গ্রামোফোন
Gramophone
গ্রামোফোন রেকর্ডের উন্নয়ন, তৈরি ও বাজারজাত করার প্রতিষ্ঠান।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের বিজ্ঞানীদের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় শব্দ ধারণের প্রচেষ্টার সূত্রের গ্রামোফোন রেকর্ডের উদ্ভব হয়েছিল। প্রকৃত শব্দধারণ করার প্রথম যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন ফরাসি বিজ্ঞানী
Édouard-Léon Scott de Martinville । এই যন্ত্রটির স্বত্বাধিকার গ্রহণ করা হয়েছিল ১৮৫৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ মার্চ। এরপর নানা ধরনের গবেষণা হয়েছে ইউরোপ আমেরিকায়। অনেক পরে থমাস আলভা এডিসন শব্দ ধারণ এবং তা পুনরায় বাজানোর পূর্ণ প্রক্রিয়াটি সমন্বয় করা কৌশল আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের মে এবং জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে। কিন্তু চূড়ান্তভাবে এই আবিষ্কারের বিষয়টি প্রকাশ করেন ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে নভেম্বরে। ডিসেম্বর মাসে SCIENTIFIC AMERICAN তিনি আর এই যন্ত্রটিকে সর্ব সমক্ষে হাজির করেন ২৯ নভেম্বরে। এডিসন এর নাম দিয়েছিলেন ফোনোগ্রাফ

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে জার্মান-আমেরিকান এমিল বার্লিনার নতুন ধরনের একটি যন্ত্র হাজির করলেন। তিনি এই যন্ত্রটির নাম দেন গ্রামোফোন। গ্রামোফোন যন্ত্রটি ছিল মূলত এডিসনের ফোনোগ্রাফ যন্ত্রের উন্নত সংস্করণ। এরপূর্বে গ্রাহাম বেল এবং তাঁর দুই সহযোগী ফনোগ্রাফের উন্নয়ন করেছিলেন।

ইতিমধ্যে ফনোগ্রাফ নিয়ে টেলিফোন যন্ত্রের আবিষ্কারক গ্রাহাম বেল এবং তাঁর দুই সহযোগী মিলে গবেষণা শুরু করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ওয়াশিংটন ডিসিতে এঁরা এই গবেষণা শুরু করেছিলেন। এঁরা পাতলা টিনের পাতে শব্দ ধারণের পরিবরতে মোমের প্রলেপ লাগানো কাগজের পাতে শব্দধারণ করার প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করেন। নতুন এই যন্ত্রের বাজারজাত করার জন্য এঁরা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ভোল্টা গ্রামোফোন কোম্পানি। যতদূর জানা যায় ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই যন্ত্রটি সর্ব-সাধারণের সামনে হাজির করা হয়েছিল।

১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানি ভেঙে যায়। পরে এই কোম্পানি নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। এই কোম্পানির নাম ছিল
Victor Talking Machine Company

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এডওয়ার্ড ইস্টন (১৮৫৬-১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দ) এবং বেশ কিছু ব্যবসায়ীর সাথে মিলিত হয়ে 'কলাম্বিয়া ফনোগ্রাফ কোম্পানি' নামক একটি প্রতিষ্ঠা করেন। ব্যবসার শুরুতে এই প্রতিষ্ঠান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসি, মেরিল্যান্ড এবং ডেলাওয়ার-এ 'এডিশন ফনোগ্রাফ' এবং 'ফোনোগ্রাফ সিলিণ্ডার'-এর একচেটিয়া ব্যবসা করতে সক্ষম হয়। এই সময় এই কোম্পানি গানের প্রচুর সিলিণ্ডার রেকর্ড তৈরি করে। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এই কোম্পানি এডিশন এবং 'নর্থ আমেরিকান ফনোগ্রাফ' কোম্পানির সাথে একত্রে ব্যবসা করে। পরে এই কোম্পানি তৈরি করেছিল
কলাম্বিয়া রেকর্ড

১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে এমাইল বার্লিনার নতুন ধরনের একটি যন্ত্র হাজির করলেন। তিনি এই যন্ত্রটির নাম দেন গ্রামোফোন। ধীরে ধীরে গ্রামোফোন এডিসনের ফনোগ্রাফকে অপসারিত করেছিল। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রেকর্ড বাজারজাত করা শুরু হয়। তখন এই রেকর্ডের ব্যাস ছিল ৫ ইঞ্চি (১৩ সেন্টিমিটার)। এই রেকর্ড একটি থালার উপরে রেখে হাতল ঘুরিয়ে চালাতে হতো।  রেকর্ড তৈরি হতো শক্ত রাবার জাতীয় পদার্থ দিয়ে। মূলত এই রেকর্ডগুলো ছিল শব্দ তৈরির খেলনা সামগ্রীর মতো। পরে এই যন্ত্রটির শব্দধারণ প্রক্রিয়াটিকে আরও কম ব্যয়বহুল করে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। কারণ ছাপ দেওয়া প্রক্রিয়ায়, একই রেকর্ডের অনেকগুলো কপি তৈরি করা যেতো। কিন্তু সিলিন্ডার পদ্ধতির রেকর্ডে তা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শব্দের মানের বিচারে এডিসনের সিলিন্ডার পদ্ধতিতে ধারণকৃত শব্দের মান অনেক ভালো ছিল।
 

১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বার্লিনারের গ্রামোফোন রেকর্ড

১৮৯২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে রেকর্ড বিপণনের জন্য একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল
United States Gramophone Company

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রথম রেকর্ড বাজারজাত হয়। এই রেকর্ডগুলোর ব্যাস ছিল ৭ ইঞ্চি। তখন এই রেকর্ডের উপর লেবেল লেখা থাকতো
E. BERLINER GRAMOPHONE

১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দের পরে স্লেট এবং চুনাপাথরের মিশ্রণ দিয়ে রেকর্ড তৈরি শুরু হয়। একে সাধারণভাবে মাটির রেকর্ড বলা হয়ে থাকে। এই রেকর্ডগুলো বেশ ভারি হতো। বার্লিনার রেকর্ড কোম্পানি ৭ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড প্রকাশ করে। এর ঘূর্ণগতি ছিল ৭০আরপিএম।

১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম ব্যারি ওয়েন (
William Barry Owen), এমিল বার্লিনারের ব্যবসার সাথে যুক্ত হন এবং UK Gramophone Company প্রতিষ্ঠা করেন।

১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে বার্লিনারের গ্রামোফোন কোম্পানি প্রথম প্রকাশ করেছিল ১০ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড বাজারজাত করে।

উল্লেখ্য ভিক্টোরিয়া টকিং ম্যাশিন কোম্পানি কখনোই গ্রামোফোন কোম্পানির শাখা বা অর্থানুকুল্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল না। এরা মূলত বার্লিনার কোম্পানির জন্য টকিং ম্যাশিন তৈরি করতো। কলাম্বিয়া এবং ভিক্টোরিয়া ফ্ল্যাট রেকর্ড তৈরি শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর সাথে অবশ্য ইংল্যান্ডের গ্রামোফোন কোম্পানি এবং আমেরিকার বাইরের কিছু রেকর্ড তৈরির প্রতিষ্ঠানও যুক্ত ছিল। এরাই প্রথম সমতলীয় রেকর্ড প্রচলন করেছিলেন এমিল বার্লেনিয়ার। এরপর এডিশন পরে সমতলীয় রেকর্ড তৈরি করা শুরু করেন। এর নাম ছিল ডায়ামন্ড ডিস্ক।

১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে এরা বাজারজাত করেছিল ১২ ইঞ্চি ব্যাসের রেকর্ড। এই সকল রেকর্ডের বাদনকাল ছিল ২ মিনিট।
গ্রামোফোন এ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড কলকাতায় শাখা অফিসের প্রথম ম্যানেজার ছিলেন জন ওয়াটসন হাওড। ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে গিয়ে নতুন রেকর্ড কোম্পানি নিকোল রেকর্ড কোম্পানির পরিচালকের পদ গ্রহণ করেন।

১৯০০ খ্রিষ্টাব্দে উইলিয়াম ওয়েন
Lambert Typewriter Company তৈরির অধিকার লাভ করেন। এই সূত্রে এই কোম্পানির নাম হয় Gramophone & Typewriter Ltd. । অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শাখার অবনতি হলে, কলাম্বিয়া রেকর্ডস এবং জোনোফোন এই শাখাকে কিনে নেয়। এর ভিতর গ্রামোফোন টকিং মেশিন তৈরিকারক এল্ড্রি আর জনসন (Eldridge R. Johnson) নতুন একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। এই নামকরণ করা হয় Victor Talking Machine Company। প্রথম দিকে কলাম্বিয়া রেকর্ড-এর সাথে সত্তাধিকার নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে এই দ্বন্দ্ব মিটে গেলে, এরা ফ্ল্যাট রেকর্ড তৈরি করা শুরু করে।

এডিনের সমতলীয় রেকর্ড

উল্লেখ্য ভিক্টোরিয়া টকিং ম্যাশিন কোম্পানি কখনোই গ্রামোফোন কোম্পানির শাখা বা অর্থানুকুল্যে পরিচালিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছিল না। এরা মূলত বার্লিনার কোম্পানির জন্য টকিং ম্যাশিন তৈরি করতো। কলাম্বিয়া এবং ভিক্টোরিয়া ফ্ল্যাট রেকর্ড তৈরি শুরু করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এর সাথে অবশ্য ইংল্যান্ডের গ্রামোফোন কোম্পানি এবং আমেরিকার বাইরের কিছু রেকর্ড তৈরির প্রতিষ্ঠানও যুক্ত ছিল। এরাই প্রথম সমতলীয় রেকর্ড প্রচলন করেছিলেন এমিল বার্লেনিয়ার। এরপর এডিশন পরে সমতলীয় রেকর্ড তৈরি করা শুরু করেন। এর নাম ছিল ডায়ামন্ড ডিস্ক।

১৯০৭ খ্রিষ্টাব্দে এই কোম্পানির নিউইয়র্ক প্রতিনিধি আলফ্রেড ক্লার্ক প্যারিস অপেরার জন্য ২৪টি সমতলীয় রেকর্ড তৈরি করে। এই রেকর্ডগুলো লোহা এবং সীসার তৈরি বাক্সে ভরে সংরক্ষণ করা হয় অপেরা হাউসের নিচের কক্ষে।

১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের পূর্বে রেকর্ডের ঘূর্ণনমান সুনির্দিষ্ট ঠিক রাখা হতো না। ফলে এক যন্ত্রের রেকর্ড করা শব্দ বা রেকর্ড অন্য যন্ত্রে যথাযথভাবে বাদিত হতো না। এই অসুবিধা দূর করার জন্য, ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই ঘূর্ণন গতি নির্দিষ্ট করা হয়। প্রথম এই নির্দিষ্ট গতি ছিল ৭৮-আরপিএম। তখন রেকর্ডের প্রতি পিঠে প্রায় ৪১ মিনিটের শব্দ ধারণ করা হতো। এই সময় সিলিণ্ডার বা চোঙের মধ্যে রেকর্ডের শব্দকে প্রেরণ করে শব্দের উচ্চতা বৃদ্ধি করা হয়েছিল

১৯২০ খ্রিষ্টাব্দের ইলেকট্রিক লাউড স্পীকার গ্রামোফোনে ব্যবহার শুরু হয়। রেকর্ডের ঘূর্ণন মানের বিচারে তিন ধরনের রেকর্ড বাজারজাত হয়েছিল।

১৯২৫ খ্রিষ্টাব্দে সকল ধরনের রেকর্ডের ঘূর্ণনগতির একটি আদর্শমান দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সময় রেকর্ডের সাধারণ ঘূর্ণন মান ৭৮ আরপিএম ঠিক রেখে অন্যান্য রেকর্ডের ঘূর্ণনগতি নির্ধারণের উদ্যোগ নেওয়া হব। এই সূতরে দুটি ঘূর্ণন গতিকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এই মান দুটি হলো— 45 এবং 33⅓ আরপিএম।

১৯৩০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বেশ নমনীয় প্লাস্টিকের রেকর্ড বাজারজাত করেছিল কিছু কোম্পানি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো ছিল জার্মানির ফোনিকর্ড এবং ব্রিটিশ ফিল্মোফোন ও গুডসন। কিন্তু এদের কোনো রেকর্ডই শেষ পর্যন্ত বাজারে টিকে থাকতে পারে নি।

১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের বেতার সম্প্রচারের জন্য ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভাইনাল রেকর্ড প্রকাশ করা হয়েছিল। এগুলোর ঘূর্ণগতি ছিল ৩৩ আরপিএম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ভাইনাল রেকর্ড একটি দীর্ঘবাদন রেকর্ডের আদর্শ মান হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।

১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে কলাম্বিয়া রেকর্ড কোম্পানি প্রথম দীর্ঘবাদন রেকর্ড প্রকাশ করে। এই সময়ে ঘূর্ণন গতি ছিল 33⅓ আরপিএমি।

১৯৫৬-১৯৮৫ ফরাসি French Pathé Cellodiscs পাতলা ভাইনাল প্লাস্টিক দিয়ে রেকর্ড তৈরি করেছিল। এগুলো খুব বেশিদিন ব্যবহার করা যেতো না। 



সূত্র:
The Gramophone Company's First Indian Recordings (1899-1908)/Michaet Kinnear