বিষয়: নজরুলসঙ্গীত
শিরোনাম: ভোরে ঝিলের জলে শালুক-পদ্ম তোলে কে
ভোরে ঝিলের জলে শালুক-পদ্ম তোলে কে
ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী
ফুল দেখে বেভুল সিনান বিসরি'॥
একি নূতন লীলা আঁখিতে দেখি ভুল
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে আকাশ-গাঙে অরুণ-গাগরি॥
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢল ঢল
গ'লে পড়ে শত সে তরঙ্গে,
শারদ-আকাশে দলে দলে আসে
মেঘ, বলাকার খেলিতে সঙ্গে।
আলোক-মঞ্জরি প্রভাত বেলা
বিকশি' জলে কি গো করিছে খেলা
বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি'॥
- পাঠান্তর: বাংলা একাডেমী থেকে
প্রকাশিত নজরুল-রচনাবলীঅষ্টম
খণ্ডে,
'মদিনা' নাটকে গানটি পাওয়া যায়। এই গানটির সাথে কবি নজরুল ইন্সটিটিউট
থেকে প্রকাশিত নজরুল সংগীত সংগ্রহের সাথে প্রচুর শব্দ-পার্থক্য
লক্ষ্য করা যায়। নিচে
বাংলা একাডেমী থেকে প্রকাশিত নজরুল-রচনাবলী অষ্টম
'মদিনা' নাটকের এই সম্পূর্ণ গানটি উল্লেখ করা হলো। পৃষ্ঠা ৩০৩।
একা
ঝিলের জলে শালুক-পদ্ম তোলে কে
ভ্রমর-কুন্তলা কিশোরী?
আধেক অঙ্গ জলে, রূপের লহর তোলে
সে
ফুল দেখে বেভুল সিনান বিসরি'॥
একি নতুন ছবি আঁখিতে
দেখি ভুল,
কমল ফুল যেন তোলে কমল ফুল
ভাসায়ে ঝিলের জলে অরুণ-গাগরি॥
ঝিলের নিথর জলে আবেশে ঢলঢল গলে পড়ে
সে শত তরঙ্গে,
শারদ-আকাশে দলে দলে আসে মেঘ-বলাকা খেলিতে সঙ্গে!
আলোক-মঞ্জরি প্রভাত বেলা
বিকশি জলে কি গো করিছে খেলা?
আবেশে বুকের আঁচলে ফুল উঠিছে শিহরি'॥
- ভাবসন্ধান: ১৯৪১-৪২ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল ইসলাম ‘মদিনা’ নামক একটি চলচ্চিত্রের জন্য চিত্রনাট্য রচনা করেন। এই চলচ্চিত্রের গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালকও ছিলেন তিনি। এ সিনেমার জন্য তিনি মোট ১৫টি গান রচনা করেছিলেন। এই গানটি ছিল ওই চিত্রনাট্যের ষষ্ঠ গান। কিন্তু ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ায় সিনেমাটি আর মুক্তি পায়নি। এই চিত্রনাট্যটিও হারিয়ে গেছে। তাই এই গানটি কোনো প্রেক্ষাপটে রচনা করেছিলেন তা আর জানবার উপায় নেই।
এই গানের শুরুতে পাওয়া যায়- কোনো এক ভ্রমর-কৃষ্ণকেশিনী কিশোরী কথা। এই কিশোরী এসেছে শালুক-পদ্মের ভরা ঝিলে প্রাতঃস্নানে। ঝিলময় ছড়ানো পদ্ম-শালুক দেখে সে স্নানের কথা ভুলে গিয়ে পুষ্পচয়নে মগ্ন হয়ে যায়।
হয়তো চিত্রনাট্যের নায়ক মুগ্ধ হয়ে যায়, শারদপ্রাতের পুষ্পশোভিত ঝিল আর পুষ্পচয়নরতা কিশোরীর সৌন্দর্য-দর্শনে। মুগ্ধ দর্শকের কাছে মনে হয়- এ যেন জগতের নবতর এক সৌন্দর্যলীলা। তাঁর কাছে মনে হয় কিশোরী পদ্মফুলরূপিণী হয়ে ঝিলের পদ্ম তুলছে। তার অরুণ-বর্ণের গাগরির সৌন্দর্য শরতের আকাশগঙ্গাকে ছাপিয়ে গেছে।
যেমন নিথর জলে আবেশিত সৌন্দর্য মহিমা শত তরঙ্গ হয়ে প্রকৃতিকে আচ্ছন্ন করে। তাকে আরো মহিমান্বিত করে শরতের মেঘ, যেন সে মেঘ খেলা করে উড়ন্ত বলাকার সাথে আনন্দরঙ্গে। ভোরের আলোকপুষ্প কিশোরীকমল আর ঝিলের কমলের সাথে চলে রঙ্গ। কিশোরীর আঁচলের ফুলও সৌন্দর্য-আবেশে, একই আনন্দে শিহরিত হয়।
চলচ্চিত্রের কিশোরীকে যদি আমরা ভুলে যাই, তাহলে এই গানের কিশোরী হয়ে উঠে দ্ব্যার্থক। একই সাথে সে কোনো মানব কন্যা এবং আপার্থিব কিশোরী। আবার কবি কল্পনায় শরতই যেন সেই অপার্থিব কিশোরী। শারদসুন্দরীর সৌন্দর্যে মুগ্ধ কবি, কিশোরীর বিমূর্ত রূপকে মানবকন্যার আধারে মূর্তীময়ী করে তুলেছেন।
গানটি জিলফ রাগে ত্রিতালে নিবদ্ধ। ভৈরব ঠাটের জিলফ কোমল ঋষভ এবং এবং শুদ্ধ নিষাদ বর্জিত ঔড়ব জাতির রাগ। কিন্তু এই গানে এই দুটি স্বরের প্রয়োগে ভৈরবের স্নিগ্ধ সৌরভ পাওয়া যায়। কিন্তু শুদ্ধ ঋষভ প্রয়োগের কারণে ভৈরবের সে সৌরভ ম্লান হয়ে যায়। আবার কখনো শুদ্ধ নিষাদ চৈতন্যের গভীরে ভাবকে প্রথিত করে, আবর কখনো কোমল নিষাদ সেই ভাবকে আকাশচারী তরণীর অভিযাত্রী হয়ে উঠে। সব মিলিয়ে সুর বাণীকে মুক্তি দেয় সৌন্দর্যের অমরাবতীতে।
গানটির শুরুতেই না র্সা হয়ে শুদ্ধ ঋষভে পৌঁছে না দপা মা-এর প্রয়োগে ভোরের ঝলের জলকে স্নিগ্ধ করে ভ্রমর কুন্তলা কিশোরী যখন কোমল ঋষভ হয়ে ষড়্জতে দাঁড়ায়, তখন সুরের অঙ্গনে অপার্থিব সঙ্গীতসৌন্দর্য সৃষ্টি করে। এই কিশোরী তখন হয়ে উঠে পদ্মফুলরূপিণী। তার অরুণ-বর্ণের গাগরির সৌন্দর্য শরতের আকাশগঙ্গাকে ছাপিয়ে যায়- কোমল নিষাদ ও কোমল ধৈবতের আকাশ তরণীতে সওয়ার হয়ে। এ তরণী তৈরি হয় ণর্স ণদ, প দপা স্বরবিন্যাসে।
- রচনাকাল ও স্থান: গানটির রচনাকাল সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু
জানা যায় না। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের ৯ জুলাই(বৃহস্পতিবার, ২৪ আষাঢ়, ১৩৪৯) নজরুল কলকাতা বেতারকেন্দ্রে 'হারামণি' নামক
লুপ্তরাগ অনুসন্ধানী অনুষ্ঠান করার জন্য আসেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি গান করতে
গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সুস্থতার কিছু আগে নজরুল 'মদিনা' নামক একটি
নাটকের খসড়া তৈরি করেছিলেন। এই নাটকের জন্যই তিনি এই গানটি রচনা করেছিলেন।
এই সময় নজরুলের বয়স ছিল ৪৩ বৎসর ১ মাস।
- রেকর্ড:
এইচএমভি অক্টোবর ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দ (আশ্বিন-কার্তিক ১৩৫৪)। রেকর্ড নং
এন ২৭৭৪৮।
শিলপী ধীরেন্দ্র চন্দ্র মিত্র। রাগ- জিলফ্।
[শ্রবণ নমুনা]
- গ্রন্থ:
- নজরুল গীতি, অখণ্ড
- প্রথম সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৬ আশ্বিন ১৩৮৫। ২৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭৮]
- দ্বিতীয় সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ১ শ্রাবণ ১৩৮৮। ১৭ জুলাই ১৯৮১]
- তৃতীয় সংস্করণ [ব্রহ্মমোহন ঠাকুর সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। ৮ মাঘ ১৪১০। ২৩ জানুয়ারি ২০০৪। রাগ-প্রধান গান। ৯২২ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ২৩১]
- পরিবর্ধিত সংস্করণ [আব্দুল আজীজ আল-আমান সম্পাদিত। হরফ প্রকাশনী। বৈশাখ শ্রাবণ ১৪১৩। এপ্রিল-মে ২০০৬] ৮৯৩ সংখ্যাক গান। পৃষ্ঠা: ১৬৪।
- নজরুল-সংগীত সংগ্রহ [রশিদুন্ নবী সম্পাদিত। কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। তৃতীয় সংস্করণ দ্বিতীয় মুদ্রণ, আষাঢ় ১৪২৫। জুন ২০১৮।] গান ৯।
রাগ: জিলফ, তাল: ত্রিতাল। পৃষ্ঠা ৩]
-
নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড) স্বরলিপিকার :
সুধীন দাশ। প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর ১৯৯৫] ৯ সংখ্যক গান। পৃষ্ঠা ৫৯-৬২]
- মদিনা।
নজরুল রচনাবলী জন্মশতবর্ষ সংস্করণ অষ্টম খণ্ডে [১২ই ভাদ্র ১৪১৫, ২৭শে
আগষ্ট ২০০৮] ৬।
আমার 'মদিনা' নাটকের জন্য আধুনিক গান (আমি গাইব)। জিলফ-তেতালা।।
পৃষ্ঠা: ৩০৩। পাদটীকায় উল্লেখ আছে- 'শচীন দেব বর্মণ 'গাইবে' কেটে দিয়ে 'আমি'
গাইব লিখেছেন। এছাড়া বেশ কিছু পাঠান্তর দেখানো হয়েছে ৭ থেকে ৮ সংখ্যক
পাদটীকায়।
- পত্রিকা। 'আমার মদিনা'।'নজরুল ইন্সটিটিউট পত্রিকা' জ্যৈষ্ঠ ১৩৯২ সংখ্যা।
ষষ্ঠ গান/আমি গাইব (শচীন দেব বর্মণ
গাইবে লিখে কেটে দিয়ে)
- স্বরলিপিকার ও স্বরলিপি:
সুধীন দাশ।
নজরুল সঙ্গীত স্বরলিপি (প্রথম খণ্ড)।
প্রথম প্রকাশ, তৃতীয় মুদ্রণ [কবি নজরুল ইন্সটিটিউট। অগ্রহায়ণ ১৪০২। নভেম্বর
১৯৯৫। নবম গান] [নমুনা]
- স্বরলিপিকার:
সুধীন দাশ
- পর্যায়:
- বিষয়াঙ্গ:
প্রকৃতি (ঋতু, শরৎ)
- সুরাঙ্গ: রাগাশ্রয়ী
- রাগ:
জিলফ
- তাল:
ত্রিতাল
- গ্রহস্বর: ন্র্সা