বাংলা ভাষায় রচিত সাহিত্যের ইতিহাস সুপ্রাচীন।
কিন্তু এই ভাষায় বিজ্ঞান, দর্শন ইত্যাদির জন্য বাংলা ভাষা উপযুক্ত কিনা এ নিয়ে
অনেকের সন্দেহ ছিল। এ সকল বিষয়ে অনেকে বাংলাতে গ্রন্থ রচনা করার পরও বাংলাভাষার এই
জাতীয় তথাকথিত দুর্বলতা নিয়ে হীনমন্যতায় ভুগতেন। এই কারণে অনেকেই বাংলা ভাষা চর্চা
এবং গবেষণার জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কথা ভেবেছিলেন। অবিভক্ত বাংলায় এই
উদ্দেশ্যে সৃষ্টি হয়েছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ।
১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে মহামহোপাধ্যায়
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায়
মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ বাংলা ভাষায় জ্ঞানসাধনা
ও সাহিত্যচর্চার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এ বিষয়ে তেমন কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা
সম্ভব হয়ে উঠে নি। ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে
আবুল কাশেম ফজলুল হক-এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত অল
ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশন কনফারেন্সে
মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ, তৎকালীন বাংলা সরকারকে
একটি অনুবাদ বিভাগ স্থাপনের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু এ অনুরোধও শেষ পর্যন্ত রক্ষিত
হয় নি। ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকভারত বিভাজনের মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল বিভাজিত
হয়ে যায়। ফলে পূর্ব-পাকিস্তানের মানুষ নিজেদের মতো করে বাংলা ভাষা গবেষণার ক্ষেত্র
প্রস্তুত করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তদানীন্তন পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ভাষা শুধু
উর্দুকে নির্বাচন করলে, বাংলা ভাষা একটি বড় ধরনের হুমকির মুখে পড়ে। ফলে ১৯৪৮
খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে
বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি ও শিক্ষার ভাষা
হিসেবে দাবি তোলা হয়। একই সাথে
উর্দুর পাশাপাশি
বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবিও
তোলা হয়। এই আন্দোলনের ভিতরেই ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর ঢাকায়
পূর্ব-পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলন হয়। এই সভার সভাপতির অভিভাষণে
মুহম্মদ
শহীদুল্লাহ
বাংলাভাষার গবেষণার জন্য একটি একাডেমি গড়ার কথা বলেন।
পাকিস্তানিদের
বাংলা ভাষা বিরোধী মনোভাবের সূত্রে
বাংলাভাষা আন্দোলন তীব্রতর রূপ লাভ করে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে
ফেব্রুয়ারি আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার উপর পুলিশ গুলি বর্ষণ করলে
প্রায় তিন শতাধিক মানুষ হতাহত হয়। ঢাকাতে ওই দিন চারজন
আন্দোলনকারী নিহত হন। এরপর পাকিস্তান সরকার
বাংলাভাষা কে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি
দিতে বাধ্য হয়। এই অবস্থায় বাংলা ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতির গবেষণা ও চর্চার
কেন্দ্ররূপে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার দাবি আরও জোরালো হয়ে উঠে।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ
করে।
কিন্তু নানা কারণে তা ব্যর্থ হয়।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের ১০ মার্চ অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচন পূর্ববাংলা আইনসভার নির্বাচনে বিজয়ী
হয় যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন-পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী প্রথম বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার
প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু ৩০শে মে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। ফলে বাংলা একাডেমি স্থাপনের এই প্রচেষ্টা
ব্যর্থ হয়।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দের নির্বাচনে দ্বিতীয় বার যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। এই নতুন সরকার
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ৩ ডিসেম্বর ঐতিহাসিক
বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমির উদ্বোধন করেন। এই প্রতিষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন
তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী আবুল হোসেন সরকার। শুরুর দিকে
প্রাদেশিক পূর্ববাংলা সরকার বাংলা একাডেমী পরিচালনার জন্য প্রথমে একটি প্রিপারেটরি
কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটির সম্পাদক ও স্পেশাল অফিসাররূপে মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তখন তার পদবী ছিল 'স্পেশাল অফিসার'।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১লা ডিসেম্বর মুহম্মদ এনামুল হক
(১৯০২-১৯৮২) একাডেমির প্রথম পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই বছরে এই একাডেমি
থেকে প্রথম প্রকাশিত হয় দৌলত উজির বাহরাম খান রচিত 'লাইলী মজনু'। বইটির সম্পাদনা
করেছিলেন আহমদ শরীফ।
১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘দি বেঙ্গলী একাডেমী অ্যাক্ট’ অনুসারে, এটি
সরকারি অর্থে পরিচালিত স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করে। এই বছরের
জানুয়ারি মাস থেকে বাংলা একাডেমি “বাংলা একাডেমি পত্রিকা” প্রকাশ করা শুরু করে।
প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পাওয়ার পর, বাংলা একাডেমিকে ফ্রান্সের
ফ্রেঞ্চ একাডেমির আদর্শে কর্মকাঠামো পরিচালনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। এই
সূত্রে বাংলা একাডেমির কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়- বাংলা ভাষা গবেষণা, বিদেশী
ভাষায় রচিত গ্রন্থাদির অনুবাদ,
বাংলা ভাষা-সাহিত্যের সংকলন ইত্যাদি প্রকাশের ব্যবস্থা রাখা হয়। এছাড়াও বাংলা
একাডেমির নিজস্ব গ্রন্থাগার তৈরি করার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।
একাডেমীর গৃহীত কর্মসূচিতে ধীরে ধীরে যুক্ত হয়- প্রাচীন ও
মধ্যযুগীয় পুথি সংগ্রহ ও সম্পাদনাসহ, লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে-লোকসঙ্গীত, লোককাহিনী, ছড়া, ধাঁধা ইত্যাদি
সংগ্রহ ও প্রকাশের কার্যক্রম যুক্ত হয়। ভাষা গবেষণার অংশ হিসেবে ব্যাকরণ ও অভিধান
প্রণয়নে বাংলা একাডেমি বিশেষ কার্যক্রম পরিচালনার দাবিদারও হয়ে উঠে। ধীরে ধীরে এই
একাডেমি বিশিষ্ট ব্যক্তবর্গকে বাৎসরিক পুরস্কার দেওয়ার ব্যবস্থা প্রণয়ন করে।
পাকিস্তানি শাসনামলে একাডেমির অর্থসংস্থান করতো পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক সরকার। ১৯৬০-৬১ অর্থবছরে
বাংলা একাডেমির জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ ছিল দুই লাখ টাকা। এছাড়া কেন্দ্রীয় সরকারের এক লাখ
টাকার নিয়মিত অনুদানও ছিল।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে, সরকার পরিচালিত কেন্দ্রীয় বাংলা-উন্নয়ন
বোর্ডকে বাংলা একাডেমীর সঙ্গে একীভূত করে। এই সময় পরিচালকের পদমর্যাদা মহাপরিচালকে
উন্নীত করা হয়।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো এই বছরকে ‘আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ’ হিসেবে ঘোষণা করে।
গ্রন্থমেলায় আগ্রহী সর্দার জয়েনউদ্দীন এই আন্তর্জাতিক গ্রন্থবর্ষ উপলক্ষে ১৯৭২
খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে একটি আন্তর্জাতিক গ্রন্থমেলার
আয়োজন করেন। সেই থেকেই বাংলা একাডেমিতে বইমেলার সূচনা হয়।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে এই একাডেমি সৃজনশীল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা 'উত্তরাধিকার'
প্রকাশ করা শুরু করে। ১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দ থেকে পত্রিকাটি ত্রৈমাসিকে রূপান্তরিত হয়।
অবশ্য পরে ধীরে ধীরে পত্রিকাটি অনিয়মিত হয়ে পড়ে। তবে, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই
থেকে মাসিক হিসেবে এটি প্রতিমাসে নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। বাংলা একাডেমির
ত্রৈমাসিক মুখপত্র লেখা ২০০৯ আগস্ট মাস থেকে ‘বাংলা একাডেমি বার্তা’ নামে প্রকাশ করা হচ্ছে।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেছিলেন। এই
মেলা উপলক্ষে সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বইয়ের স্টল
দিয়েছিলেন। এই বছরই প্রথম বাংলা একাডেমি তাদের বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বই
বিক্রয়ের ব্যবস্থা করে।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কাজী মনজুরে মওলা, বাংলা একাডেমিতে
প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’র আয়োজন সম্পন্ন করেন। এই সময় তৎকালীন এরশাদ সরকারের
বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল চলাকালীন সময়ে,
পুলিশের ট্রাকের চাকার নিচে পড়ে দুজন ছাত্র নিহত হয়। ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই
বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি।
১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলাকে 'অমর একুশে গ্রন্থমেলা'
আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়।
বর্তমানে বাংলা একাডেমির অন্যতম কার্যক্রম গ্রন্থ প্রকাশ। এছাড়া অন্যান্য
উল্লেখযোগ্য কার্যক্রমগুলোর ভিতরে রয়েছে- নানা ধরনের আলোচনা ও
বক্তৃতা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ভাষা আন্দোলনের মাস হিসেবে ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে অমর একুশের
বইমেলা। এসব কার্যক্রমের বাইরে রয়েছে বিশেষ ভাষা প্রশিক্ষণ, কম্পিউটারভিত্তিক
বাংলাভাষার কারিগরি প্রশিক্ষণকর্ম, তরুণ লেখক প্রকল্প, গবেষণাবৃত্তি প্রদান
ইত্যাদি।
বাংলা একাডেমীর সর্বোচ্চ পরিষদ হচ্ছে ফেলো এবং আজীবন-সদস্য ও সদস্যদের দ্বারা গঠিত
একটি সাধারণ পরিষদ। বার্ষিক সাধারণ সভাগুলিতে সাধারণ সদস্যদের বক্তব্য ও প্রস্তাব
উপস্থাপিত হয়। ফেলো, আজীবন-সদস্য ও সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত ৬জন প্রতিনিধি এবং
অন্যান্য সদস্যদ্বারা গঠিত কার্যনির্বাহী পরিষদ একাডেমীর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে
থাকে।
সূত্র :
- বাংলাপেডিয়া