কামাল লোহানী
১৯৩৪-২০২০ খ্রিষ্টাব্দ
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ।
১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জ জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার সনতলা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী।
তবে কামাল লোহানী নামেই সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন। তাঁর পিতার নাম আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী ও
মাতার নাম রোকেয়া খান লোহানী । উল্লেখ্য,
লোহানী পরিবারের আদি বাসস্থান ছিল খাস কাউলিয়ায়র
যমুনা পাড়ে। আগ্রাসী যমুনা-গর্ভে তাঁদের জমিজমা-সহ
বাড়িঘর বিলীন হয়ে গেলে- এঁরা সিরাজগঞ্জেরই উল্লাপাড়া থানার খান সনতলা
গ্রামে বসতি স্থাপন করেছিলেন।
১৯৪১-৪২ খ্রিষ্টাব্দের দিকে তাঁর মাতৃবিয়োগ হয়। এই সময় কামাল লোহানীদের
পরিবার ছিল একান্নবর্তী। মাতৃহীন কামালের সুশিক্ষা লাভে বঞ্চিত হবে ভেবে, তাঁর পিতা
তাঁকে
কলকাতায় নিঃসন্তান ফুফু সালেমা খানমের কাছে
পাঠান। এখানে তিনি কলকাতার শিশু বিদ্যাপীঠে
ভর্তি হয়ে লেখাপড়া শুরু করেন।
১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানে চলে আসেন এবং পাবনা জিলা স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক
পাশ করেন।
এই সময় তিনি বাংলা ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। এ ছাড়া এই সময়ে পাবনা ছাত্র ইউনিয়ন গঠিত হলে তিনি পাবনায় ছাত্র ইউনিয়ন গঠনে সরাসরি যুক্ত
হন।
১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড কলেজে নুরুল আমিন ও অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের আগমনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীরা
প্রতিবাদী বিক্ষোভ করে। উল্লেখ্য, পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ্ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিল
অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। এইখানে
অনুষ্ঠানের যোগদানের জন্য আসেন তৎকালীন পূর্ববাংলার
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী সর্দার আব্দুর রব
নিশতার, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা খান আব্দুল কাউয়ুম খান, প্রাদেশিক লীগ নেতা
মোহাম্মদ আফজাল প্রমুখ। এই সম্মেলনের
প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শন করায় কামাল লোহানী পাবনার
রাজনৈতিক নেতা-কর্মী এবং এডওয়ার্ড কলেজের অধ্যাপক ও শিক্ষার্থীদের সাথে প্রথমবারের
মত গ্রেফতার হলেন। ৭ দিন পাবনা জেলে থাকার পর জামিনে মুক্তি পান
।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে
পূর্ববাংলায় অনুষ্ঠিত হয় প্রাদেশিক নির্বাচন।
কামাল লোহানী তথা সকল প্রগতিশীল ছাত্রই যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে
যুক্তফ্রন্টের রাজনৈতিক মঞ্চের সাথে যুক্ত ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি পাবনা টাউন হলে মহান শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে গণজমায়েত এবং
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিপুল জনতার স্বতঃর্স্ফুত অংশগ্রহণে লীগ সরকার
তটস্থ হয়ে পরদিন গ্রেফতার শুরু করে। ২২-ফেব্রুয়ারি সকালে কামাল লোহানী গ্রেফতার হন
এবং যুক্তফ্রন্টের বিপুল বিজয়ে নির্বাচনের পর মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫৪ সালের ২৯ মে
৯২-(ক) ধারার মাধ্যমে পূর্ববাংলায় গভর্নরী
শাসন’
চালু করে। মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মীর্জা পূর্ববাংলায় গভর্নর হয়ে আসে এবং ব্যাপক
ধরপাকড়ের নির্দেশ দেন।
কলেজ ছুটি থাকায় কামাল লোহানী গ্রামের বাড়ি চলে যান। ১লা জুন সনতলা
গ্রাম থেকে কামালকে গ্রেফতার করা হয়।
প্রথমে তাঁকে উল্লাপাড়া থানা হাজতে রাখা হয়। পরে রাতে তাঁকে পুলিশ পাহারায় পাবনা ডিস্ট্রিক্ট জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ঈদের দিন
পাবনা জেলে 'রাজবন্দি' হিসেবে কারাজীবন শুরু করেন এর
কিছুদিন পর তাঁকে রাজশাহী
কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৫৫ খ্রিষ্টাব্দে জুলাই মাসে জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি ঢাকা চলে আসেন এবং তাঁর
চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর বাসায় ওঠেন এই সময় তিনি মার্ক্সবাদী আন্দোলনের সাথে
জড়িত হন।
তবে তাঁর রাজনৈতিক দল ছিল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। এই বছরেই
তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকায় ৩০ টাকা বেতনে সহ-সম্পাদক হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন।
এই চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন ফজলে লোহানী। এরপর
দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু'-'দফায়
যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের সামরিক শাসনের সময় অনেকর সাথে তিনিও আত্মগোপন করেন। এই সময় তিনি নাচের প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
এই সূত্রে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচে ভর্তি হন। তিনি পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের সদস্য এবং নৃত্যশিল্পী হিসেবে বেশ কিছু দেশে
অংশগ্রহণ করেন। এসময় তার নৃত্যগুরু ছিলেন জি এ মান্নান। মান্নানের প্রযোজনায় তিনি ‘নক্সী কাঁথার মাঠ’ নাট্যে অংশ নেন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে নৃত্যনাট্য দলের সাথে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশ সফর করেন।
১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীর সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই দম্পতির এক ছেলে ও দুই মেয়ে-
পুত্র সাগর লোহানী এবং কন্যাদ্বয় বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী। এই বছরেই তিনি দৈনিক
আজাদ পত্রিকায় যোগদান করেন।
১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসাবে মধ্যপ্রাচ্যে যান এবং ইরান, ইরাক সফর করেন। এই বছরেই
রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনের উপর তৎকালীন পাকিস্তান সরকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শতবর্ষ পালনের আয়োজনে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে তিনি বজ্রসেনের ভূমিকায় অংশ
নিয়ে প্রশংসিত হন। এই সময় অন্যান্য সাংস্কৃতিক কর্মীদের সাথে কামাল লোহানী সকল নিষেধাজ্ঞা উপক্ষো করে ছায়ানটের নেতৃত্বে
রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী
পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এই সূত্রে ছায়ানট প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দ তিনি
ছায়ানট সাংস্কৃতিক সংগঠনের
সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত তিনি এই পদে আসীন ছিলেন।
১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দের৩০
জানুয়ারি তাঁর প্রথম সন্তান সাগর লোহানীর জন্ম হয়। ফেব্রুয়ারি মাস
থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।
১৩ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে ‘ দৈনিক
আজাদ’
থেকে ঘরে ফেরার পথে কামালকে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রীয়
কারাগারে পাঠানো হয়। এই সময় এই কারগারের ২৬ নম্বর কক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ, আবুল মনসুর আহমেদ, রনেশ দাশগুপ্ত,
তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াঁ, কফিলউদ্দিন চৌধুরী, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম-সহ অনেকেই
একসাথে ছিলেন। তরুণ নেতাদের মধ্যে ছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম, শেখ মনি, হায়দার আকবর খান রনো,
নাসিম আলী। প্রায় সাড়ে তিন মাস পরে তিনি মুক্তি লাভ করেন।
কারগার থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি দৈনিক 'সংবাদ'-এ সিনিয়র সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দিয়ে অল্প
দিনেই শিফট-ইন-চার্জ পদে উন্নীত হন।
১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পাকিস্তান ফিচার সিন্ডিকেটে’যোগদান করেন। ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে 'পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি' এবং ১৯৬৭
খ্রিষ্টাব্দে 'ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি' বিভক্ত হয়ে গেলে কামাল লোহানী দলীয় রাজনীতি ত্যাগ করেন এবং সাংবাদিক ট্রেড ইউনিয়ন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তিনি তাঁর লড়াইয়ের ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেন।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের রাজনৈতিক আদর্শের জন্য
ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদকের পদ
ছেড়ে দেন এবং মার্কসবাদী আদর্শে
ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী
গড়ে তোলেন। এই বছরের ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠী উদ্বোধন করেন। এসময় তিনি ‘ধানের গুচ্ছে রক্ত জমেছে’ নামক একটি গণসংগীত অনুষ্ঠান আয়োজন, ‘আলোর পথযাত্রী’ নামক একটি নাটক পরিচালনা ও এতে অভিনয় করেন।
শিল্পী আমানুল হক পরিচালিত নৃত্যনাট্য "জ্বলছে আগুন ক্ষেতে ও খামারে" বিবেকের ভূমিকায় নেচেছিলেন কামাল লোহানী। এই সময় তিনি আবৃত্তি ও উপস্থাপনায়ও যুক্ত করেন নিজেকে।
১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন পার্লামেন্টে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে অবমাননা করে বক্তব্য দেন এবং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে কটুক্তি করে
বলেন- “তিনি আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির কেউ নন”। এর প্রতিবাদে তখন পুর্ব বাংলা প্রায়
সকল বুদ্ধজীবী প্রতিবাদ করেন। এই অবস্থায় কামাল লোহানী ‘ক্রান্তি’র জরুরী সভা ডেকে প্রতিবাদ করলেন, এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাঠালেন। সেই প্রস্তাব থেকেই অত্যন্ত সাহসের সাথে সামরিক শাসনের মাঝেও পাকিস্তান অবজারভারের নিউজ এডিটর এ বি এম মুসা নিউজ করলেন ‘Regimentation of Culture?’। এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে
আন্দোলন পরিচালিত করার জন্য ‘সাংস্কৃতিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা পরিষদ’ নামে একটি
সংগঠনের উদ্ভব হয়। এই সংগঠনের আহবায়ক ছিলেন ওয়াহিদুল হক ও কামাল লোহানী। এই পরিষদ ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশনে তিনদিনব্যাপী রবীন্দ্র অনুষ্ঠানমালার আয়োজন
করে এবং বিপুল দর্শক সমাগমে অবাঙালী গুন্ডাদের হামলার পরেও অত্যন্ত সফলভাবে অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।
১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পূর্ব পাকিস্তানের অন্যান্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সাথে তিনি এ আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা রাখেন। এই
বছরের প্রথম দিকে কিছুদিনের জন্যে ‘দৈনিক পয়গাম’ এ সাংবাদিকতা করেন। এই বছরের
শেষের দিকে তিনি অবজারভার গ্রুপ অব পাবলিকেশন্সের 'দৈনিক পূর্বদেশ' পত্রিকায় শিফট ইনচার্জ হিসেবে যোগ দেন। পরে চীফ সাব-এডিটর পদে উন্নীত হন। এই সময়কালে তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দুদফায় যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন।
১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এই বছরে
তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক 'স্বরাজ' পত্রিকায় কয়েকটি
অগ্নিগর্ভ প্রতিবেদন রচনা করেন।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৯শে মার্চে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি জওয়ানদের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে তাঁর রচিত প্রতিবেদন স্বরাজে প্রকাশিত হয়।
এর শিরোনাম ছিল “বিদ্রোহ ন্যায়সংগত”। ২৫শে মার্চ দিবাগত রাতে
অপারেশন সার্চ লাইট-এর
মধ্যমে পাকিস্তানী সেনারা বাঙালি নিধনে মেতে উঠে। এই অবস্থায় এপ্রিলের শেষে তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মে মাসের শুরুতে কুমিল্লার চান্দিনা হয়ে নৌকাযোগে ভারত সীমান্তে পৌঁছোন এবং ঐ স্থানের থানা হাজতে নিরাপদে রাত কাটানোর পরের দিন ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলা গিয়ে উপস্থিত হন।
আগরতলা থেকে তিনি অন্যান্যদের সাথে ট্রেনযোগে কলকাতা যান। সে সময়ে এঁদের যাত্রাসঙ্গী
ছিলেন প্রখ্যাত ফুটবলার প্রতাপ শঙ্কর হাজরা। এঁরা সবাই প্রতাপ শঙ্করএর আত্মীয়ের আমহার্ষ্ট ষ্ট্রীটের বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। সেখানে থেকেই
তাঁর সাংবাদিক বন্ধু মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী তাঁকে 'জয়বাংলা' পত্রিকায় নিয়ে যান। এখানে কাজ করার
সময় আমিনুল হক বাদশার সাথে দেখা হয়। আমিনুল হক তাঁকে বালীগঞ্জ সার্কুলার রোডে
নিয়ে যান। সেখানে তখন 'স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র'-এর ৫০ কিলোওয়াট মিডিয়াম ওয়েভ ট্রান্সমিটার উদ্বোধনের
আয়োজন চলছিল। উল্লেখ্য বালীগঞ্জের এই বাড়িটিতে তখন প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মন্ত্রীরা বাস করতেন। তাঁরা বেতারের জন্য বাড়িটি ছেড়ে দিয়েছিলেন। এইখানেই প্রচলিত রীতির যন্ত্রপাতি ও স্টুডিও ব্যবস্থা না থাকা সত্ত্বেও এই ট্রান্সমিশনটি উদ্বোধন করা হয়। এই অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী কাজী নজরুল ইসলামের 'বিদ্রোহী' কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
এরপর তিনি
স্বাধীন
বাংলা বেতার কেন্দ্রের
সংবাদ বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয়
অর্জনের সংবাদ বেতারে তিনিই প্রথম পাঠ করেন। বেতারে তিনি ঘোষণা করেন, “আমরা বিজয়
অর্জন করেছি। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে
বাধ্য হয়েছে।” ১৬ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পরে ২৫ ডিসেম্বর তাকে ঢাকা বেতারের দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ২২ ডিসেম্বর মুজিবনগর সরকার ঢাকা চলে আসে। এই সময় তিনি বেতার
থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঢাকা আগমনের ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন । ১৯৭১
খ্রিষ্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর তিনি ঢাকা বেতারের দায়িত্ব নেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী করেন।
১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে শেখ মুজিবুর রহমানের কলকাতা সফর উপলক্ষে তৎকালীন দমদম বিমানবন্দরেও
(বর্তমান নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর) ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতার পর বেতারের প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে অনেকটা নিরব প্রতিবাদেই বেতারের ট্রান্সক্রিপশন পরিচালক হিসেবে তিনি বেতার ত্যাগ করেন।
এরপর তিনি পুনারায় সাংবাদিকতায় ফিরে আসেন।
১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দের দৈনিক জনপদ নামক একটি পত্রিকাতে যোগদান করেন।
১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দৈনিক জনপদ পত্রিকা ত্যাগ করে বঙ্গবার্তা'য় যোগদান করেন।উল্লেখ্য, মওলানা ভাসানী সমর্থিত এ পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন ফয়েজ আহমেদ। পরে
এই পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে গেল- তিনি দৈনিক বাংলার বাণী পত্রিকায় বার্তা-সম্পাদক হিসেবে
যোগদান করেন। এ
বছরই তাঁর নেতৃত্বে পুনরায় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন নির্বাচন হয় এবং তিনি সভাপতি
নির্বাচিত হন। এই বছরেই কামাল লোহানী সাংবাদিক ইউনিয়নের নির্বাচন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সাংবাদিক আবেদ খান রচিত 'জ্বালামুখ' নাটক পরিচালনা ও নিপীড়ণে বিধ্বস্ত এক মানুষের চরিত্রে অভিনয়ও করেন।
তাছাড়া দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য পূর্ব জার্মানি, হাঙ্গেরী ও চেকোশ্লোভাকিয়া সফর করেন।
১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন সংবাদপত্র এ্যানালমেন্ট অধ্যাদেশ জারি করে মাত্র চারটি পত্রিকা ছাড়া সব পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
এই সময় নির্মল সেন ও কামাল লোহানী বাকশালে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান।
১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তিনি সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনের দিকে মনোযোগী হন।
১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত দৈনিক বার্তার নির্বাহী সম্পাদকের দায়িত্ব
গ্রহণ করেন। এই কারণে তিনি ঢাকা ছাড়তে হন।
১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁকে সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। জাম্বিয়ার রাজধানী লুসাকা-তে অনুষ্ঠিতব্য কমনওয়েলথ রাষ্ট্রপ্রধান সম্মেলনে বাংলাদেশের একজন সম্পাদক হিসেবে প্রেসিডেন্সিয়াল এনট্যুরেজের সদস্য মনোনীত হন। কিন্তু রাষ্ট্রপতির সামরিক সচিবের প্রস্তাবানুযায়ী চিরন্তন পরিধেয় পাজামা-পাঞ্জাবি পরিহার করে স্যুট কোট পরতে অস্বীকার করেন। ফলে সামরিক সচিবের সাথে বাকবিতণ্ডা হয় এবং বিদেশ না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দ তিনি রাজশাহীতে 'রাজশাহী আর্ট কলেজ' প্রতিষ্ঠার অন্যতম উদ্যোক্তা
ছিলেন তিনি। তিনি এই কলেজের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধের ফলে দৈনিক বার্তা ছেড়ে দেন
এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটে যোগদান করেন
এবং এর প্রকাশনা পরিচালক ও 'ডেপথনিউজ বাংলাদেশ'-এর সম্পাদক হিসেবে
দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ক'মাস পরেই তিনি পিআইবি'র এসোসিয়েট এডিটর পদে নিযুক্ত হন।
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ গণশিল্পী সংস্থা গঠন করেন এবং গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি হন।
১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক নিযুক্ত হন। ১৬ মাসের মাথায় বিএনপির রাজনৈতিক দর্শনের সাথে
মতবিরোধের কারণে তিনি মহাপরিচালকের পদ ত্যাগ করেন।
২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব
পালন করেন৷
২০১১ খ্রিষ্টাব্দে পুনরায় তিনি শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন।
তিনি চার বছর বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এই
বছরের জাতীয় নির্বাচনে মহাজোটের বিজয়ের পর আবারও দু’বছরের জন্যে শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন
করেন।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে তাঁর উদ্যোগে গঠিত হয় নবনাট্য সংঘ।
এই সময় তিনি নাট্য দল তৈরি করে বিভিন্ন জেলায় নাট্য-চর্চার ক্ষেত্রে প্রসারিত করার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখেন।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা ছিলেন।
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি '৭১-এর অন্যতম সমর্থক ছিলেন।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের বাংলাদেশে সরকার তাকে সাংবাদিকতায় বিশেষ অবদানের জন্য একুশে পদকে ভূষিত করে।
২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের পর থেকে বারধ্ক্যজনীত কারণে তিনি ধীরে ধীরে নানা রোগে আক্রান্ত
হয়ে পড়েন। গ্লুকোমার কারণে দৃষ্টিশক্তি প্রায় হারিয়ে ফেলেছিলেন। প্রায় ৩ বছর তিনি
অন্যের সহায়তায় লেখালেখির কাজ করেছেন।
২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসের শুরুর দিক দিকে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। ৫ মার্চ হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে ‘জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলন’ উদ্বোধনের
জন্য সিরাজগঞ্জ যান। ৬ মার্চ সম্মেলন উদ্বোধন শেষে ঢাকায় ফিরে আসেন। এরপর করোনার
কারণে গৃহবন্দী অবস্থায় বাড়িতেই থাকেন। লকডাউনের কারণে তাঁর স্বাভাবিক চিকিৎসার
ব্যাঘাত ঘটে। কিডনি ও ফুসফুসের রোগ বৃদ্ধি পেলে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মে তাঁকে হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে তিনি ২রা জুন বাড়ী ফিরে আসেন। এরপর তাঁর
শ্বাসকষ্ট-সহ নানা উপসর্গ দেখা দিলে তাঁকে ১৭ জুন আবার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই
সময় করোনা-পরীক্ষা করা হয় এবং ১৯ জুন সকালে জানা যায় তিনি করোনাক্রান্ত। এরপর তাঁকে কোভিড ১৯ হাসপাতাল ‘শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল’ এর আইসিইউ-তে স্থানান্তরিত
করা হয়। ২০ তারিখ ভোরে অবস্থার অবনতি ঘটলে লাইভ সাপোর্টে নেয়া হয় তাঁকে।
২০শে জুন শেখ
রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেণ।
তাঁর রচিত গ্রন্থ:
- আমরা হারবো না নানারা হারবো না
- সত্যি কথা বলতে কী
- যেন ভুলে না যাই
- মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার
- রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার
- মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার
- এ দেশ আমার গর্ব
- আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম
- লড়াইয়ের গান
সাংস্কৃতিক
সম্মাননা
- কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা, ১৯৯১
প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা;
রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা; ক্রান্তি স্মারক - ২০০৩,
ঋষিজ সম্মাননা।
জাহানারা
ইমাম পদক ও বাংলা একাডেমী ফেলো পান ২০০৮।
একুশে পদক ২০১৫।