সমুদ্রগুপ্ত
(৩২৫-৩৮০ খ্রিষ্টাব্দ)
ভারতবর্ষের
গুপ্তরাজবংশের চতুর্থ রাজা।
সমুদ্রগুপ্তের জীবন ও রাজত্বকালের ইতিহাস
সম্পর্কে চারটি শিলালিপি থেকে জানা যায়। এগুলি হলো – এলাহাবাদ প্রশস্তি,
মধ্যপ্রদেশের মালবে স্থিত এরানে প্রাপ্ত শিলালেখ, নালন্দায় প্রাপ্ত তাম্রলেখ
(রাজত্বকালের পঞ্চম বর্ষে রচিত) ও গয়ায় প্রাপ্ত তাম্রলেখ (রাজত্বকালের নবম বর্ষে
রচিত)। বর্তমানে এই শিলালিপিগুলির ঐতিহাসিকতা আধুনিক ঐতিহাসিকগণ স্বীকার করেন।
এছাড়া সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা থেকে তাঁর রাজত্বের বহু তথ্য জানা যায়। বৌদ্ধ গ্রন্থ
আর্য়মঞ্জুশ্রীকল্প-তে তাঁর সম্পর্কে বিশেষভাবে
জানা যায়।
নালন্দার তাম্রলিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি ৩২৫ খ্রিষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন।
তাঁর মা ছিলেন লিচ্ছবি রাজকন্যা।
চন্দ্রগুপ্ত প্রথম মৃত্যুর আগেই সমুদ্রগুপ্তকে সিংহাসনের উত্তরাধিকারী করে যান। কিন্তু
পিতার মৃত্যুর পর, উত্তরাধিকারদের মধ্যে বিরোধ ঘটে। এই বিরোধকে জয় করে,
তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের অধিকার লাভ করেন।
সমুদ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা |
সমুদ্রগুপ্তের অপর নাম ছিল কচ। অনেকের মতে কচ ছিলেন সমুদ্রগুপ্তের একজন ভাই এবং সমুদ্রগুপ্তের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু কচ্ প্রবর্তিত স্বর্ণমুদ্রার অপর পৃষ্ঠায় 'সর্বজোচ্ছেত্তা' উপাধি পাওয়া যায়। কচকে পরাজিত করে সমুদ্রগুপ্ত য়দি রাজা হন, তাহলে কচের স্বর্ণমুদ্রা প্রচলনের সুযোগ ছিল না। তাছাড়া সমুদ্রগুপ্ত প্রতিপক্ষের নামে স্বর্ণমুদ্রা চালু রাখতেন না। এই বিচারে বলা যায়, সমুদ্রগুপ্ত এবং কচ একই ব্যক্তি ছিলেন।
'এলাহাবাদ প্রশস্তি' ১১ সংখ্যক ও ২১ সংখ্যক স্তবকে মোট দুইবার আর্যাবর্ত অভিযানের উল্লেখ আছে। দ্বিতীয় বিবরণটিতে আবার প্রথম বিবরণে উল্লিখিত বিজিত রাজাদের নামের পুনরুল্লেখ রয়েছে। এই সূত্রে এইচ সি রায়চৌধুরী, রমেশচন্দ্র মজুমদার, সুধাকর চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ ঐতিহাসিকবৃন্দ মনে করেন, সমুদ্রগুপ্ত দাক্ষিণাত্য অভিযানের আগে ও পরে মোট দুইবার উত্তর ভারতে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন। ঐতিহাসিক এস আর গয়াল মনে করেন, উত্তর ভারতে নিজের শক্তি সুদৃঢ় করার পর তিনি দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনা করেন। 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে জানা যায়, তিনি আর্যাবর্তের মোট নয় জন রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। এই রাজারা ছিলেন− রুদ্রদেব, মতিল, নাগদত্ত, চন্দ্রবর্মণ, গণপতিনাগ, অচ্যূত, নাগসেন, নন্দীন, বলবর্মণ। এঁদের ভিতর ৬জন রাজার বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায়। এঁরা হলেন −
হরিষেণ-প্রশস্তি অনুসারে জানা যায় পুষ্পনগর (প্রাচীন পাটালিপুত্রের অপর নাম) থেকে এই সকল রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেছিলেন। ঐতিহাসিক কে পি জয়সোয়ালের মতে, এই সব রাজাদের সাথে যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল− অহিচ্ছত্র, মথুরা, পদ্মাবতী ও দক্ষিণ পঞ্চালের মধ্যবর্তী কৌশাম্বী অঞ্চলে।
দক্ষিণাবর্তের ১২টি রাজাকে তিনি পরাজিত করেন এবং দক্ষিণ ভারতকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেন। এই রাজারা ছিলেন কোশলের মহেন্দ্র, মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজা, কৌরলের মন্তরাজ, কোত্তরের স্বামীদত্ত, এরণ্ডের দমন, কাঞ্চীর বিষ্ণুগোপ, অভমুক্তার নীলরাজ, কুস্থলাপুরের ধনঞ্জয়। এই রাজ্যগুলো দখল করে তিনি করদরাজ্যে পরিণত করেন।
এরপর পূর্ব ও পশ্চিম ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের সমতট, কামরূপ, নেপাল, মালব, অর্জুনয়ন, আভীর রাজ্যের রাজারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে কর প্রদানে রাজী হন।
এই সকল রাজ্য জয়ের পর তিনি অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এবং এরই স্মৃতি রক্ষার্থে তিনি স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেছিলেন। ৩৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এরপর গুপ্তসাম্রাজ্যের রাজা হন, রামগুপ্ত।
সূত্র :
বাংলাদেশের
ইতিহাস (আদিপর্ব)/রমেশচন্দ্র মজুমদার।
ভারতের ইতিহাস । অতুলচন্দ্র রায়, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়।