সত্যেন্দ্রনাথ বসু
(১৮৯৪-১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দ)

বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী।

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের  ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার গোয়া বাগান অঞ্চলের স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পাশে ২২ নম্বর ঈশ্বর মিত্র লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পূর্ব ভারতীয় রেলওয়ের হিসাবরক্ষক। মাতা আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের খ্যাতনামা ব্যবহারজীবী মতিলাল রায়চৌধুরীর কন্যা। সত্যেন্দ্রানাথ বসু সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন।

সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নর্মাল স্কুলে। পরে বাড়ীর সন্নিকটে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন। এরপর তিনি
হিন্দু কলেজ  এন্ট্রান্স ক্লাশে ভর্তি হন।

১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা
হিন্দু কলেজ থেকে পঞ্চম স্থানসহ এন্ট্রান্স পাশ করেন। এরপর তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজএ ভর্তি হন। এখানে তিনি শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন, জগদীশচন্দ্র বসু, সারদাপ্রসন্ন দাস এবং প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের মতো শিক্ষকদের। ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করে এফ.এ পরীক্ষা পাস করেন। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে গণিতে (স্নাতক) প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ পাশ করেন।

১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ঊষাবতী ঘোষকে বিবাহ করেন। বিবাহিত জীবনে ৯টি সন্তানের জনক হয়েছিলেন।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে মিশ্র গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থানসহ এম.এস সি ডিগ্রি লাভ করেন।
এই বছরে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিজ্ঞান কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন এবং তাঁরে অনুরোধে তিনি এই কলেজে প্রভাষক হিসাবে যোগ দেন। এই কলেজে থাকাকালীন তিনি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সাহচর্যে মিশ্র গণিত ও পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন। ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মেঘনাদ সাহার সাথে তাঁর কিছু গবেষণামূলক লেখা প্রকাশিত হয়।

১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে, তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রিডার হিসেবে যোগদান করেন। দীর্ঘকাল ধরে তিনি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগটি গড়ে তোলার জন্য নিষ্ঠার সাথে কাজ করে যান। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ২৪ বছর একনিষ্ঠভাবে গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৌলিক প্রবন্ধ 'Planck's quantum radiation law' রচনা করেন। এই রচনার ভিতর দিয়ে তিনি আংশিকভাবে কোয়ান্টাম পরিসংখ্যানের বিষয় উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই লেখাটি ব্রিটিশ Philosophical Magazine পত্রিকায় প্রকাশ করতে ব্যর্থ হলে, তিনি আইনস্টাইনকে এই লেখাটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে Zeitschrift für Physik পত্রিকায় প্রকাশের জন্য অনুরোধ করেন। আইনস্টাইন এই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন। জার্মান ভাষায় Zeitschrift für Physik পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধটির নামটি ছিল "Planck's Law and Hypothesis of Light Quanta"। তবে আইনস্টাইন এই প্রবন্ধের কিছু বিষয় সম্প্রসারিত করেছিলেন। আইনস্টাইন প্রবন্ধটি পড়ে উপলব্ধি করেন যে, শূন্য ডিগ্রি তাপামাত্রার কাছে বোসন কণাগুলো ঘনীভূত হতে পারে। বোসন কণার বিষয়ক এই তত্ত্বকে বর্তমানে 'বসু-আইনস্টাইন অবস্থা' নামে পরিচিত। আইনস্টাইন-কর্তৃক সম্প্রসারিত প্রবন্ধ পরবর্তী সময়ে বিজ্ঞানী-মহলে পরিচিতি পায় Bose–Einstein statistics নামে। এই কণার তখন কোনো নাম ছিল না। সত্যেনন্দ্রনাথ বসুর সম্মানার্থে অতিপারমণিক এই বিশেষ ধরণের কণার নাম রাখা হয় বোসন (boson)।

আইনস্টাইনকে লেখা সত্যেন্দ্রনাথ বসুর চিঠি [ চিঠির নমুনা]
Respected Sir, I have ventured to send you the accompanying article for your perusal and opinion. I am anxious to know what you think of it. You will see that I have tried to deduce the coefficient 8π ν2/c3 in Planck's Law independent of classical electrodynamics, only assuming that the ultimate elementary region in the phase-space has the content h3. I do not know sufficient German to translate the paper. If you think the paper worth publication I shall be grateful if you arrange for its publication in Zeitschrift für Physik. Though a complete stranger to you, I do not feel any hesitation in making such a request. Because we are all your pupils though profiting only by your teachings through your writings. I do not know whether you still remember that somebody from Calcutta asked your permission to translate your papers on Relativity in English. You acceded to the request. The book has since been published. I was the one who translated your paper on Generalised Relativity.
      

তাঁর এই প্রবন্ধের সূত্রে, তিনি ইউরোপে গবেষণার সুযোগ পান। ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে ইউরোপ থেকে ফিরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যায়ে ফিরে আসেন। কিন্তু তাঁর কোনো ডক্টরেট থাকায় তিনি অধ্যাপক পদের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আবেদন করতে পারেন নি। অবশ্য আইনস্টাইন তাঁর জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে সুপারিশ করেছিলেন। এরপর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান পদ পেয়েছিলেন। 

১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের পদার্থবিজ্ঞান শাখার সভাপতি হন।
১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হন।
১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত পাকিস্তান বিভাজনের পরে, কলকাতা যান। এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন।
১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দ থেকে কিছুদিন তিনি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি খয়রা অধ্যাপক পদে এবং কয়েক বছর স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগের ডীন পদে দায়িত্ব পালন করার পর অবসর গ্রহণ করেন।
১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত সত্যেন্দ্রনাথ বসু বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।
১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘এমিরিটাস প্রফেসর’ পদে নির্বাচিত হন। এই বছরে লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।
১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দে ভারত সরকার তাঁকে জাতীয় অধ্যাপক নিযুক্ত করে।

১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি  বাংলাভাষায় বিজ্ঞান চর্চার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এ লক্ষ্যে তিনি কলকাতায় ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং এ পরিষদের মুখপত্ররূপে মাসিক ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ প্রকাশ করেন। তিনি ‘দেশিকোত্তম’ এবং ভারত সরকার ‘পদ্মভূষণ’ উপাধিতে লাভ করেছিলেন।


সূত্র:
বাংলা একাডেমী বিজ্ঞান বিশ্বকোষ। ১-৫ খণ্ড (ডিসেম্বর ২০০৫)।
http://bn.banglapedia.org/
http://en.wikipedia.org/