থমাস আলভা এডিসন
Thomas Alva Edison
(১৮৪৭-১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দ)
বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক
টমাস এডিসন ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দের ১১ ফেব্রুয়ারি মার্কিন
যুক্তারাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের মিলানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম
স্যামুয়েল ওগডেন এডিসন জুনিয়র, মায়ের নাম ন্যান্সি মেথিউস এলিয়ট।
১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দে এডিসনের পিতামাতা মিশিগানের পোর্ট হুরনে চলে যান। ফলে তাঁর
শৈশব ও
কৈশোর কেটেছে এখানেই। টমাসকে স্থানীয় একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেয়া
হয়। কিন্তু দুষ্টুমী এবং অমনোযোগিতার কারণে, তাঁর মায়ের কাছে স্কুল থেকে প্রায়ই
অভিযোগ আসা শুরু হয়। পরে মা ন্যান্সি এক পর্যায়ে তাঁকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে এনে
বাসায় পড়াতে শুরু করেন।
এডিসন প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন তাঁর মায়ের কাছে।
১২ বৎসর বয়সে লাল-জ্বর এবং অন্যান্য রোগে আক্রন্ত হওয়ার কারণে শ্রবণ-সমস্যা সৃষ্টি
হয়েছিল।
এডিসন তাঁর কর্মজীবন শুরু করেছিলেন বন্দর হুরন থেকে ডেট্রয়েট পর্যন্ত ট্রেনগুলোতে ক্যান্ডি, সংবাদপত্র এবং শাকসবজি বিক্রি করার মাধ্যমে।
এই ভ্রাম্যমান ব্যসায়ে তাঁর প্রতি সপ্তাহে প্রায় ৫০ ডলার লাভ করতেন। এই অর্থের বেশিরভাগই
তিনি গবেষণার যন্ত্রপাতি কেনার জন্য ব্যয় করতেন। ঘটনাক্রমে তিনি তিন বছর বয়সী জিমি ম্যাকেনজিকে রানওয়ে ট্রেনের ধাক্কায়
থেকে রক্ষা করেছিলেন। এই কারাণে জিমির বাবা (মিশিগানের মাউন্ট ক্লেম্যানস-এর স্টেশন এজেন্ট) জে. ইউ. ম্যাকেনজি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ
তাঁকে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসাবে এডিসনকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রস্তাব দেন। এই সূত্রে
অপারেটরের কাজ শেখেন এবং শেষ পর্যন্ত টেলিফোন অপারেটরের চাকরি পান।
১৮৬৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি লুভলে স্থানান্তরিত হন। সেখানে তিনি কর্মচারী হিসেবে ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে যোগ দেন। তিনি এসোসিয়েটেড প্রেস ব্যুরো সংবাদ সংস্থাতে কাজ করেছেন। ১৮৬৭
খ্রিষ্টাব্দে এক রাতে, তিনি ফ্লোরে সালফিউরিক অ্যাসিড ছিটিয়ে একটি সীসা-অ্যাসিড ব্যাটারি নিয়ে কাজ করছিলেন। এটি ফ্লোরবোর্ডের মধ্যে এবং নিচে দিয়ে এটি গিয়ে তাঁর বসের ডেস্কের দিকে ছড়িয়েছিল। পরদিন সকালে এডিসনকে চাকরি বরখাস্ত করা হয়েছিল।
১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি বোস্টনে থাকাকালে ভোট গণনা যন্ত্র আবিষ্কার করেন। তার প্রথম পেটেন্টটি মার্কিন পেটেন্ট ৯০,৬৪৬ বৈদ্যুতিক ভোট রেকর্ডারের জন্য
ব্যবহার করার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। যন্ত্রটির নাম ছিল 'ইউনিভার্সাল স্টক প্রিন্টার'। ১৮৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ১ জুন যন্ত্রটি অনুমোদিত হয়েছিলেন
এবং স্বত্বাধিকার লাভ করেছিলেন। পরে তিনি যন্ত্রটির চাহিদার কথা বিচার করে এডিসন নিউ ইয়র্ক সিটিতে চলে আসেন।
এখানে থাকার সময় এক টেলিগ্রাফ অপারেটরের সাথে তাঁর পরিচয় ঘটে ফ্র্যাংকলিন লিওনার্ড পোপের
। তিনি এডিসনকে এক ডলার ধার দিয়ে গোল্ড
ইনডিকেটর কোম্পানির ব্যাটারি ঘরে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এখানে দুদিন থাকার
পর লক্ষ্য করলেন অফিসরে ট্রান্সমিটারটি খারাপ হয়ে গিয়েছে। ম্যানেজারের
অনুমতিক্রমে তিনি অল্পক্ষণের মধ্যেই ট্রান্সমিটারটি মেরামত করে ফেললেন। পরে
ম্যানেজার তাঁকে কারখানার ফোরম্যান হিসেবে চাকরি দিয়েছিলেন। তখন তাঁর মাইনে ছিল ৩০০ ডলার। কিছুদিনের মধ্যেই
তিনি নিজের যোগ্যতা বলে ম্যানেজার পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
পরে ফ্র্যাংকলিন লিওনার্ড পোপের সহায়তায় এডিসন 'গোল্ড এ্যান্ড স্টক টেলিগ্রাফ কোম্পানীর
কাছে ৪০ হাজার ডলারে ভোট-গণন যন্ত্রটি বিক্রয় করে দেন। এই টাকায় তিনি নিউ জার্সিতে একটি
গবেষণাগার এবং কারখানা স্থাপন করেন। এখানে তিনি নানা ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরি করতেন
এবং সুবিধাজনক দামে বিক্রয় করতেন। প্রথম গবেষণাগার থেকেই তিনি কোয়ার্ডার প্লেক্স' টেলিগ্রাফ আবিষ্কার করেছিলেন।
এই যন্ত্রের মাধ্যমে একটি তারের মধ্যদিয়ে দুইটি আলাদা জায়গায় সিগন্যাল পাঠানো সম্ভব
হয়েছিল।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে টমাস মেরি স্টিলউয়েল নামের ১৬ বছরের এক নারীকে বিয়ে করেন। মেরি তাঁর একটি কোম্পানীতেই কাজ করতেন। মেরি ও এডিসনের তিন সন্তান হয়েছিল। টমাসের প্রথম সন্তান মেয়ে ম্যারিওনের ডাক নাম ছিল
'ডট'; ম্যারিওনের পরে জন্মান টমাস আলভা এডিসন জুনিয়র, তাঁর ডাকনাম ছিল 'ড্যাশ'। টমাস-মেরি দম্পতির তৃতীয় সন্তান উইলিয়াম এডিসন নিজেও একজন সফল বিজ্ঞানী ও আবিষ্কারক হয়েছিলেন।
১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম কন্যা
মেরিওন এসটেলা এডিসনের জন্ম হয়, তাঁর ডাক নাম ছিল ডট। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে
জন্মগ্রহণ করে প্রথম পুত্র টমাস আলভা এডিসন জুনিয়র। ডাকনাম ছিল ড্যাস। এই স্ত্রীর
গর্ভে জন্মগ্রহণ করেছিল তৃতীয় পুত্র উইলিয়াম লেসলি এডিসন।
১৮৭৬ সালে এডিসনের আবিষ্কৃত একটি যন্ত্রকে বলা যায় আধুনিক উল্কিযন্ত্রের
পূর্বসূরি। অবশ্য তাঁর উদ্দেশ্য ছিল চিকন সুচ দিয়ে কাগজে ছাপার ব্যবস্থা করা। ১৮৯১
সালে স্যামুয়েল ও'রেলি প্রথম উল্কি আঁকার যন্ত্রের পেটেন্ট নেওয়ার পর এডিসনকে নকলের
দায়ে অভিযুক্ত করা হয়।
১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এডিসন তাঁর কার্যক্রম নিউজার্সির মেনলো পার্ক নামক জায়গায় স্থানান্তর করেন। সেখানে তিনি উন্নতমানের
গবেষণাগার ও কারখানা গড়ে তোলেন।
সেই বছরই ওয়েস্টার্ন ইউনিয়ন কোম্পানি তাঁকে আলেকজান্ডার গ্রাহাম বেলের টেলিফোনের সাথে প্রতিযোগিতা করার মতো
যন্ত্র তৈরির অনুরোধ করেন। তবে তিনি এই অনুরোধ প্রত্যখ্যান করেছিলেন। কারণ তিনি তখন
যান্ত্রিকভাবে শব্দধারণ যন্ত্র উন্নয়নে হাত দেন। তাঁর আগে
১৮৫৩ থাকে ১৮৫৪ খ্রিষ্টাব্দের উপযোগী যান্ত্রিক কৌশল প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন
ফরাসি বিজ্ঞানী
Édouard-Léon Scott de Martinvillee।
এর নাম ছিল
ফোনোটোগ্রাফ।
এই যন্ত্রে শব্দের কম্পাঙ্ক কাগজের উপর অঙ্কিত হতো। কিন্তু বাজিয়ে শোনানোর ব্যবস্থা
ছিল না। ফলে এই যন্ত্রটি কোনো ব্যবসায়িক সাফল্য লাভ করে নি।
এরপর ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে শব্দধারণ ও বাদন কৌশল আবিষ্কার করেন ফরাসি ফরাসি কবি
চার্লস ক্রোস
(Charles Cros)
।
তিনি মুদ্রণশিল্পে ব্যবহৃত আলোকচিত্র খোদিত প্রক্রিয়া অনুসরণে এই যন্ত্রটি আবিষ্কার
করেছিলেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে। এই বিষয়ে তিনি ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ এপ্রিলে
ফরাসি বিজ্ঞান একাডেমিতে একটি প্রতিবেদন পাঠান। এই বৎসরে এই যন্ত্র সম্পর্কিত
প্রতিবেদন প্রকাশ করেন ৩০ অক্টোবরে। এই প্রতিবেদনের নাম ছিল
phonographe।
অবশ্য লেখকের পছন্দের নাম ছিল
paleophone
(পেলিওফোন)।
|
|
এডিসন শব্দ ধারণ
এবং তা পুনরায় বাজানোর পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করা কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৭
খ্রিষ্টাব্দের মে এবং জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এই আবিষ্কারের
বিষয়টি প্রকাশ করেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বরে।
ডিসেম্বর মাসে তিনি এই যন্ত্রটিকে সর্ব
সমক্ষে হাজির করেন ২৯ নভেম্বরে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯
ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই আবিষ্কারের স্বত্ত্বাধিকার লাভ করেন। অফিসে গিয়ে যন্ত্রের
মাধ্যমে সবাইকে যে কয়টি কথা- এই 'কথা বলার যন্ত্র' দিয়ে শুনিয়েছিলেন, তা হলো "
Good
morning. How do you do? How do you like the phonograph?"
।
এই যন্ত্রটির নাম দিয়েছিলেন
ফোনোগ্রাফ
।
ফোনোগ্রাফের
উন্নয়নের পাশাপাশি তিনি বৈদ্যুতিক বাতি তৈরির গবেষণা শুরু করেন। উল্লেখ্য, এর আগে হামপ্রে ড্যাভি, হেনরি উডওয়ার্ড ও ম্যাথু ইভান্স
প্রমুখ বিজ্ঞানীরা বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে গবেষণা করে কিছুটা সাফল্য লাভ করলেও
সর্বাসাধারণের ব্যবহারের উপযোগী বাতি বানাতে সক্ষম হন নি। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আধুনিক লাইট বাল্বের সফল
নকশা তৈরি করতে সক্ষম হন।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের
জানুয়ারি মাসে তিনি তাঁর ইলেকট্রিক কোম্পানী গড়ার কাজ শুরু করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো পৃথিবীর সব শহরে তিনি বিদ্যুৎ ও আলো পৌঁছে দেবেন। সেই বছর তিনি
'এডিসন ইল্যুমিনেটিং কোম্পানী' প্রতিষ্ঠা করেন। পরে
এটি 'জেনারেল ইলেকট্রিক কর্পোরেশন নামে পরিচিতি
লাভ করেছিল। ১৮৮১
খ্রিষ্টাব্দে
এডিসন কোম্পানী বেশ কয়েকটি শহরে পাওয়ার
প্ল্যান্ট স্থাপন করা শুরু করেন। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কোম্পানী ম্যানহাটনের ৫৯টি বাড়িতে তাদের বিদ্যুৎ ও আলোর সেবা দেয়া শুরু করে।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে
প্রথম স্ত্রীর মেরি ব্রেন টিউমারে মারা যান।
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে এডিসনের চেয়ে ১৯ বছরের ছোট মিনা মিলারকে বিয়ে করেন।
দ্বিতীয় স্ত্রী মিনার গর্ভেও দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্মায়।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকার নিউ জার্সির ওয়েস্ট-অরেঞ্জ
নামক জায়গায় টমাস বিশাল একটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ ল্যাব প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে
তিনি লাইট ও বিদ্যুৎ এর প্রযুক্তিকে আরও এগিয়ে নেয়ার পাশাপাশি, ফোনোগ্রাফ এবং মোশন
পিকচার ক্যামেরার কার্যকর মডেল তৈরি করেন।
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে জন্মগ্রহয় করেন কন্যা
ম্যাডেলিন এডিসন। ১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন
চার্লস এডিসন
এবং ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ
করেছিলেন পুত্র থিওডর এডিসন ।
১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে এডিসন আবিষ্কার করেছিলেন কিনেটোফো যা সংযুক্ত করা হয় সিনেমার ক্যামেরার সাথে। এরই ফলে তৈরি হয়েছিল সবাক চিত্র।
১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ২৩শে এপ্রিল নিউ ইয়র্ক শহরের ‘কোস্টার এ্যান্ড বিয়াল’স মিউজিক হল’ এ, ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে এডিসন চলচ্চিত্র প্রদর্শন করেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকান সরকার তাঁকে “ন্যাভাল কনসালটিং বোর্ড” এর প্রধান হতে অনুরোধ করে। এই বোর্ডটি সেনাবাহিনী ও নৌ বাহিনীর অস্ত্র পরীক্ষা ও তার উন্নয়ন করতো। দেশপ্রেমের জায়গা থেকে তিনি কাজটি করতে রাজি হয়েছিলেন, কিন্তু নীতিগত জায়গা থেকে হত্যা ও ধ্বংসের বিরুদ্ধে থাকার কারণে, মিসাইল ডেটেক্টর, অস্ত্রের লোকেশন বের করার টেকনিক – ইত্যাদি প্রজেক্টে কাজ করলেও কোনও অস্ত্র বানানোর প্রজেক্টে তিনি কাজ করেননি। তাঁর সাথে সরকারের চুক্তির শর্তই ছিল যে, তিনি শুধু ডিফেনসিভ ও টেকনিক্যাল বিষয়গুলোতে কাজ করবেন। পরে তিনি বলেছিলেন: “আমি গর্বিত যে আমি কখনওই এমন কিছু আবিষ্কার করিনি, যা দিয়ে খুন করা যায়”
১৯৩১ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ই অক্টোবর, ওয়েস্ট অরেঞ্জ এর নিজ বাড়িতে
মৃত্যুবরণ করেন।