মদিনা
নজরুলের রচিত একটি নাটক।

নজরুল পুরোপুরি সজ্ঞান দশায় যাওয়ার কিছু আগে এই নাটকটি রচনায় হাত দিয়েছিলেন। নাটকের কাহিনি বা তর পটভূমি তাঁর চেতনায় ছিল। তিনি সেই পটভূমি অবলম্বনে ৪৩টি গান সংযোজন করেছিলেন। এই বিচারে বলা যায়- এই নাটকের ছকটি ছিল বেশ বড়।

১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দের (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ) প্রথম দিকে থেকে নজরুল পুরোপুরি নির্বাক ও স্থবির হয়ে গিয়েছিলেন। এই বিচারে ধারণা করা যায়, এই বিচারে ধারণা করা যায় যে, নজরুল এই নাটকের গানগুলো রচনা শুরু করেছিলেন ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে মাঝামাঝি। পাণ্ডুলিপিতে গানগুলোর সাথে নাটকের নির্দশনা-স্বরূপ কিছু বাক্য পাওয়া যায়।

এই গীতি-আলেখ্যটি সংগ্রহ করেছিলেন আব্দুল আজিজ। এই নাটকের গানগুলো প্রথম গীতি আলেখ্যটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল 'নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা' জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২ সংখ্যায়। এই পাণ্ডুলিপির সংগ্রাহক আব্দুল আজিজ এই একটি ভূমিকা লিখেছিলেন-

'নজরুল অসংখ্য গীতিনাট্য, গীতিনক্সা, রেকর্ডনাট্য, গীতিআলেখ্য, নাটিকা রচনা করেছিলেন- কখনো বেতারের জন্য, কখনো রেকর্ড কোম্পানির তাগিদে, কখনো সিনেমার প্রয়োজনে । কবির সহকর্মী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী জানিয়েছিলেন কেবলমাত্র বেতারের জন্য নজরুল কিছু কম একশোর মতো গীতিআলেখ্য রচনা করেছিলেন, রেকর্ড কোম্পানির জন্য যে আলেখ্যগুলি রচিত হয়েছিল, অনুমান করা যায় সে সবের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়। এইসব হারিয়ে যাওয়া গীতিনক্সা বা রেকর্ড নাট্যের মধ্যে আজ পর্যন্ত আমরা তিরিশটির মতো উদ্ধার করেছি। এছাড়া 'বিদ্যাপতি'র পাণ্ডুলিপি আমাদের হস্তগত হয়েছে, পরিচিতিমূলক পুস্তিকা পাওয়া গেলেও 'সাপুড়ে'র পাণ্ডুলিপি বা মূল পাঠ পাওয়া প্রয়োজন। কবি যে অসংখ্য গীতিনাট্য রচনা করেছিলেন 'মদিনা' শিরোনামে নাটকটি তাদেরই একটি। 'মদিনা'-র মূল পাণ্ডুলিপি সম্প্রতি আমাদের হাতে এসেছে। আবার কোনোটিতে সামান্য কিছু সংলাপ আছে। “মদিনা'য় কোনো সংলাপ নেই। সম্ভবত এটি কোন গীতিনক্সা নয়, 'মদিনা'কে নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক রচনা করতে চেয়েছিলেন কবি। তিনি নিজেও এটিকে 'নাটক' নামে অভিহিত করেছেন, লিখেছেন 'আমার “মদিনা” নাটক।

কবি প্রথমেই 'মদিনা'র কাহিনীটি মনে মনে স্থির করে নিয়েছিলেন, তারপর গানগুলি লিখে গেছেন পরপর। পূর্বলিখিত বহু গানও এ নাটকে স্থান পেয়েছে, তবে অধিকাংশ গানই কাহিনীর পরিবেশ ও প্রয়োজনের পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত হয়েছে। কোনো কোনোটির সামান্য কিছু পরিবর্তন হয়েছে শব্দে। যেমন ৬, ৭, ১৪, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ৩১, ৩৩, ৩৪, ৩৮, ৩৯ এবং ৪৩ সংখ্যক গান। কোনো কোনোটি বহুল পরিবর্তিত- কেবল শব্দ নয়, পরিবর্তনের সঙ্গে সংযোজিত হয়েছে নতুন চরণ-_যেমন ১০, ১২, ১৫, ১৬ এবং ৩৬ সংখ্যক গানসমূহ। কয়েকটি গানে আবার কোনোরূপ পরিবর্তনের প্রয়োজনই হয়নি, কাহিনীর সঙ্গে এই গানগুলি ঠিক মানানসই হয়েছিল- ১৫, ১৭, ২৬, ২৭, ২৮, ২৯, ৩০, ৩৫, ৩৭ এবং ৪২ সংখ্যক গানগুলি এই শ্রেণীর। বারোটি গান একেবারে নতুন_যা ইতিপূবে কোথাও প্রকাশিত হয়নি। এর মধ্যে কয়েকটি গান কেবল “মদিনা'র জন্য লিখিত, এই বারোটি গান হলো ১, ২, ৩, 8, ৫, ৮, ১১, ১৩, ১৮, ২০, ২৪ এবং ৪১ সংখ্যক গান। 'মদিনা'র গানের সংখ্যা ৪৩।...'

'কাহিনীটি মিলনান্তক। নায়ক কবি স্বয়ং যিনি 'নৌজোয়ান এবং যাকে ভালোবাসে বাংলার সব নরনারী', নায়িকা 'মদিনা"- যিনি মহারাজার মেয়ে এবং পর্দানশিন। পার্শ্বচরিত্রের মধ্যে নর্তকী ছাড়া আরও দু-একজন আছেন যাদের কোনো নামকরণ কবি করেননি। কাহিনীটি যে মিলনান্তক তার প্রমাণ রয়েছে শেষদিকের গানে (৪১ সংখ্যক) 'বিবাহের বাজল বাঁশি আজি মোর নৌজোয়ান জীবনে।' প্রথম গানেই কবিপুত্র 'সানি' এবং 'নিনি'র নামও উল্লেখিত হয়েছে।

'মদিনা' নাটকটির পরিকল্পনা কবি সম্ভবত সজ্ঞান মুহূর্তের একেবারে শেষের দিকে গ্রহণ করেছিলেন, কেননা সংগীত রচনায় ছন্দ ও ভাবের মধ্যে কিছুটা দুর্বলতা রয়েছে এবং হস্তাক্ষরে যথেষ্ট আড়ষ্টতা ও বাঁকাচোরা ভাব লক্ষ্য করা যায়, বোঝা যায় রোগের আক্রমণ তখন শুরু হয়ে গেছে। সুঠাম দেহ থেকে নজরুলী যৌবন ঝরে যাবার মতো লেখা থেকে সেই অপরূপ লীলায়িত নজরুল ছন্দও উধাও হয়েছে। পাণ্ডলিপিতে যে বানান আছে, যেমন যতিচিহ্নের ব্যবহার দেখেছি, যেমন ছন্দ পেয়েছি কোনো কিছু পরিবর্তন না করে সেভাবেই প্রকাশের জন্য দিলাম। আমার মনে হয় এভাবেই হুবহু উপস্থাপিত হলে, অনেকখানি 'নজরুল-সৌরভ” পাওয়া যেতে পারে।'

বাংলা একাডেমী কর্তৃক প্রকাশিত 'নজরুল রচনাবলী'র জন্মশতবর্ষ সংস্করণ অষ্টম খণ্ডে  [১২ই ভাদ্র ১৪১৫, ২৭শে আগষ্ট ২০০৮] মদিনা নাটকটির যে পাঠ যে অনুক্রমে মুদ্রিত হয়েছে, তার অনুসরণে নিচের তালিকাটি দেওয়া হলো।

  1. মদিনা! মদিনা! মদিনা  [তথ্য]
    নায়কের প্রথম গান/নৌজোয়ানের গান। [নতুন গান]
  2. আমি মদিনা মহারাজার মেয়ে [তথ্য]
    মদিনার গান। [নতুন গান]
  3. মদিনা মদিনা কেন তোমার এত অহঙ্কার [তথ্য]
     আমার 'মদিনা' নাটকের আধুনিক গান।[নতুন গান]
  4. আরক্ত কিংশুক কাঁপে [তথ্য]
    নর্তকী তরুণীদের গান।[নতুন গান]
  5. চৈত্র পূর্ণিমা রাত্রি [তথ্য]
    নর্তকী তরুণীদের গান।[নতুন গান]
  6. ভোরে ঝিলের জলে শালুক পদ্ম তোলে কে [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকের জন্য আধুনিক গান/আমি গাইব (শচীন দেব বর্মণ গাইবে লিখে কেটে দিয়ে)। পূর্বে রচিত গান।
  7. নিশি রাতে রিম্‌ ঝিম্‌ ঝিম্‌ বাদল নূপুর [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটক.../ (শৈল দেবী গাইবে)/প্রতাপ বরালী-আদ্ধা কাওয়ালি। পূর্বে রচিত গান।
  8. মহুয়া বনে আধো নিশীথ রাতে  [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকে.../ (শৈল দেবী)/ঠুমর-তেতালা। পৃষ্ঠা: ৩০৪।পূর্বে রচিত গান।
  9. বুলবুলি নীরব নার্গিস-বনে [গান-১৬২৪] [তথ্য]
  10. আবার ভালোবাসার সাধ জাগে [গান-১০৬৪] [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকে দিব/ আধুনিক গান/কুমারী ইলা ঘোষ পৃষ্ঠা: ৩০৫।]
  11. এসো এসো বন ঝরনা [গান-১১৯২] [তথ্য]
  12. ইরানের রূপ-মহলের শাহজাদী শিঁরী [গান-১১৪৬] [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকের আধুনিক গান/নৌজোয়ান
  13. মম তনুর ময়ূর সিংহাসনে এসো রূপকুমার কবি [গান-১৬৬৭] [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকে/শৈল দেবী গাইবে।
  14. ছড়ায়ে বৃষ্টির বেলফুল [গান-১৩৯২] [তথ্য]
    আমার 'মদিনা' নাটকের গান/শৈল দেবী, কুমারী ইলা ঘোষ, নমিতা ঘোষ (বুলা), মন্টু  গাইবে।