মোহাম্মদ হোসেন খসরু
(১৯০৩-১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতীয় শাস্ত্রীয়সঙ্গীত শিল্পী ও সঙ্গীত শিক্ষক।
১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দের ২ এপ্রিল
কুমিল্লা শহরস্থ মাতুলালয় দারোগা বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিলো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার মঈনপুর গ্রামে।
তাঁর প্রকৃত নাম ছিল খোরশেদ আলম সরকার
তাঁর পিতা জায়েদুল হোসেন ছিলেন সৌখিন বংশীবাদক। এই সূত্রে পারিবারিকভাবে সঙ্গীতের
প্রতি আগ্রহ জন্মেছিল।
১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এন্ট্রান্স (দুটি লেটারসহ) পাস করেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ‘ডিসটিংশন’ সহ বিএ পাশ করেন।
এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ও ল’ কাসে ভর্তি হন। পরে কিন্তু পিতার ইচ্ছায়
তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা হন। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে এই
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডোগ্রি লাভ করেন।
পিতার কাছে সঙ্গীতের পাঠ নেওয়ার পর, তাঁর
গান শিখেছিলেন সূরসম্পর্কীয় আত্মীয়- জানে আলম চৌধুরীর
কাছে।
এই সময় কলকাতার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ আমিরুল ইসলাম শকীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।
এই সূত্রে তিনি তাঁর কাছে সঙ্গীতের তালিম নেন। এই সময় তিনি তাঁর প্রকৃত নাম
মোঃ খোরশেদ আলম সরকার পাল্টিয়ে আমীর খসরু নাম গ্রহণ করেন।
তিনি উপমহাদেশের বিখ্যাত ওস্তাদ, তানসেনের বংশধর, ‘সেনী ঘরানার’ সংগীত ব্যক্তিত্ব ওয়াজির খাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। উত্তর ভারতের রামপুর রাজ্যের বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ মেহেদী হাসান খান খসরুর প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন এবং তাঁকে শিষ্যত্বে বরণ করেন। খসরু তাঁর কাছে ধ্রুপদ, ধামার, হোরি, সাদ্রা সংগীতের উপর প্রশিক্ষণ লাভ করেন। আমৃত্যু তিনি ওস্তাদের উপদেশ ও পথ অনুসরণ করেন।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর সাথে কাজী নজরুল ইসলাম পরিচয় হয় ওস্তাদ হোসেন খসরু।
এই সময় শচীনদেব বর্মণ ও কাজী নজরুল
উভয়ই তাঁর কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাঠ নেন।
কথিত আছে তাঁর কাছে কাজী মোতাহের হোসেন তাঁর কাছে গান শিখেছিলেন।
১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দে বিএ পাস করেন
১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লক্ষ্ণৌ যান। তিনি সেখানে ওস্তাদ নাছির উদ্দিন খানের নিকট
ধ্রুপদ, ওস্তাদ কালে খাঁর নিকট টপ্পা, ওস্তাদ মামিদ খাঁনের কাছে তবলা, ওস্তাদ করিম
খাঁ ও ওস্তাদ মঈজউদ্দিন খাঁর কাছে ঠুমরি শেখেন। এরপর ওস্তাদ উজির খাঁ, ওস্তাদ মোহাম্মদ
আলী খাঁ, ওস্তাদ জদ্দন বাঈ, ওস্তাদ আল্লাদিয়া খাঁ, ওস্তাদ বাদল খাঁ প্রমুখের কাছে
খেয়াল শিক্ষা করেন। যন্ত্রসংগীতে-তবলা, সেতার, এস্রাজেও তিনি সমভাবে দক্ষ ছিলেন।
অতঃপর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং একজন বিশিষ্ট ওস্তাদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সময় ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে উঠে।
১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দে সমবায় দপ্তরের অডিটর হিসেবে নারায়ণগঞ্জে চাকুরিতে যোগদান করেন।
উক্ত বছরের শেষের দিকে ময়মনসিংহে বদলি হন। সেখানে তিনি ওস্তাদ মৌলভিরাম, থেরো কেয়ো,
জ্ঞান গোম্বামী, ভীষ্মদেব ও রামকৃষ্ণ মিশ্র প্রমুখ ভারত বিখ্যাত ওস্তাদের সংস্পর্শে
আসেন। তাঁরা তাঁর সংগীত প্রতিভা দেখে মুগ্ধ হন। ১৯৩৩
খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘ওস্তাদ’ হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। সংগীতে অসামান্য
কৃতিত্বের জন্য আলাউদ্দিন খাঁ কর্তৃক
‘দেশমণি’ খেতাবে ভূষিত হন তিনি।
১৯৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বদলি হন।
১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিখিল বঙ্গ ও নিখিল ভারত মিউজিক কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন।
কলকতায় সঙ্গীত সম্মেলন উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ওস্তাদ
ওস্তাদ
ফৈয়াজ খান-এর সাথে পরিচয় হয়। তিনি কনফারেন্সের সমাপনী দিবসে সবচেয়ে শেষে তাঁর গান গাইলেন।
কথিত আছে- নতাঁর গানের রাগ পূর্ববর্তী গাইয়েদের কাছে একদম নতুন ঠেকলে তাঁর ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে জিজ্ঞাস করলেন ওস্তাদ খসরু’র গাওয়া গানের রাগের নাম কি? ওস্তাদ ফৈয়াজ বললেন, ‘অপ্রচলিত রাগ’।
ওস্তাদ খসরু পূববর্তী সব গাইয়ের গানের রাগ একত্রিত করে সম্পূর্ণ নতুন এক রাগ সৃষ্টি করেছেন। সবাই বলল, এটা কী করে সম্ভব? অন্যান্য গাইয়ের এ প্রশ্নের উত্তরে ফৈয়াজ খাঁ বললেন, তাঁর দ্বারা সম্ভব, কারণ তিনি শিক্ষত লোক। অন্য কারো দ্বারা তা সম্ভব নয়।
পরে তিনি লক্ষ্ণৌর প্রসিদ্ধ ‘মরিস কলেজ অভ মিউজিক’ এর উপাধ্যক্ষ নিযুক্ত
হয়েছিলেন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে পাক-ভারত বিভাজনের পরে তিনি ঢাকায় আসেন। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে
শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রশিক্ষক হিসেবে ঢাকা বেতারে যোগ দেন। এই সময় তিনি বাংলা, উদু ও হিন্দি ভাষায় গান
রচনা করেন। এই সময় তিনি গজল রচনা করেছিলেন। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাইরে তিনি হামদ, নাত, মুর্শিদি, মারফতি, ভজন, কীর্তন, লোকগীতি, পল্লীগীতি ও আধুনিক গানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। সংগীতের পাশাপাশি নৃত্যেও তাঁর দখল ছিল। বিখ্যাত কথ্যক নৃত্যশিল্পী বেলা অর্ণভ, মাদাম সিমকি, মঞ্জুলিকা ভাদুড়িসহ অনেকেই তাঁর শিষ্য ছিলেন। এ ছাড়াও ওস্তাদ যে সব ছাত্র-ছাত্রীকে সংগীত শিক্ষা দেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য
ছিলেন -অসিতবরণ, আব্দুল আলীম, আবদুল আহাদ,আব্দুল খালেক, আবদুল হালিম চৌধুরী,আমীর জুম্মন খান, আয়াতুল্লাহ খান,
আলী আহমদ খান (ওস্তাদ), কালু সেন, ওসমান খান, কুমকুম হক, গৌর গোম্বামী, ঘোষ দস্তিদার (কালি), জালাল উদ্দিন মাহমুদ, জাহানারা আহসান, জ্ঞানদত্ত, দিপালী নাগ,নজরুল ইসলাম
(কাজী), পান্নালাল ঘোষ,
পূর্ণেন্দু নন্দী (পচা নন্দী), প্রসাদ মুখার্জি,
ফেরদৌসী রহমান, বিজন বালা, বিজন বোস, বিজয় ভট্টাচার্য্য,
বিশ্বনাথ, বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী, বেদার উদ্দিন, বেচু দত্ত, বেলা মুখোপাধ্যায়, মায়া দেবী, মিথুন দে, মোশারফ হোসেন খান, রহমান
খান (ওস্তাদ), শরাফত হোসেন খান, শাহনাজ রহমত উল্লা,
শচীন দেববর্মণ, শেখ লুৎফর রহামন,
শেফালি সেনগুপ্তা, শৈলাবলা দেবী,শোভা চক্রবর্তী, সন্ধ্যা মুখাপাধ্যায়, সমরেন্দ্র পাল,
সমরেশ চৌধুরী,
সুধীরলাল চক্রবর্তী,সোহরাব হোসেন,
হিমাংশু দত্ত,
হোসনা বানু খানম, প্রমুখ।
১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হন এবং সেবার
বেঁচে উঠলেও তিনি স্বাস্থ্য আর ফিরে পান নি। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বুলবুল
একাডেমির প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন। এ একাডেমির সার্বিক উন্নয়নে তাঁর ভূমিকা ছিল। এই
সময় তাঁর কাছে গান শিখতে আসতেন বেদার উদ্দিন আহমদ, আব্দুল হালিম চৌধুরী, আব্দুল আহাদ প্রমুখ
সংগীতজনেরা।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দের ৭ আগষ্ট তিনি কুমিল্লার বাসভবন দারোগা বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন।
পরিবার
ওস্তাদ হোসেন খসরু বিয়ে করেছিলেন বরিশাল নিবাসী রওশন আরাকে।
সম্মাননা:
- প্রাইড অব পারফরমেন্স’ (মরণোত্তর) ১৯৬২
- শিল্পকলা একাডেমী পদক (মরণোত্তর)১৯৭৮
সূত্র:
- কুমিল্লার কাগজ। ৯ এপ্রিল ২০১৮।
- বাংলা পেডিয়া। বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি