১. বিহার অঞ্চল: মাগধি প্রাকৃতির মিশ্রণ
২. মথুরা অঞ্চল: ব্রজ ভাষার শব্দ মিশ্রণ
৩. দিল্লী, লক্ষ্ণৌ অঞ্চল: আরবি-ফার্সি ভাষার শব্দমিশ্রণ
৪. কাশী অঞ্চল: সংস্কৃত শব্দের মিশ্রণ।
৫. রাজপুতনা অঞ্চল: জয়পুর, যোধপুর ও বিকানে মাড়ওয়াড়ি শব্দের মিশ্রণ।
ভারতের দিল্লী ও আশপাশের অঞ্চলে স্থানীয় অধিবাসীদের ভিতরে প্রচলিত হিন্দুস্থানী ভাষার সাথে আরবি-ফার্সি শব্দের মিশ্রণ ঘটেছিল, মুসলমানদের সূত্রে।
খ্রিষ্টীয় ৮ম-১০ম শতাব্দীর ভিতরে
ভারতে মুসলিম আক্রমণের সময়, উত্তর ভারতের খারি
বোলি কথ্য ভাষা থেকে হিন্দির উৎপত্তি ঘটে। খাড়ি বোলি ছিল দিল্লি এলাকার ভাষা।
বহিরাগত মুসলিম শাসক এবং এদের সৈন্যদের সাথে স্থানীয় খাড়ি বোলি ভাষার
অধিবাসীদের যোগাযোগের সময় একধরনের মিশ্র শব্দের ভাষার জন্ম হয়েছিল। এর বাক্যরীতি
ছিল হিন্দির মতো। কিন্তু বিদেশী মুসলমানরা এর সাথে আরবি, ফার্সি, তুর্কি শব্দ
ব্যবহার করতো প্রচুর। এই সময় সৈন্য শিবিরের ভাষা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া
শুরু হয়েছিল রাজশক্তির সাথে সুসম্পর্ক রাখা এবং রাজশক্তিকে মান্য করার
সূত্রে। তারপরেও এটি তখনও কোনো জাতি গোষ্ঠীর মাতৃভাষা হয়ে উঠে নি। কারণ সাধারণ
মানুষ নিজেদের ঘরে ফিরে তাঁদের মাতৃভাষায় কথা বলতো, পক্ষান্তরে মুসলমানরাও তাঁদের
ভিতরে মাতৃভাষায় কথা বলতো
১২০০ থেকে ১৪০০ খ্রিষ্টাব্দের ভিতরে নানা ভাষার মুসলমান সৈন্যের পাশাপাশি স্থানীয়
সৈন্যরাও শিবিরে স্থান পেতে শুরু করলো। ফলে মিশ্ররীতির ভাষাটি একমাত্র
আন্ত-যোগাযোগের ভাষায় পরিণত হয়ে গিয়েছিল। এ মিশ্রিত বুলিকে ভাষাতাত্ত্বিকরা
বলে থাকেন- খাড়িবুলি, রিখতা এবং হিন্দুস্থানি।
উল্লেখ্য, দিল্লির
ফার্সি কবি আমীর খসরু
(১২৫৩-১৩২৫) এবং হিন্দি কবি কবির দাসের (১৪৪০-১৫১৮) কবিতায় খাড়িবুলির নমুনা
পাওয়া যায়।
মোগল সম্রাট শাহজাহান-এর (১৬২৮-১৬৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) সেনানিবাসের নাম ছিল
উর্দু-এ-মুআল্লা। এখানে বিভিন্ন এলাকার সৈন্যরা খাড়িবুলি হিন্দিতেই পরস্পরের
ভিতরের কথা বলতো। শাহজাহান তাঁর সেনানিবাসের নামে এ ভাষার নামকরণ করেন উর্দু। এই
সময় কোনো কোনো মুসলমান কবি সাহিত্যিকরা উর্দু ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু করেন।
উর্দু সাহিত্য
আঠারো শতকের গোড়ার কবি ওলী আওরাঙ্গবাদীর (১৬৬৮-১৭৪৪) সাহচর্যে দিল্লিতে উর্দু
কাব্যচর্চার সূত্রপাত হয়। পরবর্তী সময়ে ফায়েজ (মৃত্যু ১৭১৫), মাজমুন (মৃত্যু
১৭৪৭), আরজু (মৃত্যু ১৭৪৮) প্রমুখ কবি
ফার্সি ভাষার পাশাপাশি
উর্দুতেও কাব্যরচনা করেন।
বঙ্গদেশে
ফার্সি ও উর্দু ভাষায় প্রথম
সাহিত্যচর্চা শুরু হয়েছিল মুর্শিদাবাদে।
মুরশিদকুলি খাঁ
(আনুমানিক ১৬৬৫-১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ),
শুজাউদ্দীন খাঁ ও
আলীবর্দী খান (১৬৭১-১৭৫৬ খ্রিষ্টাব্দ), আমলে মুর্শিদাবাদ, আজিমাবাদ,
হুগলি ও ঢাকা মুসলিম কৃষ্টি ও ফারসি সাহিত্যচর্চার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত
হয়। রাষ্ট্রভাষা
ফার্সির পাশাপাশি উর্দুর
চর্চাও ক্রমে ক্রমে সচল ছিল।
আলীবর্দী খান সময় মুহাম্মদ ফকীহ দরদমন্দ (মৃত্যু ১৭৪৭) নামে একজন
উর্দু কবির সন্ধান পাওয়া যায়।
নবাব
সিরাজদৌল্লা (১৭৩২-১৭৫৭) নিজে উর্দু ও
ফার্সি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক
ছিলেন। এই সময় কুদরাতউল্লা কুদরাত ও ফারহাতউল্লা ফারহাত তাঁর সভাকবিরূপে খ্যাতি লাভ
করেছিলেন।
মীরজাফর-এর
(১৬৯১-১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) সময় মীর মুহম্মদ শরফ নামের একজন উর্দু কবির কথা
জানা যায়। আঠারো শতকের শেষদিকে মুর্শিদাবাদে উর্দু সাহিত্যিক ও কবি হিসেবে
ইনশাল্লাহ খান ইনশা (মৃত্যু ১৮১৮) সুনাম অর্জন করেছিলেন। তিনি দরিয়া-এ-লতাফত
(১৮০৮) নামে
ফার্সি ভাষায় প্রথম উর্দু
ব্যাকরণ রচনা করেন।
মহীশূরের শাসনকর্তা টিপু সুলতান (১৭৫০-১৭৯৯
খ্রিষ্টাব্দ) পরাজিত ও নিহত হলে- তাঁর পরিবারকে কলকাতার টালিগঞ্জে স্থানান্তরিত করা
হয়। এই পরিবারে সূত্রে কলকতায় উর্দুতে জ্ঞানচর্চা, কাব্যসাধনার নব দিগন্ত উন্মোচিত
হয়েছিল। উল্লেখ্য এ পরিবারেই উর্দু সাহিত্যক তাওফিক (মৃত্যু ১৮৮৪), সুলতান, রহিম
প্রমুখের ন্যায় কবিসাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেন। আযিমউদ্দীন সুলতান ছিলেন মুহম্মদ
বশিরউদ্দীন তাওফিকের সহোদর। তিনি প্রধানত ফারসি ও উর্দু ভাষায় কবিতা রচনা করেছেন।
নবাব শামসউদ্দৌলার (১৭৭০-১৮৩১) পৃষ্ঠপোষকতায় ঢাকায় মির্জা জান তাপিশসহ বহু উর্দু
কবির সমাগম ঘটে। উল্লেখ্য, মির্জা জান তাপিশের জন্মস্থান ছিল দিল্লি। ১৭৮৬
খ্রিষ্তাব্দের দিকে তিনি বঙ্গদেশে আগমন করেন। তিনি প্রথমে দশ-বারো বছর ঢাকায়
ছিলেন। ইংরেজদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে শামসুউদ্দৌলাহকে কলকাতায় কারাবন্দী
করে রাখা হয়। এই সময় মির্জা জান তাপিশ কলকাতা গিয়ে ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে চাকরি
গ্রহণ করেন। ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি শামসুল বায়ান-ফী-মুসতালাহাত-এ-হিন্দুস্থান
(১৭৯২) নামে উর্দু বাগধারা, পরিভাষা ও প্রবাদ সম্পর্কে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। ১৮৪৪
খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থটি পরে মুর্শিদাবাদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। তাপিশের উর্দু কাব্য
কুল্লিয়াত (১৮১২) ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ থেকে প্রকাশিত হয়।
উর্দু সাহিত্যের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ওয়াজিদ আলী শাহ্ (১৮২২-১৮৮৭)। উল্লেখ্য,
তিনি বন্দি অবস্থায় কলকাতায় নির্বাসিত হন এবং পরে মেটিয়া বুরুজ মহল্লায় বসতি
স্থাপন। তিনি উর্দু-ফারসিতে ছোটবড় প্রায় চল্লিশটি গ্রন্থ রচনা করেন। অবশ্য
সঙ্গীতজ্ঞ ও সঙ্গীতরচয়িতা হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল সবচেয়ে বেশি। তাঁরই
পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে লক্ষ্ণৌতে এবং পরে কলকাতায় উর্দু সাহিত্য ও সঙ্গীতের বিশেষ
উৎকর্ষ সাধিত হয়। সঙ্গীত ও সাহিত্যের বিচারে তাঁর মেটিয়া বুরুজ মহল্লা দ্বিতীয়
লক্ষ্ণৌ-এ পরিণত হয়েছিল। এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কবিসাহিত্যিকের মধ্যে ছিলেন নওয়াব
ফাতহুত-দৌলাহ, মির্জা মুহাম্মদ রিযা খাঁ বারক, মাহতাব-উদ-দৌলাহ্, মাওলানা আবদুল
হালিম সরকার প্রমুখ্য।
ব্রিটিশ ভারতে ব্রিটিশ কর্মচারীদের উর্দু
শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে, কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে উর্দু শিক্ষার
ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে উর্দু ভাষা ও সাহিত্যের ক্রমোন্নতি ঘটতে থাকে। এই
কলেজ থেকে মীর আম্মান, শের আলী আফসোস, হায়দর বখশ হায়দরী (মৃত্যু ১৮২২) প্রমুখকে
আরবি ও ফারসি গ্রন্থের সহজ-সরল উর্দু অনুবাদ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। মীর
আম্মানের বাগ-ও-বাহার (১৮০২) উর্দু গদ্যসাহিত্যের ইতিহাসে একটি বিখ্যাত গ্রন্থ।
ফোর্ট ইউলিয়ম কলেজে উর্দু ছাপাখানা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কলকাতায় প্রথম উর্দু বই
প্রকাশেরও সুযোগ সৃষ্টি হয়। ১৮২২ খ্রিষ্টাব্দের ২৭শে মার্চ কলকাতা থেকে উপমহাদেশের
প্রথম উর্দু পত্রিকা জাম-এ-জাঁহানুমা (সাপ্তাহিক) প্রকাশিত হয়।
ঢাকার আগা আহমদ আলী ইস্পাহানী (১৮৩৯-১৮৭৩) প্রধানত ফারসি ভাষার সাহিত্যিক ছিলেন,
তবে তিনি উর্দুচর্চাও করতেন। কথিত আছে আগা আহমদ আলী ও মির্জা গালিবের মধ্যে
সাহিত্যিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। রিসালা-এ-মুখতাসেরুল ইশতেকাক (১৮৭১) তাঁর উর্দু
রচনা।
তথ্যসূত্র :
http://www.ethnologue.com
বাংলাপেডিয়া