ফোনোগ্রাফ
phonograph
থমাস আলভা এডিসনের তৈরি শব্দ ধারণ
এবং তা পুনরায় বাজানোর পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সমন্বয়ে
শব্দধারণ কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৭
খ্রিষ্টাব্দের মে এবং জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে।
এডিসন এমন একটি টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা নিয়ে কাজ করছিলেন, যাতে টেলিগ্রাফে পাঠানো মেসেজকে কাগজের মধ্যে খাঁজ কেটে প্রিন্ট করা যেত, পরবর্তীতে সেটি আবার পাঠানো যেত। এটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার মনে হলো, টেলিফোনে পাঠানো মানুষের কথাকেও এমনভাবে কাগজের মধ্যে ধরে রাখা সম্ভব কি না, যা থেকে পরবর্তীতে আবার সেই কথা শোনা যাবে। এই
ধারণা থেকেই
এডিসন গবেষণা শুরু করেন এবং যে যন্ত্রটি আবিষ্কার করেন এবং
এর নাম রাখেন ফোনোগ্রাফ।
এডিসন শব্দধারণের প্রক্রিয়ায়- কথা বলা হতো একটি চোঙের
ভিতর। শব্দ তরঙ্গাকারে একটি পাতলা পর্দায় বা ডায়াফ্রামে
কম্পন সৃষ্টি হতো। এই ডায়াফ্রামটি যুক্ত
ছিল একটি সূঁচালো শলাকারা সুইয়ের
সাথে। শলাকার অগ্রভাগ টিনের
উপর এটি দাগ কেটে তরঙ্গের রৈখিক তথ্য
অঙ্কন করতো।
এডিসন টিনের পাতের উপর শব্দ ধারণের জন্য একটি
সিলিন্ডার ব্যবহার করেছিলেন। এই
টিনের পাতটি পেঁচানো হয়েছিল ওই সিলিন্ডারে। এই সিলিন্ডার হাতে ঘোরানো জন্য ব্যবহার
করা হয়েছিল একটি হাতল। কথা বলার সময় এই সিলিন্ডার ধীরে ধীরে ঘুরানো হতো। এরপর এই শব্দকে
বাজনোর জন্য জন্যও পৃথক শলাকা ও ডায়াফ্রামের ব্যবহার করা হতো। শলাকাটি টিনের পাতে
অঙ্কিত রেখার খাঁজগুলোর সাহায্যে ডায়াফ্রামে কম্পন তৈরি করতো। এরপর একটি চোঙার ভিতর
দিয়ে কথা বেরিয়ে আসতো।
১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে
এডিসন ফোনোগ্রাফের নকশা সম্পন্ন করেন। এরপর তিনি এই নকশাটি জন ক্রুজি নামের একজন
যন্ত্র-প্রকৌশলীকে দেন। প্রায় ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যেই যন্ত্রটি তৈরি করে নিয়ে আসেন ক্রুজি।
এরপর
এডিসন তৎক্ষণাৎ হর্নটিকে সামনে এনে আবৃত্তি করেন বিখ্যাত 'মেরী হ্যাড অ্যা লিটল ল্যাম্ব' ছড়াটি।
কিন্তু চূড়ান্তভাবে এই আবিষ্কারের
বিষয়টি প্রকাশ করেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বরে। তিনি এই যন্ত্রটিকে সর্ব
সমক্ষে হাজির করেন ২৯ নভেম্বরে। ২২শে ডিসেম্বর 'সায়েন্টিফিক আমেরিকান' ম্যাগাজিনটিতে ছাপা হয়-
এই যন্ত্র সম্পর্কে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। তিনি এই যন্ত্রের বিষয় প্রচারের জন্য
বিজ্ঞাপন প্রচার করেন।
একই বছরের ডিসেম্বরের ২৪ তারিখের দিকে
এডিসন ফোনোগ্রাফের পেটেন্টের জন্য আবেদন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৮৭৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৯
ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই আবিষ্কারের স্বত্ত্বাধিকার লাভ করেন। অফিসে গিয়ে যন্ত্রের
মাধ্যমে সবাইকে যে কয়টি কথা- এই 'কথা বলার যন্ত্র' দিয়ে শুনিয়েছিলেন, তা হলো "
Good
morning. How do you do? How do you like the phonograph?"।
১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে
এডিসন ২০ ডলারে স্ট্যান্ডার্ড ফোনোগ্রাফ বিক্রি করতে শুরু করেন।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ফোনোগ্রাফের আরো একটি উন্নত সংস্করণ বাজারে আনেন, যার বিক্রয়মূল্য ছিল মাত্র ৭.৫০ ডলার।
এরপর
এডিসন
তখন ব্যাপক হারে ফোনোগ্রাফ তৈরি করতে শুরু করেন।
|
এডিসনের দ্বিতীয় ফনোগ্রাফ, ১৮৮৭ |
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড ইস্টন (১৮৫৬-১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং বেশ কিছু ব্যবসায়ীর
সাথে মিলিত হয়ে 'কলাম্বিয়া ফনোগ্রাফ কোম্পানি' নামক একটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসার
শুরুতে এই প্রতিষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং
ডেলাওয়ার-এ 'এডিশন ফনোগ্রাফ' এবং 'ফোনোগ্রাফ সিলিণ্ডার'-এর একচেটিয়া ব্যবসা করতে
সক্ষম হয়। এই সময় এই কোম্পানি গানের প্রচুর সিলিণ্ডার রেকর্ড তৈরি করে। ১৮৯৪
খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কোম্পানি এডিশন এবং 'নর্থ আমেরিকান ফনোগ্রাফ' কোম্পানির
সাথে একত্রে ব্যবসা করে।
ইতিমধ্যে ফনোগ্রাফ নিয়ে টেলিফোন যন্ত্রের আবিষ্কারক গ্রাহাম বেল এবং তাঁর দুই সহযোগী
মিলে গবেষণা শুরু করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াশিংটন ডিসিতে এঁরা এই গবেষণা শুরু
করেছিলেন। এঁরা পাতলা টিনের পাতে শব্দ ধারণের পরিবরতে মোমের প্রলেপ লাগানো কাগজের
পাতে শব্দধারণ করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। নতুন এই যন্ত্রের বাজারজাত করার জন্য
এঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভোল্টা গ্রামোফোন কোম্পানি। যতদূর জানা যায়
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই যন্ত্রটি সর্ব-সাধারণের সামনে হাজির করা হয়েছিল।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমাইল বার্লিনার নতুন ধরনের একটি যন্ত্র হাজির করলেন। তিনি এই যন্ত্রটির নাম দেন
গ্রামোফোন। ধীরে ধীরে
গ্রামোফোন
এডিসনের ফনোগ্রাফকে অপসারিত করেছিল।
এই আবিষ্কারে পর এডিসন বৈদ্যুতিক বাতি নিয়ে গবেষণায় মেতে ওঠেন।
১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আধুনিক লাইট বাল্বের সফল নকশা তৈরি করতে সক্ষম
হন।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দের
জানুয়ারি মাসে তিনি তাঁর ইলেকট্রিক কোম্পানী গড়ার কাজ শুরু করেন। তাঁর স্বপ্ন ছিলো পৃথিবীর সব শহরে তিনি বিদ্যুৎ ও আলো পৌঁছে দেবেন। সেই বছর তিনি
'এডিসন ইল্যুমিনেটিং কোম্পানী' প্রতিষ্ঠা করেন। পরে
এটি 'জেনারেল ইলেকট্রিক কর্পোরেশন নামে পরিচিতি
লাভ করেছিল। ১৮৮১
খ্রিষ্টাব্দে
এডিসন কোম্পানী বেশ কয়েকটি শহরে পাওয়ার
প্ল্যান্ট স্থাপন করা শুরু করেন। ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর কোম্পানী ম্যানহাটনের ৫৯টি বাড়িতে তাদের বিদ্যুৎ ও আলোর সেবা দেয়া শুরু করে।
এই পরিসরে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এডিসনের তৈরি ফোনোগ্রাফের উন্নয়নের চেষ্টা করেন। এর
মধ্যে অন্যতম ছিলেন আলেক্সান্ডার গ্রাহাম বেল। ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি টেলিফোন
আবিষ্কার করেন। এই সূত্রে তিনি ফরাসি সরকারে দেওয়া ভোল্টা পুরস্কার হিসেবে ১০ হাজার
ডলার সম্মানী পান। এই অর্থ দিয়ে তিনি বিদ্যুৎ এবং শব্দ নিয়ে গবেষণার জন্য একটি
গবেষণাগার স্থাপন করেন। গবেষক হিসেবে তাঁর সাথে ছিলেন চার্লস সুমনের
টেইন্টার, চিচেস্টার আলেক্সান্ডার বেল। এঁরা শব্দ ধারণের জন্য টিনের পাতের পরিবর্তে
মোমের প্রলেপ ব্যবহার করে বিশেষ সাফল্য পান। এছাড়া দৃঢ়ভাবে স্থাপিত শব্দ-লেখন কলম
স্টাইলাসের পরিবর্তে ভাসমান স্টাইলাস ব্যবহার করেন। এই নতুন আবিষ্কারের জন্য এঁরা
পুরস্কার এবং পেটেন্ট লাভ করেছিলেন ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ৪ মে। এই যন্ত্রটি তাঁরা
জনসমক্ষে উপস্থাপন করেছিলেন গ্রাফোফোন নামে। এরপর বেল এবং টেইনের এডিসনের কাছে যান
এবং সমবেতভাবে কাজ করার অনুরোধ করেন। কিন্তু এডিসন তা প্রত্যাখ্যান করেন এবং নিজেই
এর উন্নয়ন ঘটাবেন বলে জানান।
|
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে এডিসনের উন্নত ফনোগ্রাফ |
বৈদ্যুতিক বাতি তৈরিতে সাফল্য লাভের পর
এডিসন পুনরায় তাঁর ফোনোগ্রাফের উন্নয়নে হাত দেন।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রতিষ্ঠিত করেন এডিসন ফোনোগ্রাফ কোম্পানি। ১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের
মে মাসের দিকে তিনি উন্নতর ফোনোগ্রাফ আবিষ্কার করেন। তিনি গ্রাহাম বেলের
গ্রাফোফোনের আদলে টিনের পাতের পরিবর্তে মোম ব্যবহর করেন। এতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন
সেরেসিন, মৌমাছির মোম ও স্টিয়ারিক মোম। এডিসনের কাছ থেকে এই কোম্পানি
Jesse H. Lippincott
কিনে নেন এবং আমেরিকান গ্রাফোফোন কোম্পানি নামে নতুন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠাব চালু
করেন। শুধু তাই নয় এই সময় যত ফোনোগ্রাফ নির্মাতা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশের সাথে মিলে
১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ জুলাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল নর্থ আমেরিকান ফোনোগ্রাফ কোম্পানি।
কিন্তু শেষ পর্যনত এই কোম্পানি ততটা লাভের মুখ দেখতে পায় নি।
১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দে এডিসন ফনোগ্রাফের যান্ত্রিক কৌশল ব্যবহার করে তৈরি করেন কথা বলা
পুতুল। এই পুতুল তিনি তৈরি করেছিলেন একটি পুতুল কোম্পানির সাথে মিলিত হয়ে। ১৮৯১
খ্রিষ্টাব্দের মার্চ মাসে এই কোম্পানির সাথে এডিসনের চুক্তি বাতিল হয়ে যায়। পুতুল
তৈরির পাশাপাশি এডিসন বিনোদনের উপযোগী কিছু সঙ্গীত-সিলিন্ডার বাজারজাত করে। এগুলো
তিনি তৈরি করেছিলেন মুদ্রা-স্লট ম্যাশিনের জন্য।
১৮৯০
খ্রিষ্টাব্দে নর্থ আমেরিকান ফোনোগ্রাফ কোম্পানির প্রধান লিপ্পিনকোট অসুস্থ হয়ে
পড়েন এবং কোম্পানির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন এডিসন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে দেনার দায়ে এই
কোম্পানি ব্যাংক দেউলিয়া হিসেবে ঘোষিত হয়। এই কারণে এডিসন বড় ধরনের ব্যবসায়িক
কার্যক্রম শুরু করার যোগ্যতা হারান। এই সময় নতুন নতুন আবিষ্কারে মেতে ওঠেন। ১৮৯৫
খ্রিষ্টাব্দে এডিসন স্পরিং মোটোর ফোনোগ্রাফ তৈরি করেন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে
ব্যাংক-দেউলিয়া সমস্যার সমাধান হলে, ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে তিনি নতুন করে
শুরু ফোনোগ্রাফের ব্যবসা শুরু করেন। এই কোম্পানির নাম ছিল ন্যাশানাল ফোনোগ্রাফ
কোম্পানি। ১৯৯৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি এই যন্ত্রের উন্নয়ন করে। এর নাম দেওয়া হয় এডিসন
স্ট্যান্ডার্ড ফোনোগ্রাফ। ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তা সর্বসমক্ষে প্রদর্শন করেন।
১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে বাজারজাতকৃত এই যন্ত্রের দাম ছিল ১৫০ ডলার। ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের
এর দাম রাখা হয়েছিল ২০ ডলার। বিজ্ঞাপনে এর নাম লেখা থাকতো দ্যা এডিশন নিউ
স্ট্যান্ডার্ড ফোনোগ্রাফ। এর জেম মডেলের দাম ছিল ৭.৫০ ডলার।
১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দে
কলাম্বিয়া
রেকর্ড কোম্পানি সিলিন্ডার রেকর্ড উৎপাদনে আসে। এবং দ্রুত এডিসনের সিলিন্ডার
রেকর্ডের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। কিন্তু ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বিয়া
রেকর্ড কোম্পানি সিলিন্ডার রেকর্ড উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে এডিসন
সিলিন্ডার রেকের্ডের উৎপাদন বন্ধ করে দেয়।