মুর্শিদকুলি খাঁ
(আনুমানিক ১৬৬৫-১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দ)
বাংলার প্রথম নবাব। মোগল সম্রাট
আওরঙ্গজেব-এর মৃত্যুর পর প্রথম বাংলার স্বাধীন নবাব হন।

মুর্শিদকুলি খাঁ দাক্ষিণ্যাত্যের এক ব্রাহ্মণ পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তাঁর পিতামাতা, হাজি শফি ইসফাহানি নামক জনৈক ইরানি বংশোদ্ভুত একজন উচ্চপদস্থ মোগল কর্মকর্তার কাছে বিক্রয় করেন। শফি ইসফাহানি এঁর নতুন নামকরণ করেন মহম্মদ হাদী। তিনি হাদীকে পুত্র স্নেহে লালনপালন করেন। শফি ইসফাহানি নিজ দেশ পারশ্যে ফিরে যাওয়ার সময় হাদীকে সাথে নিয়ে যান। সেখানে হাদী ফার্সি ভাষা এবং সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হন। শফি ইসফাহানি দিল্লিতে দেওয়ান-ই-তান-পদে নিযুক্ত হলে, হাদী তাঁর সাথে দিল্লীতে আসেন। সেখানে তিনি দেওয়ানি কার্যক্রম সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে জ্ঞান লাভ করেন।

১৬৯৬ খ্রিষ্টাব্দে শফি ইসফাহানি মৃত্যুবরণ করলে, তিনি বেরার প্রদেশের দেওয়ান হাজী আবদুল্লাহ খোরাসানীর অধীনে চাকরিতে যোগদান করেন। এই সময় দেওয়ানি কাজে দক্ষতার পরিচয় দিলে,
সম্রাট আওরঙ্গজেব এই বছরের শেষের দিকে হায়দ্রাবাদের দেওয়ান পদে নিয়োগ দেন। এই সময় আওরঙ্গজেব তাঁর নামকরণ করেছিলেন 'মুর্শিদকুলি খাঁ'। এখানে যোগ্যতার সাথে তাঁর দায়িত্ব পালনের সূত্রে, আওরঙ্গজেব-এর বিশেষ আস্থা লাভ করেন।
এই সূত্রে ১৭০০ খ্রিষ্টাব্দে
আওরঙ্গজেব তাঁকে 'করতলব খান' উপাধি প্রদান করেন এবং দেওয়ান পদে অভিষিক্ত করে বঙ্গদেশে পাঠান।

উল্লেখ্য, এই সময় বাংলার সুবাদার ছিলেন
আওরঙ্গজেব-এর পৌত্র আজিম-উস-শান্ (প্রথম বাহাদুর শাহের পুত্র)। বাংলার সুবাদার আজিম-উস-শান নিজে এবং তাঁর সময়ের দেওয়ানগণ রাজকার্যের পাশাপাশি বৈধ-অবৈধ বাণিজ্য ও অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে প্রচুর সম্পদের মালিক হন। এই কার্যকলাপে মুর্শিদকুলি খাঁ বাধা দেন এবং তিনি এ বিষয়ে আওরঙ্গজেবকে বিস্তারিত লিখে জানান। আওরঙ্গজেব এই সম্পদ আহরণের পথ বন্ধ করার ফলে, সুবাদারের বিপুল পরিমাণ আয় বন্ধ হয়ে যায়। এরপর আজিম-উস-শান রাজকোষ থেকে অর্থ গ্রহণের চেষ্টা করেন। এই বিষয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ বাধা দিলে, আজিম-উস-শান তাঁকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করেন। এই বিষয়ে মুর্শিদকুলি খাঁ আওরঙ্গজেবকে জানান।
১৭০২ খ্রিষ্টাব্দে
আওরঙ্গজেব তাঁকে গঙ্গার তীরবর্তী (ভাগীরথী শাখা) মখসুদাবাদে দফতর স্থানান্তরের অনুমতি দেন। অন্যদিকে সম্রাট তাঁর দৌহিত্রকে পাটনায় প্রেরণ করেন এবং নায়েবের মাধ্যমে প্রদেশ শাসনের আদেশ দেন।

১৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি সম্রাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে দাক্ষিণাত্য যান। তাঁর কাজে সন্তুষ্ট হয়ে সম্রাট  ‘মুর্শিদকুলী খান’ উপাধি প্রদান করেন এবং সম্রাট তাঁকে অনুমিত ক্রমে মখসুদাবাদের নাম রাখেন মুর্শিদাবাদ। ১৭০৪ সালে দাক্ষিণাত্য থেকে ফিরে এসে তিনি এই নাম কার্যকর করেন।

১৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর, দিল্লির সিংহাসনে বসেন প্রথম
বাহাদুর শাহ, প্রথম। এই সময় মুর্শিদকুলি খাঁকে শাস্তিস্বরূপ দাক্ষিণ্যত্যে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ১৭১০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁক পুনরায় বাংলার দেওয়ান পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

১৭১২ খ্রিষ্টাব্দে
প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যুর পর দিল্লির সিংহাসনে বসেন আজিম-উস-শান-এর পুত্র ফারুকশিয়ার। এই সময় মুর্শিদকুলি খাঁ নতুন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। সম্রাট খুশি হয়ে ১৭১৩ খ্রিষ্টাব্দে মুর্শিদকুলিকে বাংলার দেওয়ান এবং নায়েব-সুবাদার পদ দান করেন। ১৭১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে উড়িষ্যার সুবাদার করা হয় এবং সম্রাট তাঁকে জাফর খাঁ উপাধি প্রদান করেন।

১৭১৬ খ্রিষ্টাব্দে সম্রাট তাঁকে নাজিম পদে উন্নীত করেন।
১৭১৭ 
খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে বাংলায় এনে সুবাদার পদ দেওয়া হয়। এই সময় তিনি বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন।
১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দশসালা আইন প্রবর্তন ভেতর বঙ্গদেশে দেশে মোগল শাসনাধীন জমিদারি প্রথার সূচনা করেন
১৭২৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন।

অপুত্রক অবস্থায় মৃত্যুবরণের আগে তিনি তাঁর দৌহিত্র সরফরাজ খাঁকে সিংহাসনের উত্তরাধিকার করে যান। অবশ্য তাঁর মৃত্যুর পর, সিংহাসন নিয়ে তাঁর জামাত
সুজাউদ্দিন খাঁর বিবাদ উপস্থিত হয়। পরে আত্মীয় স্বজনদের মধ্যস্থতায় নবাব হন সুজাউদ্দিন খাঁ

মুর্শিদকুলি খাঁ বাংলার সুবাদার থাকলে, দিল্লির সম্রাটের রাজশক্তির ক্ষয়ের কারণে তিনি স্বাধীন হয়ে পড়েন। তাঁর শেষ জীবনে তিনি স্বাধীন নবাবের মতোই বাংলা শাসন করেছেন। এই কারণে তাঁকে বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৭৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানি, দিল্লির মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছে বাংলা বিহার উড়িষ্যার দেওয়ানি প্রাপ্তির পর এই বাংলার নবাব-শাসনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
    [দেখুন:
বাংলায় বার ভুঁইয়া-উত্তর মোগল শাসন]


সূত্র: