংশগ্রহণ করেছিলেন ছায়ানটের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপি
ক্ষমতায় আসার পর, মহসিন হলের ছাত্রদলের একাংশ ছায়ানটের স্বাভাবিক কার্যক্রমের
ব্যাপক ব্যাঘাত সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। এই সময়ে এরা ছায়ানটের তবলার শিক্ষার্থী এবং
স্বচ্ছাকর্মী মোহমদ আলীর মাথায় পিস্তলের বাট করে রক্তাক্ত করেছিলে। পরে তৎকালী
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য এবং সানজিদা খাতুনের প্রচেষ্টায় এই উপদ্রবকে কমিয়ে আনা
সম্ভব হয়েছিল।
ছায়ানটের স্থায়ী নতুন ভবন
ছায়ানটের সাড়ে চার দশকের
সংস্কৃতিসাধনার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রতিষ্ঠানকে স্বীয় কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৯৯
খ্রিষ্টাব্দে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এক বিঘা জমি বরাদ্দ দেন ধানমণ্ডিতে। এই
জমিতে সংস্কৃতি-ভবন নির্মাণ করে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে ব্যাপকতর অবদান রাখার
লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে ছায়ানট। ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের নক্শা প্রণয়ন করেছেন প্রখ্যাত
স্থপতি বশিরুল হক। এর জন্য তিনি কোনো সম্মানি নেন নি।
২০০০ খ্রিষ্টাব্দের ২৩মে প্রতীকী মূল্যে এক বিঘা জমিসহ ধানমণ্ডি ১৫/এ সড়কের ৭২
নম্বর বাড়িটি ছায়ানটকে সরকার দান করে।
২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ মে রাজউক ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের নকশা অনুমোদন করে। ২০০২
খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই মে থেকে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়। নানা জটিলতায় ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের
সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ভবন-নির্মাণ কাজ স্থগিত হয়ে যায়। নতুন করে নির্মাণ কাজ শুরু
হয় ২০০৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে। ২০০৬ সালের জুনে সংস্কৃতি-ভবনে শুরু হয়েছে
নিয়মিত কার্যক্রম। ভবন নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬ কোটি টাকা। ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের
নভেম্বর মাসে ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবনের উদ্বোধন করেন চিত্রশিল্পী আসমা কিবরিয়া।
২০০১ খ্রিষ্ঠাব্দের বোমা হামলা
২০০১ খ্রিষ্ঠাব্দে (১৪০৮বঙ্গাব্দ) রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজিত নববর্ষের
অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হয়। ওই হামলায় ১০ জন নিহত হন এবং বেশকিছু দর্শক আহত হন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক চেতনার মূলে আঘাত হানা এবং বাঙালি সংস্কৃতি
বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য সন্ত্রাসী ধর্মীয় গোষ্ঠী এই হামলা চালিয়েছিল। এই
আক্রমণে নিহতদের যে পরিচয় জানা গেছে- এঁরা হলেন
চট্টগ্রামের আবুল কালাম আজাদ (৩৫),
বরগুনার মোঃ জসীম (২৩),
ঢাকার হাজারীবাগের এমরান (৩২),
পটুয়াখালীর অসীম চন্দ্র সরকার (২৫),
পটুয়াখালীর মোঃ মামুন,
ঢাকার দোহারের আফসার (৩৪),
নোয়াখালীর ইসমাইল হোসেন ওরফে স্বপন (২৭),
পটুয়াখালীর শিল্পী (২০) ও
অজ্ঞাত একজন।
এই হামলার পর, ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন।
দুই মামলায় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ১৪ জঙ্গিকে আসামি করা হয়।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ ২০০৮
খ্রিষ্টাব্দে ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে।
এই মামলা দুটি
বিচারের জন্য ২০০৯
খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায় এবং ১৬ এপ্রিল মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।
এরপর, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এবং বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়।
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ জুন আটজনকে মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়ে নিম্ন আদালত
এটি রায় ঘোষণা করে।
মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে মুফতি হান্নানের সঙ্গে শফিকুর ছিলেন।
অন্যরা হলেন- আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর
ভাই মাওলানা মো. তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম
হাওলাদার ও আবদুল হাই।
দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে তাজউদ্দিন, বদর, হাফেজ জাহাঙ্গীর, শফিকুর ও আব্দুল
হাই পলাতক ছিলেন।
এরপর আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। একইসঙ্গে কারাবন্দি আসামিরা আপিল করে। উভয় আবেদনের ওপর ২০১৭
খ্রিষ্টাব্দের ৮ জানুয়ারি হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়।
২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়- শুদ্ধ সঙ্গীতের তিন দিন ব্যাপী উৎসব।
এই উৎসবের উদ্বোধন করেছিলেন- প্রখ্যাত সরোদ শিল্পী বুদ্ধদেব দাসগুপ্ত।
ছায়ানটের নিয়মিত সাংগঠনিক কার্যক্রমে ভিতরে রয়েছে-
![]() |
সৌজন্য: ছায়ানট সংস্কৃতি সম্ভার |