১৯০৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা যখন প্রাদেশিক
রাজধানীতে পরিবর্তিত হয়, তখন সাবেক হাইকোর্ট ভবন, কার্জন হল প্রভৃতির সঙ্গে এই
নির্মিত হয়েছিল। তখন এটি ছিল একটি দোতলা ভবন।
এই ভবনটি তৈরি করা হয়েছিল প্রশাসনিক উচ্চ পদস্থ ব্যক্তিদের অস্থায়ী আবাস স্থল
বা বাংলো হিসেবে ব্যবহারের জন্য। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ভবনের নাম কি ছিল তা
জানা যায় না। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার গভর্নরের শাসন-পরিষদের
সদস্য বর্ধমানের মহারাজা বিজয়চন্দ্র মাহতাব (১৮৮৭-১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) এবং ১৯২৪
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি এই পদে ছিলেন। এই সময়ের ভিতরে গভর্নরের শাসন পরিষদের
সদস্য হিসেবে তাঁকে তৎকালীন প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকায় বছরে একবার আসতে হতো। তিনি ওই
সময় এ বাড়িতে রাজকীয় অতিথি হিসেবেই বাস করতেন। কালক্রমে এই ভবনটির নাম বর্ধমান হাউজ
নামে পরিচিতি লাভ করে।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের ১লা জুলাই রমনা এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এই
সময় বর্ধমান হাউস বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ভিতরে পড়ে। এই সূত্রে কিছুটা সময় এটি
বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসস্থল হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দের দিকে অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন বর্ধমান হাউসের একটি অংশে বাস
করতেন এবং তার অফিস ছিল বর্ধমান হাউজের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলার ল্যান্ডিংয়ের বাঁ
দিকের ঘরটি। এই সময় তিনি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের হাউস টিউটর ছিলেন। উল্লেখ্য, কবি
কাজী নজরুল ইসলাম যখন ঢাকায় এসেছিলেন, তখন তিনি এই ভবনে কিছুদিন ছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত বর্ধমান হাউস উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তাদের অতিথিশালা হিসেবে
ব্যবহৃত হয়েছে।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে ভবনটিতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও প্রদর্শনীর জন্য
ব্যবহৃত হতো।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ আগস্ট থেকে ১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত, এই ভবনটি পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন হিসেবে
ব্যবহৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ও
দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী নূরুল আমিনের বাসভবন। ফলে পূর্ব বাংলার জনস্বার্থবিরোধী সকল
কর্মপন্থা, নীতি ও চক্রান্ত এই বর্ধমান হাউস থেকেই পরিচালিত হতো। ১৯৫৪
খ্রিষ্টাব্দের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য যুক্তফ্রন্ট নামে একটি
রাজনৈতিক মোর্চার গঠিত হয়।
আওয়ামী লীগের
উদ্যোগে ১৭ জুন ঢাকার পল্টন ময়দানের একটি জনসভা হয়। এই জনসভা থেকে পূর্ব
পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করে একুশ দফা ঘোষণা করা হয়। এই একুশ দফার ষোড়শ দফা
ছিল -'বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে কম বিলাসের বাড়িতে যুক্তফ্রন্টের প্রধান মন্ত্রীর
অবস্থান করা এবং বর্ধমান হাউসকে প্রথমে ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে
পরিণত করা।' ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়ী হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার শিক্ষামন্ত্রী সৈয়দ আজিজুল হক (নান্না মিয়া) প্রথম বর্ধমান
হাউসকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করার জন্য একটি পরিকল্পনা প্রস্তুত করার
প্রাথমিক নির্দেশ দেন। ইতিমধ্যে বাংলা ভাষার গবেষণার জন্য একটি পৃথক প্রতিষ্ঠান
তৈরির ভাবনা অনেকেই ভেবেছিলেন। সেই সূত্রে সৃষ্টি হয়েছিল বাংলা একাডেমি। এই
একাডেমির কার্যালয় হিসেবে বর্ধমান হাউসকে নির্বাচন করা হয়েছিল।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩ ডিসেম্বর আবু হোসেন সরকার বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমীর
উদ্বোধন করেন। যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী নূরুল
আমিন বর্ধমান হাউস ত্যাগ করেন। একাডেমীর প্রথম কার্যালয় হিসেবে একতলার পূর্বদিকের
তিনটি কক্ষ ব্যবহার করা শুরু হয়। তবে পুরো ভবনটি খালি করতে প্রায় এক বছর লেগে যায়।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে এখানে বাংলা একাডেমির অফিস হিসেব ব্যবহৃত হওয়া শুরু হয়।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে বাড়ির মূল কাঠামো এবং সামঞ্জস্য রেখে তিন তলা ভবনে উন্নীত করা
হয়।
১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে
খ্রিষ্টাব্দে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে প্রথম বর্ধমান হাউসের বারান্দায় সঙ্গীত শেখার
ক্লাস শুরু হয়।
এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন সনজীদা খাতুন ও ফরিদা খান (বারি
মালিক), নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন
সোহরাব
হোসেন, তবলা শেখাতেন বজলুল করিম, বেহালা ও সেতার শেখাতেন মতি মিয়া।
এই বৎসরের ছায়ানট
সঙ্গীত বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৩৭০ বঙ্গাব্দে ১লা বৈশাখ-এ (এপ্রিল ১৯৬৩
খ্রিষ্টাব্দ) তৎকালীন ইংলিশ প্রিপারোটরি স্কুলে সঙ্গীতবিদ্যায়তনের আনুষ্ঠানিক
যাত্রা শুরু হয়। উদ্বোধন করেছিলেন ওস্তাদ আয়াত আলী খান, আর বিদ্যায়তনের
দ্বারোদ্ঘাটন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। বিদ্যায়তনের প্রথম অধ্যক্ষ হয়েছিলেন
ঢাকা বেতারের গুণী যন্ত্রী মতি মিঞা (মতিয়র রহমান খান)।
[দেখুন:
বাংলা একাডেমি]
তথ্যসূত্র:
ছায়ানট। সন্জীদা খাতুন। স্থির প্রত্যয়ে যাত্রা। ছায়ানট। ফেব্রুয়ারি ২০১১।
পেরিয়ে এলাম অন্তবিহীন পথ। সারওয়ার আলী। কার্তিক ১৪১৭, নভেম্বর ২০১০।
ছায়ানটের জন্মকথা। ওয়াহিদুল হক