সন্‌জীদা খাতুন
১৯৩৩ -২০২৫ খ্রিষ্টাব্দ
লেখক, গবেষক, সংগঠক, সাংবাদিক, সঙ্গীতশিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, শিক্ষক, শিক্ষাবিদ।

১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ৪ এপ্রিল , ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন - জাতীয় অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন। মায়ের নাম- সাজেদা খাতুন। স্বামী: ওয়াহিদুল হক । সন্তানাদি: অপালা ফরহত নবেদ, পার্থ তানভীর নভেদ্, ও রুচিরা তাবাস্সুম নভেদ্।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হিসেবে আন্দোলনের শুরু থেকেই সন্‌জীদা খাতুন সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি তাঁর বিকেলে মাকে নিয়ে অভয় দাস লেনের এক বাসাতে যান। উদ্দেশ্য ছিল- মহিলাদের প্রতিবাদ সভায় যোগ দেওয়া। সভায় গিয়ে দেখেন কবি সুফিয়া কামাল, বেগম দৌলতুন্নেসা, নূরজাহান মুরশিদ প্রমুখ উপস্থিত। কিন্তু সেদিন সে পরিস্থিতিতে কেউ সভার সভাপতি হতে চাননি। শেষ পর্যন্ত সন্‌জীদা খাতুনের  মা সাজেদা খাতুনকে সভাপতির আসনে বসিয়েছিলেন। এই সভায় তিনি সম-সমাসায়িক  পরিস্থিতির উপর বক্তৃতা করেন।

১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে সম্মানসহ স্নাতক-সহ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি 'নজরুল স্বরণপদক' লাভ করেছিলেন।

১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দ তিনি বাংলাদেশ বেতারে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

১৯৫৭ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়রে 'বাংলা ভাষা ও সাহিত্য' বিষয়ে অধ্যপনা শুরু করেন।

১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে  ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে পালিত রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকীর আয়োজকদের মধ্যে তিনি ছিলেন। রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠান পালনের পরপরই সংগঠক ও শিল্পীরা সবাই মিলে জয়দেবপুরে গিয়েছিলেন আনন্দ-উৎসব করতে। সেখানেই বিকেলের আসরে মোখলেসুর রহমান (সিধু মিয়া) প্রস্তাব করলেন, সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সবাই একমত হলে নতুন সংগঠনের প্রস্তাব গৃহীত হলো। সুফিয়া কামাল সভাপতি ও ফরিদা হাসান সাধারণ সম্পাদক। কমিটিতে আরও ছিলেন মোখলেসুর রহমান, সায়েদুল হাসান, শামসুন্নাহার রহমান,ওয়াহিদুল হক, আহমেদুর রহমান, দেবদাস চক্রবর্তী, সাইফুদ্দিন আহমেদ মানিক প্রমুখ। কমিটির সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সন্‌জীদা খাতুনের নাম প্রস্তাব হলেও তিনি কমিটিতে থাকেন নি। কারণ তিনি তখন সরকারি কলেজে চাকরি করতেন। নবগঠিত কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকেই সংগঠনের নাম ঠিক হয়েছিল 'ছায়ানট'।

তাঁর প্রথম গানের গুরু ছিলেন সোহরাব হোসেন। তাঁর কাছে তিনি শিখেছিলেন নজরুলসংগীত, আধুনিক বাংলা গান এবং পল্লিগীতি। পরে রবীন্দ্রসংগীত শিখেছেন হুসনে বানু খানমের কাছে। পরে আরও অনেকের কাছে। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন শৈলজারঞ্জন মজুমদার, আব্দুল আহাদ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন প্রমুখ।

১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে সনজীদা খাতুনের উদ্যোগে প্রথম বাংলা একাডেমি'র (বর্ধমান হাউস ) বারান্দায় সঙ্গীত শেখার ক্লাস শুরু হয়।  এই সময় রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাতেন সনজীদা খাতুন ও ফরিদা মালিক, নজরুল সঙ্গীত শেখাতেন সোহরাব হোসেন, তবলা শেখাতেন বজলুল করিম, বেহালা ও সেতার শেখাতেন মতি মিয়া।

১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হন।
১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলগীতির একটি এক্সটেন্ডেড রেকর্ড প্রকাশ করেছিল- ঢাকা রেকর্ডস কোম্পানি।

১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে ইএমআই গ্রুপ- গ্রামোফোন কোম্পানি রবীন্দ্রসঙ্গীতের দুটি গানের রেকর্ড প্রকাশ করে। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ভারত থেকে এর পুনর্মুদ্রণ করে এইচএমভি

১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতার পরে তিনি ছায়ানট সঙ্গীত বিদ্যায়তনের অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন উল্লেখ্য, ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত গবেষণা কর্মের জন্য তিনি ভারতের শান্তিনিকেতন ছিলেন এই সময় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ছিলেন- ছায়ানটের নজরুলসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক অঞ্জলি রায়

১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত 'জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন পরিষদ গঠনে অন্যতম সংগঠক ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে এই পরিষদের তিনি সাধারণ সম্পাদক, নির্বাহী সভাপতি ও সভাপতির পদ অলঙ্কৃত করেছেন। এই বছরে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দীর্ঘবাদন রেকর্ড 'অতল জলের আহ্‌বান' প্রকাশিত হয়েছিল।

১৯৮৩ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মাঝামাঝি সম য় পর্যন্ত গবেষণা কর্মের জন্য ভারতের শান্তিনিকেতনে কাটান। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল- 'ধ্বনি থেকে কবিতা'।
এই সময় ছায়ানটের তৎকালীন অধ্যক্ষ সনজীদা খাতুনের অনুপস্থিতে, বিদ্যায়তনের নজরুলসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক অঞ্জলি রায় ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রফেসর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পুনর্নিয়োগ লাভ করেন।
২০০১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ছায়ানট-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এই পদে তিনি আমৃত্যু ছিলেন।
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনটি শ্রেণি নিয়ে 'নালন্দা বিদ্যালয়্' শুরু হয়। এই বিদ্যালায়ের তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।

২০০৩খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে 'কেন্দ্রীয় ব্রতচারী নৃত্যোৎসব পরিষদ' গঠন করে বড় মাপের প্রশিক্ষণ শিবির করবার চেষ্টা শুরু হয়। এই সময় ভারতের 'বাংলার ব্রতচারী সমিতি' থেকে ব্রতচারী সখা ছাড়া আরো কিছু বই আসে। সে সময়ে ঐ সমিতির সভাপতি কমলেশ চ্যাটার্জি 'বেঙ্গল অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন'-এর কাজে ঢাকায় এসেছিলেন। তাঁর সাথে ঢাকার ব্রতচারীর অধিকর্তাদের সঙ্গে আলাপ হয়। ব্রতচারীতে উৎসাহী 'নালন্দা'র সভাপতি সন্‌জীদা খাতুন তখন নৃত্যোৎসব পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন। তাঁর মাধ্যমে কলকাতা থেকে প্রশিক্ষক পাঠানোর বিষয়ে কমলেশ চ্যাটার্জির সঙ্গে কথা হয়।
 
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যের বাচিক চর্চা, প্রচার ও প্রসার প্রতিষ্ঠান কণ্ঠশীলন-এর সভাপতি নির্বাচিত হন। এবং আমৃত্যু এই পদে তিনি ছিলেন।
২০১৭ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের 'ড. আহমদ শরীফ চেয়ার, পদে ছিলেন।

২০২৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ, ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুপুর ৩টা ১০ মিনিটে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। সম্মাননা
'বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিশ্বভারতীর দেশিকোত্তম উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এই সম্মান লাভ করেছিলেন। ২০১২ সালে বিশ্বভারতীর তৎকালীন উপচার্য টেলিফোনে আমাকে জানালেন যে, কেন্দ্রীয় সরকার ২০০৮ সালের দেশিকোত্তম উপাধি আমাকে দিতে চেয়েছিলেন। ২০০৭ সাল থেকে পাঁচ বছর বিশ্বভারতীর কোনো সমাবর্তন হয়নি বলে ২০০৮ সালে আমিও ওই সম্মাননা পাইনি।'
সন্‌জিদা খাতুনের রচিত গ্রন্থাবলি  সম্পাদনা

সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক: