১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের আগষ্ট মাসের দিকে নজরুল বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদকের কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছিলেন। এই পত্রের সাথে তিনি একটি 'গাথা' ও একটি গল্প পাঠিয়েছিলেন। সম্ভবত এই সময়ে তিনি সওগাত পত্রিকাতে পাঠিয়েছিলেন ' স্বামীহারা' নামক একটি গল্প। এই গল্পটি সওগাত পত্রিকার ভাদ্র ১৩২৬ (আগষ্ট-সেপ্টেম্বর ১৯১৯) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তা 'রিক্তের বেদন' গল্পগ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত হয়ে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছিল।
 

স্বামীহারা

[ ক ]

ওঃ! কী বুক-ফাটা পিয়াস! সলিমা! একটু পানি খাওয়াতে পারিস বোন? আমার কেন এমন হল, আর কী করেই এ কপাল পুড়ল, তাই জিজ্ঞেস করছিস – না? তা আমার সে ‘দেরেগ’ -মাখা ‘রোনা’ শুনে আর কী হবে বহিন। দোওয়া করি, তুই চির-এয়োতি হ! এসব পোড়াকপালির কথা শুনলেও যে তোদের অমঙ্গল হবে ভাই! খোদা যেন মেয়েদের বিধবা করবার আগে মরণ দেন, তা না হলে তাদের বে হওয়ার আগেই যেন তারা ‘গোরে’ যায়। তোর যদি মেয়ে হয় সলিমা, তাহলে তখনই আঁতুড় ঘরেই নুন খাইয়ে মেরে দিস, বুঝলি? নইলে চিরটা কাল আগুনের খাপরা বুকে নিয়ে কাল কাটাতে হবে।

তুই তো আজ দশ বছর এ গাঁ ছাড়া, তাই সব কথা জানিস না। সেই ছোট্টটি গিয়েছিলি, আজ একেবারে খোকা কোলে করে বাপের বাড়ি এসেছিস! ... আমি পাগল হয়ে গেছি ভেবে সবাই দূর হতে দেখেই পালায়। আচ্ছা তুইতো জানিস ভাই আমায়, আর এখনও তো দেখছিস, সত্যি বলতো আমি পাগল হয়েছি? হাঁ ঠিক বলেছিস, আমি পাগল হইনি, – নয়?

সেবার – ঠিক মনে পড়ে না কতকাল আগে – বিধাতার অভিশাপ যেন কলেরা আর বসন্তের রূপ ধরে আমাদের ছোট্ট শান্ত গ্রামটির উপরে এসে পড়েছিল, আর ওই অভিশাপে পড়ে কত মা, কত ভাই-বোন, কত ছেলেমেয়ে যে গাঁয়ের ভরাবক্ষে শুধু একটা খাঁ খাঁ মহাশূন্যতা রেখে কোন্ সে অচিন মুল্লুকে উধাও হয়ে গেল তা মনে পড়লে – মাগো মা – জানটা যেন সাতপাক খেয়ে মোচড় দিয়ে ওঠে। কত সে ঘর-কে ঘর উজাড় হয়ে তাতে তালাচাবি পড়ল – আর গ্রামে যেমন এক একটি করে ভিটে নাশ হতে লাগল, তেমনই এই গোরস্থানে গোরের সংখ্যা এত বেশি বেড়ে উঠল যে, আর তার দিকে তাকানই যেত না।

আচ্ছা ভাই, এই যে দিঘির গোরস্থান, আর এই যে হাজার হাজার কবর, এগুলো কী তবে আমাদেরই গাঁয়ের একটা নীরব মর্মন্তুদ বেদনা – অন্তঃসলিলা ফল্গুনিঃস্রাব – জমাট বেঁধে অমন গোর হয়ে মাটি ফুঁড়ে বেরিয়েছে? না কী আমাদের মাটির মা তাঁর এই পাড়াগেঁয়ে চির-দরিদ্র জরাব্যাধিপ্রপীড়িত ছেলেমেয়েগুলোর দুঃখে ব্যথিত হয়ে করুণ প্রগাঢ় স্নেহে বিরামদায়িনী জননীর মতো মাটির আঁচলে ঢেকে বুকের ভিতর লুকিয়ে রেখেছেন? তাঁর এই মাটির রাজ্যে তো দুঃখ-ক্লেশ বা কারুর অত্যাচার আসতে পারে না। এখানে শুধু একটা বিরাট অনন্ত সুপ্ত শান্তি – কর্মক্লান্ত মানবের নিঃসাড় নিস্পন্দ সুষুপ্তি। এ একটা ঘুমের দেশ, নিঝুমের রাজ্যি। আহা, আজ সে কত যুগের কত লোকই যে এই গোরস্থানে ঘুমিয়ে আছে তা এখন গাঁয়ের কেউ বলতে পারবে না। আমি কতজনকেই বা মরতে দেখলুম? এরা যখন মরেছিল, আমি তখন হয়তো এমনই একটা অ-দেখার ‘কোকাফ মুল্লুকে ঘুরতে ছিলুম, তারপর যখন আমায় কে এই দুনিয়ায় এনে ফেলে দিলে – আর দুনিয়ার এই আলোকের জ্বালাময় স্পর্শে আমার চক্ষু ঝলসে গেল, তখন আমি নিশ্চয় অব্যক্ত অপরিচিত ভাষায় কেঁদে উঠেছিলুম, ‘ওগো, এ মাটির – পাথরের দুনিয়ায় কেন আমায় আনলে? কেন, ওগো কেন?’ – তারপর মায়ের কোলে শুয়ে যখন তাঁর দুধ খেলুম, তখন প্রাণে কেমন একটা গভীর সান্ত্বনা নেমে এল। আমি আমার সমস্ত অতীত এক পলকে ভুলে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়লুম।

ওই যে বাঁধানো কবরগুলো, ওগুলো অনেক কালের পুরোনো। তখন ছিল বাদশাহি আমল, আর আমাদের এই ছোট্ট গ্রামটাই ছিল, ‘ওলিনগর’ বলে একটা মাঝারি গোছের শহর। ওই যে সামনে ‘রাজার গড়’ আর ‘রানির গড়’ বলে দুটো ছোট্ট পাহাড় দেখতে পাচ্ছ, ওতেই থাকতেন তখনকার রাজা রানি – রাজকুমার আর রাজকুমারীরা। লোকে বলে, তাঁরা শুতেন হিরার পালঙ্কে, আর খেতেন ‘লাল জওয়াহের’ আর, কবরস্থানের পশ্চিম দিকে ওই যে পির সাহেবের ‘দরগা’ ওরই ‘বর্দোয়ায়’ নাকি এমন সোনার শহর পুড়ে ঝাও হয়ে যায়। সেই সঙ্গে রাজার ঘরগুষ্টি সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, আজ তাঁর বংশে বাতি দিতে কেউ নেই! পশ্চিমে-হাওয়ায় তাঁদের সেই ছাই-হওয়া দেহ উড়ে উড়ে হয়তো এই গোরস্থানের উপরই এসে পড়েছে। আচ্ছা ভাই, খোদার কী আশ্চর্য মহিমা! রাজা – যার অত ধন, মালমাত্তা, অত প্রতাপ, সেও মরে মাটি হয়! আর যে ভিখারি খেতে না পেয়ে তালপাতার কুঁড়েতে কুঁকড়ে মরে পড়ে থাকে, সেও মরে মাটি হয়। কী সুন্দর জায়গা এ তবে বোন!

তুই ঠিক বলেছিস ভাই সলিমা, কেঁদে কী হবে, আর ভেবেই বা কী হবে! যা হবার নয় তা হবে না, যা পাওয়ার নয় তা পাব না। তবু পোড়া মন তো মানতে চায় না। এই যে একা কবরস্থানে এসে কত রাত্তির ধরে শুধু কেঁদেছি, কিন্তু এত কান্না এত ব্যাকুল আহ্বানেও তো কই তাঁর একটুকু সাড়া পাওয়া গেল না। তিনি কী এতই ঘুমুচ্ছেন? কী গভীর মহানিদ্রা সে? আমার এত বুকফাটা কান্নার এত আকাশচেরা চিৎকারের এতটুকু কী তাঁর কানে গেল না? সেই কোন্ মায়াবীর মায়াযষ্টিস্পর্শে মোহনিদ্রায় বিভোর তিনি? আমিও কেন অমনি জড়ের মতো নিঃসাড় নিস্পন্দ হয়ে পড়ি না? আমারও প্রাণে কেন মৃত্যুর ওই রকম শান্ত-শীতল ছোঁয়া লাগে না? আমিও কেন দুপুর রাতের গোরস্থানের মতোই নিথর নিঝুম হয়ে পড়ি না? তাহলে তো এ প্রাণপোড়ানো অতীতটা জগদ্দল শিলার মতো এসে বুকটা চেপে ধরে না! সেই সে কোন্-ভুলে-যাওয়া দিনের কুলিশ-কঠোর স্মৃতিটা তপ্ত শলাকার মতো এসে এই ক্ষত বক্ষটায় ছ্যাঁকা দেয় না! ‘জোবেহ্’ করা জানোয়ারের মতো আর কতদিন নিদারুণ জ্বালায় ছটফট করে মরব? কেন মৃত্যুর মাধুরী মায়ের আশিসধারার মতো আমার উপর নেমে আসে না? এ হতভাগিনিকে জ্বালিয়ে কার মঙ্গল সাধন করছেন মঙ্গলময়? তাই ভাবি – আর ভাবি – কোনো কূলকিনারা পাই না, এর যেন আগাও নেই, গোড়াও নেই। কী ছিল – কী হল – এ শুধু একটা বিরাট গোলমাল!

সেদিন সকালে ওই পাশের চারাধানের খেতের আলের উপর দিয়ে কাঁচা আম খেতে খেতে একটি রাখাল বালক কোথা হতে শেখা একটা করুণ গান গেয়ে যাচ্ছিল। গানটা আমার মনে নেই, তবে তার ভাবার্থটা এই রকম, ‘কত নিশিদিন সকাল সন্ধ্যা বয়ে গেল, কত বারোমাস কত যুগ-যুগান্তরের অতীতে ঢলে পড়ল, কত নদনদী সাগরে গিয়ে মিশল, আবার কত সাগর শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে গেল, কত নদী পথ ভুলে গেল, আর সে কত গিরিই না গলে গেল, তবু ওগো বাঞ্ছিত, তুমি তো এলে না!’ গানটা শুনছিলুম আর ভাবছিলুম, কী করে আমার প্রাণের ব্যাকুল কান্না এমন করে ভাষায় মূর্ত হয়ে আত্মপ্রকাশ করছিল? ওগো, ঠিক এই রকমই যে একটা মস্ত অসীম কাল আমার আঁখির পলকে পলকে যেন কোথা দিয়ে কোথায় চলেছে, আর আমি কাকে পাওয়ার – কী পাওয়ার জন্যে শুধু আকুলি-বিকুলি মিনতি করে ডাকছি, কিন্তু কই তিনি তো এলেন না – একটু সাড়াও দিলেন না। তবে দুপুর রোদ্দুরে ঘুনঘুনে মাছির মুখে ওই যে খুব মিহি করুণ ‘গুন গুন’ সুর শুনি এই গোরস্থানে, ও কি তাঁরই কান্না? দিনরাত ধরে সমস্ত গোরস্থান ব্যেপে প্রবল বায়ুর ওই যে একটানা হু হু শব্দ, ও কি তাঁরই দীর্ঘশ্বাস? রাত্তিরে শিরীষ ফুলের পরাগমাখা ওই যে ভেসে আসে ভারী গন্ধ, ও কি তাঁরই বর-অঙ্গের সুবাস? গোরস্থানের সমস্ত শিরীষ, শেফালি আর হেনার গাছগুলো ভিজিয়ে, সবুজ দুর্বা আর নীল ভুঁই-কদমের গাছগুলোকে আর্দ্র করে ওই যে সন্ধে হতে সকাল পর্যন্ত শিশির ক্ষরে, ও কি তাঁরই গলিত বেদনা? বিজুলির চমকে ওই যে তীব্র আলোকচ্ছটা চোখ ঝলসিয়ে দেয়, ও কি তাঁরই বিচ্ছেদ-উন্মাদ হাসি? সৌদামিনী-স্ফুরণের একটু পরেই ওই যে মেঘের গম্ভীর গুরু গুরু ডাক শুনতে পাই, ও কি তাঁর পাষাণ বক্ষের স্পন্দন? প্রবল ঝঞ্ঝার মতো এসে সময় সময় ওই যে দমকা বাতাস আমাকে ঘিরে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকে, ও কি তাঁরই অশরীরী ব্যাকুল আলিঙ্গন? গোরস্থানের পাশ দিয়ে ওই যে ‘কুনুর’ নদী বয়ে যাচ্ছে, আর তার চরের উপর প্রস্ফুটিত শুভ্র কাশফুলের বনে বনে দোল-দোলা দিয়ে ঘন বাতাস শন শন করে ডেকে যাচ্ছে, ও কি তাঁরই কম্পিত কণ্ঠের আহ্বান? আমি কেন ওঁরই মতো অমনই অসীম, অমনই বিরাট-ব্যাপ্ত হয়ে ওঁকে পাই না? আমি কেন অমনই সবারই মাঝে থেকে ওই অ-পাওয়াকে অন্তরে অন্তরে অনুভব করি না? এ সীমার মাঝে অসীমের সুর বেজে উঠবে সে আর কখন? এখন যে দিন শেষ হয়ে এল, ওই শুন নদীপারের বিদায়-গীত শুনা যাচ্ছে খেয়াপারের ক্লান্ত মাঝির মুখে –

দিবস যদি সাঙ্গ হল, না যদি গাহে পাখি,

ক্লান্ত বায়ু না যদি আর চলে, –

এবার তবে গভীর করে ফেলোগো মোরে ঢাকি

অতি নিবিড় ঘন তিমির তলে!

[ খ ]

এই যে গোরস্থান, যেখানে আমার জীবনসর্বস্ব দেবতা শুয়ে রয়েছেন, শৈশব হতে এই জায়গাটাই ছিল আমার সবচেয়ে প্রিয় স্থান। ওই যে অদূরে ছোটো ছোটো তিনটি কবর দেখতে পাচ্ছ প্রায়ই মাটির সঙ্গে মিশে সমান হয়ে গেছে, আর উপরটা কচি দূর্বা ঘাসে ছেয়ে ফেলেছে, ওগুলি আমার ছোটো ভাই বোনদের কবর! ওরা খুব ছোটোতেই মারা গিয়েছিল – আমের কচি বৌল ফাগুনের নিষ্ঠুর করকাস্পর্শে ঝরে পড়েছিল। ওই যে ওদের শিয়রে বকম ফুলের গাছগুলি দেখতে পাচ্ছ, ওগুলি আমিই লাগিয়েছিলুম আমি তখন খুবই ছোটো। এখন অযতনে রোয়ানো ঝোপ আর আলগা লতায় ও জায়গাটা ভরে উঠেছে। আগে ওদের কবরের উপর ওদেরই মতো কোমল আর পবিত্র বকম ও শিরীষ ফুলের হলদে রেণু ঝরে পড়ত সারা বসন্ত আর শরৎকালটা ধরে, আর তার চেয়ে বেশি ঝরে পড়ত ওই তিনটি ক্ষুদ্র সঙ্গীদের বিচ্ছেদ-ব্যথিত অন্তর-দরিয়া মথিত করে আকুল অশ্রুর পাগল-ঝোরা! বাবা আমার মাকে ধরে ধরে নিদাঘের বিষাদ-গভীর সন্ধ্যায় এই সরু পথ বেয়ে নিয়ে যেতেন, আর আমাদের ‘টুনু’র, ‘তাহেবা’র আর ‘আবুলে’র ঘাসে চাপা ছোটো কবরগুলি দেখিয়ে বলতেন, ‘এইখানে তারা ঘুমিয়ে আছে, তারা আর উঠে আসতে পারে না। অনেক দিন বাদে আমরাও সব এসে ওদেরই পাশে শুব, – আমাদেরও অমনি মাটির ঘর তৈরি করে দেবে গাঁয়ের লোকে।’ সেই সময় সেই বেদনাপ্লুত বিয়োগ-বিধুর সন্ধ্যায় কী একটা আবছায়া-আবেশ করুণ সুরে যে আমার সারা বক্ষ ছেয়ে ফেলত, তা প্রকাশ করতে পারতুম না, তাই বাবার মুখের দিকে চেয়ে কী জানি কেন ডুকরে কেঁদে উঠতুম। বাবা অপ্রতিভ হয়ে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে তাঁর স্নিগ্ধ-কোমল স্পর্শে সান্ত্বনা দিতেন। সেই থেকে জায়গাটার উপর আমার এত মায়া জন্মে গেছিল যে, আমি রোজ মাকে লুকিয়ে এখানে পালিয়ে এসে আমার ভাই বোনদের ওই ছোট্ট তিনটি কবরের দিকে ব্যাকুল বেদনায় চেয়ে থাকতুম! – আচ্ছা ভাই, রক্তের টান কী এত বেশি? যেখানে আমার কচি ভাই-বোনগুলির ফুলের দেহ মাটির সঙ্গে মিশে মাটি হয়ে গেছে, সেই ভীষণ করুণ জায়গাটি দেখবার জন্যেও প্রাণে এমন ব্যাকুল আগ্রহ উপস্থিত হত কেন? শুনেছি যে-জায়গাটার মাটি নিয়ে খোদা আমাদের ‘পয়দা’ করেন, নাকি ঠিক সেই জায়গাতেই আমাদের কবর হয়, আর তাই আমরা স্বতঃই কেমন একটা নিবিড় টান অন্তরের অন্তরে অনুভব করি। এখন ‘তাহেরা’র কবরটি যেমন ধসে পড়েছে আর ওর মধ্যে একটি ধলা হাড় দেখা যাচ্ছে, হয়তো সে কত বছর বাদে আমারও কবর এরকম ধসে যাবে আর আমার বিশ্রী হাড়গুলো উলঙ্গ মূর্তিতে প্রকট হয়ে লোকের ভয়োৎপাদন করবে! – হায় রে মানুষের পরিণতি, তবু মানুষ এত অহংকার করে কেন আমি তাই ভাবি – আর ভাবি। আবার দু-এক সময় মনে হয়, সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে সে কোন্ অজানা দেশে চলে যেতে হবে! মনে হলে জানটা যেন গুরুবেদনায় টন টন করে ওঠে, পৃথিবীর প্রতি একী অন্ধ মূঢ় নাড়ির টান আমাদের? তার পরে বাবাও ‘আবুলে’র পাশে গিয়ে শয়ন করলেন, বড়ো ঝোপের পাশের ওই বড়ো কবরটা বাবার। বাবা মরে যাওয়ার পর আমি আরও বেশি করে কবরস্থানে যেতুম, স্তব্ধ হয়ে বসে রইতুম আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের মৌন সাদরের ভাষা শুনব বলে; একটা নিবিড় বেদনায় চোখের পাতা ভরে উঠত।

এই সব বেদনা, অপমান, দারিদ্র্যের নিষ্পেষণে মা আমার দিন দিন রুগ্‌ণ হয়ে পড়েছিলেন। উপর্যুপরি এত আঘাত তিনি আর সইতে পারছিলেন না। ক্রমে তাঁকে ভীষণ যক্ষ্মারোগে ধরল। আমি বুঝলুম আমার কপাল পুড়েছে, মাও আমায় ছেড়ে চলেছেন, তাঁর ডাক পড়েছে। আমি আমার, ভবিষ্যতের দিকে তাকাতেও সাহস করলুম না – উঃ সে কী সূচিভেদ্য অন্ধকার!

এমন সময় একদিন সন্ধ্যায় সই-মা আমাদের ঘরে এসে মার শীর্ণ হাতটি নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘সই, আমার ছেলে গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। সে তোদের দোওয়াতে এবার খুব সম্মানের সঙ্গে বি.এ পাশ করেছে। এবার ছেলের বিয়েটা দিয়ে বউটিকে সংসার বুঝিয়ে দিয়ে সংসার হতে সরে পড়ি। আর তা ছাড়া একা ঘর, বউ নেই, বেটি নেই, দিন রাত ঘরটা যেন পোড়াবাড়ির মতো খাঁ খাঁ করছে। খোদা তো দেননি আমায় যে, দু-দিন জামাই-বেটি নিয়ে সাধ-আহ্লাদ করব। ছেলে এতদিন জেদ ধরেছিল বি. এ. পাশ করে বিয়ে। তা খোদা তার ইচ্ছা পূর্ণ করে দিয়েছেন। এতদিন আমার ছেলে বে করলে দু-একটি খোকা খুকি হত না কী তার ঘরে? আর আমারও ঘরটা তা হলে অনেক মানাত, তা যখনকার তখন না হলে তোর আমার কথায় তো কিছু হয় না। আমার হাতের কাছে লক্ষ্মী শান্ত মা আমার – হিরের টুকরো বউ থাকতে আবার কোন্ গরীবের বেটিকে আনতে যাব ঘরে’, বলেই আমার মাথাটা সস্নেহে তাঁর বুকের মধ্যে টেনে নিলেন। মা আর আমি বোকার মতো শুধু অবাক বিস্ময়ে সইমার দিকে চেয়েছিলুম, একী পাগলের মতো তিনি বলে যাচ্ছিলেন। মার দুর্বল বক্ষ স্পন্দিত করে ঘন ঘন নিশ্বাস পড়তে লাগল। সইমা মায়ের বুকে খানিকটা মালিশ নিয়ে মালিশ করে দিতে দিতে তেমনই সহজভাবে বলে যেতে লাগলেন, ‘আমার ছেলের উপর বরাবরই বিশ্বাস আছে, সে কখনও যে আমার একটি কথা অমান্য করেনি। যেমন বললুম, ওরে আজিজ, তোর সইমা যে তোর শাশুড়ি হবে রে, বেগমকে আমার বউ করে ঘরে আনতে চাই, তোর বউ পছন্দ হবে তো আবার! আজকাল তো বাবা তোরা মা বাপের পছন্দে বে করিস না কিনা, তাই!’ – আমাকে আর বেশি বলতে হল না, সে খুব খুশি হয়েই বল্লে, ‘বেশ তো মা-জান, তোমার কথার তো আর কখনও অবাধ্য হইনি, আর তুমি যে আমায় কোনো জমিদার বাড়িতে বে না দিয়ে একটি অনাথা গরীবের মেয়েকে উদ্ধার করতে যাচ্ছ, এতে আমার এত আনন্দ হচ্ছে যে, দুনিয়ার লোককে জড়ো করে দেখাই আমার মায়ের মতো উঁচু মন আর কার আছে!’ আজিজ আমার জনম-পাগলা মা-নেওটা ছেলে কিনা, আর সে যে আবদার ধরেছে যখন, তখনই তাই পূর্ণ করেছি কিনা, তাই ওর চোখে আমার মতো মা নাকি আর বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে পাওয়া যায় না! সে যাক এখন বোন, আমি আজই বেগমকে দোওয়া করে যাব, কেন না হায়াত মাউত জানি না, কখন কী হয় বলা তো যায় না – তোর আবার এই রকম খাটে মাদুরে অবস্থা। আমি মনে করছি এই মাসের মধ্যেই ব্যাটার বউকে বরণ করে ঘরে তুলি, শুভকাজে বিলম্ব করা ভাল নয়, আর তাতে গ্রামের অনেকে অনর্থক কতকগুলো বাধা বিপত্তি করবে, সই, মা বেগম আমার শূন্যপুরী পূর্ণ করুক যেয়ে!’ সইমা আর কী বলেছিলেন ঠিক মনে নাই, কেননা আমার মাথা তখন বন বন করে ঘুরছিল, মস্তিষ্কের ভিতর কী একটা তীব্র উত্তেজনা ঘুরপাক খাচ্ছিল, – একটা হঠাৎ পাওয়া নিবিড়-বেদনাময় আনন্দের আঘাতে কে যেন আমার সমস্ত শরীর নেশা করে দিচ্ছিল।

[ গ ]

খুব ধুমধামে আমাদের বে হয়ে গেল। ধুমধাম মানে ‘আতস-বাজি’, ‘বাজনা’, ‘বাইনাচ’, ‘থিয়েটার’ প্রভৃতি যে-সকল অসাধু কলুষ আনন্দের কথা বুঝ তোমরা, তার কিছুই হয়নি। আর যদি ধুমধাম মানে নির্দোষ পবিত্র আনন্দের বিনিময় বুঝায়, তা হলে তার কোথায়ও এতটুকু ত্রুটি ছিল না। গ্রামের সমস্ত গরীব দুঃখীকে সাতদিন ধরে সুন্দররূপে ভালো ভালো খাবার খাওয়ানো হয়েছিল। অনেকের পুরোনো ঘর নূতন করে দেওয়া হয়েছিল। যাদের হালের গরু না থাকায় সমস্ত জমিজমা পতিত হয়েছিল, তাদিগকে গোরু কিনে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের তাঁতি দু ঘরকে দুটি তাঁতের কল কিনে দিয়ে তাদিগকে দেশি কাপড় বুনায় উৎসাহ দেওয়া হয়েছিল। কলকাতার এতিমখানায় পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছিল। সেসব আরও কত জায়গায় কত টাকা দিয়েছিলেন যে মা, তা আমার এখন সব মনে নেই!

সই মা আমায় বধূ করে যত খুশি হয়েছিলেন, তার চেয়ে অনেক বেশি দুঃখিত হয়েছিল গ্রামের লোকেরা, আর ওঁর আত্মীয় কুটুম্বেরা। ওঁদের অনেক আত্মীয় ছোটো ঘরে বে দেওয়ার জন্যে বে-র নিমন্ত্রণে একেবারেই আসেনি। এমনকি এই নিয়ে অনেকের সঙ্গে চিরদিনের জন্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছিল। অনেক হিতৈষী মিত্রও শত্রু হয়ে দাঁড়াল। তবে পয়সার খাতির সব জায়গাতেই, তাই অনেক চতুর মাতব্বর লোক এঁদের সঙ্গে মৌখিক সদ্ভাব রেখে ভিতরে ভিতরে অনিষ্ট করতে লাগল! সমাজে পতিত না হলেও বিশেষ কাজ বনাম স্বার্থ ছাড়া আর কেউ এ-বাড়ি আসত না। কিন্তু যেসব সহায়হীন গরিব বেচারারা জন্মাবধি এ বাড়ির সাহায্যে প্রতিপালিত হয়ে এসেছে, তারা সমাজের এ চোখ রাঙানি দেখে শুধু উপরে উপরে ভয় করে চলত। তারা জানত, সমাজ শুধু চোখ রাঙাতেই জানে। যে যত দুর্বল তার তত জোরে টুটি চেপে ধরতেই সমাজ ওস্তাদ। যেখানে উলটো সমাজকেই চোখ রাঙিয়ে চলবার মতো শক্তিসামর্থ্যওয়ালা লোক বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে সমাজ নিতান্ত শান্ত শিষ্টের মতোই তার সকল অনাচার আবদার বলে সয়ে নিয়ে থাকে। তাই উনি আর ওঁর মা বললেন, ‘আমাদের সমাজই নাই তো সমাজচ্যুত করবে কে?’ – সমাজ তবুও সুবোধ শিশুর মতো কোনো সাড়াই দিলে না, কিন্তু ওঁদের বাড়িতে যে সব গরিব বেচারারা আসত তাদিগকে খুব কড়াভাবেই শাসন করা হল,যেন কেউ ওঁদের বাড়ির ছায়াও না মাড়ায়।

লোকের এরূপ ব্যবহারে আদৌ দুঃখিত না হয়ে ওঁরা বরং হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। তা ছাড়া গ্রামের দরিদ্রের সেই আনন্দোদ্ভাসিত মুখে, অশ্রু ছলছল চোখে যে একটা মধুর স্নিগ্ধ হাসি ফুটে উঠেছিল, তারই জ্যোতি ওঁদের হৃদয় আলোয় আলোময় করে দিয়েছিল; উলটোদিকে পরশ্রীকাতর লোকদের চোখ মুখ ভয়ানকভাবে ঝলসে দিয়েছিল!

ওঃ, সে কী অমানুষিক শক্তি ছেয়ে ফেলেছিল মায়ের ওই ঝাঁঝরা বুক আমার বিদায়ের দিনে। মায়ের আনন্দের আকুল ধারা যেন কোথায় ধরছিল না সেদিন! হাজার কাজের ভিতর হাসির মাঝে অকারণে অশ্রু উথলে পড়ছিল তাঁর!

আমার জীবন কিন্তু সার্থকতায় সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল সেইদিন – যেদিন বুঝলুম আমার হৃদয়-দেবতাও তাঁর মাতৃদত্ত আশীর্বাদ সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করেছেন, আমার প্রাণের গোপন পূজা আরাধ্য দেবতার পায়ে বৃথা নিবেদিত হয় নাই!

আমার শুধু ইচ্ছা হত আমি তাঁর পায়ে মাথা কুটি আর বলি, ‘ওগো স্বামিন! ওগো দেবতা! এত আনন্দ দিয়ো না এ ক্ষুধিতাকে, প্রেমের এত আকাশ-ভাঙা ঘন বৃষ্টি ঢেলে দিয়ো না এ চিরমরুময় হৃদয়ে, – সকল মন দেহ প্রাণ ছেয়ে ফেলো না তোমার ও ব্যাকুল ভালোবাসার ব্যগ্র নিবিড় আলিঙ্গনে! আমার ছোট্ট বুক যে এত আনন্দ, এত ভালোবাসা সইতে পারবে না! – কিন্তু হায়, তাঁর ও ভুজবন্ধনে ধরা দিয়ে আমার আর কিছুই থাকত না, আমি আমার বর্তমান ভূত ভবিষ্যৎ ভুলে যেতুম! এ যেন স্বপ্নে পরিস্থানে গিয়ে প্রিয়তমের অধীর বক্ষে মাথা রেখে সুপ্ত বধির হয়ে যাওয়া, প্রাণের সকল স্পন্দন, দেহের সমস্ত রুধির অবাক স্তব্ধ হয়ে থেমে যাওয়া, শুধু তুমি আর আমি – অনুভব করা, সে-কোন্ অসীম সিন্ধুতে বিন্দুর মতো মিশে যাওয়া।

তাঁর ওই বিশ্বগ্রাসী ভালোবাসা যখন চোখের কালোয় জ্যোতির মতো হয়ে ফুটে উঠত, তখন শুধু ভাবতুম প্রেমে মানুষ কত উচ্চ হতে পারে! এর এতটুকু ছোঁয়ায় সে কী কোমলতার স্নিগ্ধপূত সুরধুনী বয়ে যায় সারা বিশ্বের অন্তরের অন্তর দিয়ে। দেবতা বলে কি কোনো কথা আছে? কক্ষণো না। মানুষই যখন এই রকম উচ্চ হতে পারে, অতল ভালোবাসায় নিজকে সম্পূর্ণরূপে তলিয়ে দিতে পারে, নিজের অস্তিত্ব বলে কোনো কিছু একটা মনে থাকে না – সে দেখে, সব সুন্দর আর আনন্দ, তখনই মানুষ দেবতা হয়। দেবতা বলে কোনো আলাদা জীব নাই।

যাক ও-সব কথা এখন – কী বলছিলুম? – হ্যাঁ, আমার বিয়ের মতো এত বড়ো একটা অস্বাভাবিক কাণ্ডে গ্রামময় মহা হুলুস্থুল পড়ে গেল। বংশে নিকৃষ্ট, সহায়সম্বলহীন আমাদের ঘরে সৈয়দ-বংশের বি.এ. পাশ করা সোনার চাঁদ ছেলের বিয়ে হওয়া ঠিক যেন রূপকথায় ঘুঁটে-কুড়োনির বেটির সাথে বাদশাজাদার বিয়ের মতোই ভয়ানক আশ্চর্য ঠেকছিল সকলের চোখে। গ্রামের মেয়েরা তো অবাক বিস্ময়ে আমার দিকে চেয়েছিল, – ‘বাপরে বাপ, মেয়েটার কী পাঁচপুয়া কপাল!’ তারা এও বলতে কসুর করেনি যে, আমি আবাগি নাকি রূপের ফাঁদ পেতে অমন নিষ্কলঙ্ক চাঁদকে বেমালুম কয়েদ করে ফেলেছিলুম? এত বলেও যখন তারা একটুও ক্লান্ত হল না, তখন সবাই একবাক্যে বলে বেড়াতে লাগল যে, বুনিয়াদি খান্দানে এমন একটা খটকা, এও কি কখনো সয়? এত বাড়াবাড়ি সইবে না, সইবে না। কখন আমাদের কপাল পুড়ে আর তাদের দশজনের ওই মহাবাক্যটা দৈব-বাণীর মতো ফলে যায়, তাই আলোচনা করে করে তাদের আর পেটের ভাত হজম হত না। আমার কিন্তু তখন কিছুই শুনবার আগ্রহ ছিল না – যে-দেবতা এমন করে তাঁর পরশমণির স্পর্শে আমার সকল ভুবন এমন সোনা করে দিয়েছিলেন, যাঁর মাঝে আমার সকল সত্তা, সব আকাঙ্ক্ষা চাওয়া-পাওয়া একাকার হয়ে মিশে গিয়েছিল, আমি সব ভুলে গিয়ে শুধু সেই দেবতাকেই নিত্য নূতন করে দেখছিলুম। তখন যে আমার ভাববার আর বলবার কিছুই ছিল না। তখন যে ‘সব পেয়েছি’র আসরে আনন্দময় হয়ে যাওয়ার মাহেন্দ্রক্ষণ! কিন্তু হায়, কালের অত্যাচারে সে মাহেন্দ্রক্ষণ আসবার আগেই এই সুন্দর বিশ্বের সে কী শক্ত দিকটা চোখে পড়ে গেল। প্রাণে বিরাট শান্তি নেমে আসবার আগেই সে কী গোলমাল হয়ে গেল সব। আগে হতেই আমার প্রাণের নিভৃততম দেশে সে কী এক আশঙ্কা যেন শিউরে শিউরে উঠত! মনে হত যেন এত সুখের পিছনে সে কী বজ্র ওত পেতে রয়েছে। কখন আমার এ আকাশ-কুসুম ভেঙে যাবে! – মনে হত এ ক্ষণিকের পাওয়া যেন একটি রজনীর স্বপ্নে পাওয়া ছোট্ট এক টুকরো আনন্দ, স্বপ্ন ভেঙে গেলেই তেমনি ঘুটঘুটে অন্ধকার!

মা আমায় সম্প্রদান করেই আবার শয্যা আশ্রয় করেছিলেন, তাঁর যে তখন আর চাইবার বা করবার কিছুই ছিল না, তখন যে মা মুক্ত। তাই তিনিও আমায় সইমার হাতে দিয়ে যে দেশের কেউ খবর দিতে পারে না সেই কোন্ অজানার দেশে চলে গেলেন। বোধ হয় সেখানে আমার বাবা খোকাখুকিদের নিয়ে অশ্রুসজল নয়নে পথের দিকে চেয়েছিলেন। যাওয়ার সময় সে কী তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠেছিল মার পাণ্ডুর ওষ্ঠপুটে! আমি যখন মার বুকে আছাড় খেয়ে কেঁদে উঠলুম, ‘মা গো যেয়ো না – আমার যে আর দুনিয়ায় কেউ নেই মা’, তখন মা আমার মুখে হাত দিয়ে বলেছিলেন, ‘বলিসনে বলিসনে রে অমন কথা বেগম, তোর অভাব কীসের? এমন মায়ের চেয়েও স্নেহময়ী শাশুড়ি, দেবতার চেয়েও উচ্চ স্বামী, এত পেয়েও রাক্ষুসি বলছিস কিছু নেই তোর? ছি মা, বলিসনে অমন অপয়া কথা।’

মাকে বাবার পাশেই গোর দেওয়া হল। আজ তাহেরার আর আবুলের কবর যেমন ধুলার সঙ্গে মিশে গিয়েছে, দু-দিন বাদে মারও কবর অমনই সমান হয়ে মিশে যাবে, কিন্তু আমার বুকে পুঞ্জীভূত বেদনার এই যে একটা শক্ত গেরো বেঁধে গেল, সে কি মিশবে কখনও?

এর পর হতে এই উপর্যুপরি চোখের আঘাতে আমায় মারাত্মক মূর্ছারোগে ধরলে! প্রায়ই আমি অচেতন হয়ে পড়তুম, আর যখনই চেতন হত তখনই দেখতুম আমার ধূলিধূসরিত শির রয়েছে তাঁর – আমার স্বামীর ঘনস্পন্দিত বিশাল বক্ষে – তাঁর সব-ভুলানো ব্যাকুল বাহু-বন্ধনের মাঝে! ওঃ, সে কী ভীত করুণাঘন দৃষ্টি তাঁর চোখে ফুটে উঠত! সহানুভূতির সে কী কোমল স্নিগ্ধছায়া ছেয়ে ফেলত তাঁর স্বভাবসুন্দর মুখখানি। – আমার তখন মনে হত এর চেয়ে মেয়েদের কী আর সুখ থাকতে পারে? এর চেয়ে আকাঙ্ক্ষিত ঈপ্সিত কী সে অপার্থিব জিনিস চাইতে পারে আমাদের মন্দভাগিনী স্ত্রী জাতিরা? হায়, সে সময়ে স্বামীর কোলে অমনি করে মাথা রেখে কেন আমার শেষ নিশ্বাসটুকু বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়নি?

ঘ ]

এখন বলছি বোন তোকে আমার কাহিনিটা, এও যে একটা ‘কেসসা’। কে আমার এ কথা বিশ্বাস করবে আর কেই বা শুনবে? তার উপর নাকি আমার মগজ বিগড়ে গিয়েছে, আর তাই মাঝে মাঝে আমি খুব শক্ত ‘বক্তিমা’ ঝেড়ে আমার বিদ্যা জাহির করি। আমার এই বকর বকর করাটা কেউ পছন্দ করে না, তাই একটু শুনেই বিরক্ত হয়ে চলে যায়। আচ্ছা বোন, বল তো, মেয়েমানুষ আবার কবে কথা গুছিয়ে বলতে পেরেছে, আর খুব বেশি বলাই মেয়েদের স্বভাব কি না। আমি কম কথায় কী করে আমার সকল কথা জানাব? তাই হয়তো বলবি, কে তোকে মাথার দিব্যি দিয়েছে তোর কথা বলবার জন্যে? তাও বটে, তবে পেটের কথা, বুকের ব্যথা লোককে না জানালেও যে জানটা কেমন শুধু আনচান করে, বুকটা ভারী হয়ে ওঠে, এও তো একটা মস্ত জইর ‘গজব’ ।

*  *  *

সইমা এত বড়ো রাশভারি লোক ছিলেন যে সবাই তাঁকে ভয় করে চলত। তিনিই ছিলেন ঘরের মালিক। কেউ তাঁর কথায় ‘টু’টি করতে পারত না। তাই এত বড়ো একটা অঘটন, – আমার মতো পাতাকুড়ুনির বেটিকে রাজবধূ করা সত্ত্বেও মুখ ফুটে কেউ আর কিছু বলতে পারল না তেমন। মেয়েরা প্রকারান্তরে আমার নিচু ঘরের কথা জানতে এলে তিনি জোর গলায় বলতেন, ‘জাত নিয়ে কি ধুয়ে খাই? আর জাত লোকের গায়ে লেখা থাকে? যার চলাচলন শরিফের মতো সেই তো আশরাফ । খোদা কিয়ামতের দিনে কখ্‌খনো এমন বলবেন না যে, তুমি সৈয়দ সাহেব, তোমার আবার পাপ পুণ্যি কী, তোমার নিঘ্‌ঘাত বেহেশত আর তুমি ‘হালগজ্জ’ শেখ, অতএব তোমার সব ‘সওয়াব’ (পুণ্য) বাজেয়াপ্ত হয়ে গেছে, কাজেই তোমার কপালে তো জাহান্নাম ধরাবাঁধা! আমি চাই শুধু গুণ, তা সে যে জাতই হোক না কেন? দেখুক তো এসে আমার বউকে – ঘর আলো করা রূপ, আশরাফের চেয়েও আদব তমিজ লেখাপড়া জানা, কাজকর্মে পাকা এমন লক্ষ্মী বউ আর কার আছে! আর কী জন্যেই বা বড়ো ঘরের বেটিকে ঘরে আনব, সে যত না আনবে রূপ-গুণ, তার চেয়ে বেশি আনবে বাপমায়ের গরব আর অশান্তি। আমার এই সোনার চাঁদ ছেলে বেঁচে থাক, ওর ঘরে ছেলেপিলে দেখি, তা হলেই আমি হাসতে হাসতে মরব।’ মায়ের সেই স্নেহভিজা কথায় যে কতই আনন্দে বুক ভরে উঠত। আমার চোখ দিয়ে টস টস করে জল পড়ত। কৃতজ্ঞতা আর ভক্তির ভাষা বুঝি মর্মের অশ্রু।

স্বামীর সত্যিকারের ভালোবাসা আর সইমার মেয়ের চেয়েও নিবিড় স্নেহ আমার তো আর কিছুই অপূর্ণ রাখেনি। দুনিয়ায় যখন যা দেখতুম তাই সব যেন সুন্দর হয়ে ফুটে! কই, ওর আগে তো এই মাটির দুনিয়াকে এত সুন্দর করে দেখিনি। ভালোবাসার অঞ্জন কী মহিমা জানে, যাতে সব অত সুন্দর হয়ে ফুটে ওঠে!

‘এত সুখ, তবুও পোড়া মন কেন আপনা আপনিই সঙ্কুচিত হয়ে পড়ত! পাড়াপড়শি লোকের ওই একটা কথাই যেন শাখচিল্লির মতো কানের কাছে এসে বাজত, ‘সইবে না, সইবে না, সইবে না!’ চোরের মন বোঁচকার দিকে, তাই আমার মতো হতভাগির মনে যে শুধুই অমঙ্গলের বাঁশি বাজবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! – ওই অত গভীর ভালোবাসার আঘাতই যে আমাকে বিব্রত করে তুলেছিল! মধু খুবই মিষ্টি, কিন্তু বেশি খাওয়ালেই গা জ্বালা করে। তাই আমার মনে হত ওঁদের পায়ে মাথা কুটে বলি, ‘ওগো দেবতা, ওগো স্বর্গের দেবী, তোমরা এত স্নেহ এত ভালোবাসা দিয়ে ছেয়ে ফেলো না আমায়, আমি যে আর সইতে পারছি না। স্নেহের ঘায়ে যে আমার হৃদয় ভেঙে পড়ল! একটু ঘৃণা করো, খারাপ বলো, আমায় খুব ব্যথা দাও, তা নইলে আমার বক্ষ নুয়ে যাবে যে।’ আর অমনি আবার সেই ভীষণ মূর্তি চোখের সামনে ভেসে উঠত ‘সইবে না।’

এমনি করে, দেখতে দেখতে দুটো বছর কোথায় দিয়ে যে কোথায় চলে গেল, তা জানতে পারলুম না। এমন সময় ওই যে প্রথমে বলেছিলুম, কলেরা আর বসন্ত জোট করে রাক্ষসের মতো হাঁ করে আমাদের গ্রামটা গ্রাস করে ফেললে। তাদের উদর যেন আর কিছুতেই পুরতে চায় না। সে কী ভীষণ বুভুক্ষা নিয়ে এসেছিল তারা! সমস্ত গ্রামটা যেন গোরস্থানেরই মতো খাঁ খাঁ করতে লাগল। গ্রামের সকলে যে যেদিক পারলে মৃত্যুকে এড়িয়ে ছুটল। ভেড়ার দলে যখন নেকড়ে বাঘ প্রবেশ করে তখন সমস্ত ভেড়া একসঙ্গে জুটে চারিদিকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে চক্ষু বুজে, মাথা গুঁজে থাকে, মনে করে তাদের কেউ দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু মানুষ যারা, তারা তো আর মানুষকে এমন অবস্থায় ফেলে যেতে পারে না। তাদের একই রক্ত-মাংসের শরীর, তবে ভিতরে কোনো কিছু একটা বোধ হয় বড়ো জিনিস থাকে। সবারই সঙ্গে সমান দুঃখে দুঃখী, সবারই দুঃখ-ক্লেশের ভাগ নিজের ঘাড়ে খুব বেশি করে চাপানোতেই ওদের আনন্দ। ওই বুঝি তাদের মুক্তি।

যখন সবাই চলে গেল গ্রাম ছেড়ে, তখন গেলুম না কেবল আমরা; উনি বললেন, ‘মৃত্যু নাই, এরূপ দেশ কোথা যে গিয়ে লুকুব?’ সবাই যখন মহামারির ভয়ে রাস্তায় চলা পর্যন্ত বন্ধ করে দিলে তখন কোমর বেঁধে উনি পথে বেরিয়ে পড়লেন, বললেন, ‘এই তো আমার কাজ আমায় ডাক দিয়েছে।’ সে কী হাসিমুখে আর্তের সেবার ভার নিলেন তিনি। তখন তিনি এম. এ. পাশ করে আইন পড়ছিলেন। কলকাতায় খুব গরম পড়াতে দেশে এসেছিলেন। কী গরীয়সী শক্তির শ্রী ফুটে উঠেছিল তাঁর প্রতিভা-উজ্জ্বল মুখে সেদিন।

আবার সেই বাণী, ‘সইবে না, সইবে না!’

দিন নেই , রাত নেই, খাওয়া নেই, দাওয়া নেই, আর্তের চেয়েও অধীর হয়ে তিনি ছুটে বেড়াতে লাগলেন কলেরা আর বসন্ত রোগী নিয়ে। আমি পায়ে ধরে বললুম, ‘ওগো দেবতা! থামো, থামো, তুমি অনেকের হতে পার, কিন্তু আমার যে আর কেউ নেই। ওগো আমার অবলম্বন, থামো, থামো!’ হায়, যাঁকে চলায় পেয়েছে তাঁকে আর থামায় কে? বিশ্বের কল্যাণের জন্য ছুটছিল তাঁর প্রাণ। তাঁর সে দুনিয়াভরা বিছানো প্রাণে আমার এ ক্ষুদ্র প্রাণের কান্নার স্পন্দন ধ্বনিত হত কি? যদিও হত তবে সে শুধু ছুঁয়ে যেত, নুয়ে যেত না।

যে অমঙ্গলের একটু আভাস আমার অন্তরের নিভৃততম কোণে লুকিয়ে থেকে আমার সারা বক্ষ শঙ্কাকুল করে তুলেছিল, সেই ছোট্ট ছায়া যেন সেদিন কায়া হয়ে আমার চোখের সামনে বিকট মূর্তিতে এসে দাঁড়ালে। সে কী বিশ্রী চেহারা তার।

মা কখনও ওঁর কাজে বাধা দেননি। শুধু একদিন সাঁঝের নমাজ শেষে অশ্রু-ছলছল চোখে তাঁর শ্রেষ্ঠধন একমাত্র পুত্রকে খোদার ‘রাহায়’ উৎসর্গ করে গিয়েছিলেন। ওঃ, ত্যাগের মহিমায়, বিজয়ের ভাস্বর-জ্যোতিতে কী আলোময় হয়ে উঠেছিল তাঁর সেই অশ্রুস্নাত মুখ সেদিন। মনে হল যেন শত ধারায় খোদার আশিস অযুত পাগলাঝোরার বেগে মায়ের শিরে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমারও বক্ষ একটা মূঢ় বেদনা-মাখা গৌরবে যেন উথলে পড়েছিল।

এই রকম লোককেই দেবতা বলে, – না?

[ ঙ ]

সেদিন সকাল হতেই আমার ডান চোখটা নাচতে লাগল, বাড়ির পিছনে অশ্বত্থ গাছটায় একটা প্যাঁচা দিন দুপুরেই তিন তিন বার ডেকে উঠল, মাথার উপর একটা কালো টিকটিকি অনবরত টিক টিক করে আমার মনটাকে আরও অস্থির চঞ্চল করে তুলছিল। আমার অদৃষ্টের সঙ্গে ওদের কী সংযোগ ছিল?

উনি সেই যে ভোরে বেরিয়ে গিয়েছিলেন একটা লাশ কাঁধে করে নিয়ে, সারাদিন আর ফেরেননি। আমি কেবল ঘর আর বার করছিলুম।

বিকাল বেলায় খুব ঘনঘটা করে মেঘ এল, সঙ্গে সঙ্গে তুমুল ঝড় আর বৃষ্টি। সে যেন মস্ত দুটো শক্তির দ্বন্দ্বযুদ্ধ। ওঃ এত জল আর পাথরও ছিল সেদিনকার মেঘে। সামনে বিশ হাত দূরে বজ্র পড়ার মতো কী একটা মস্ত কঠোর আওয়াজ শুনে আমার মাথা ঘুরে গেল, আমি অচেতন হয়ে পড়ে গেলুম।

*  *  *

যখন চেতন হল, তখন বাড়িময় একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে, চারিদিকে হাহাকার, আর জল পড়ার ঝম ঝম! একটা মস্ত বড়ো বজ্র ঠিক আমার কপাল লক্ষ্য করে ছুটে আসছে।

আমার স্বামীদেবতা তখন বিছানায় শুয়ে ছটফট করছেন, আর মা পাষাণ-প্রতিমার মতো তাঁর দিকে শুধু চেয়ে রয়েছেন। চোখে এক ফোঁটা অশ্রু নেই, যেন হৃদয়ের সমস্ত অশ্রু জমাট বেঁধে গেছে। দৃষ্টিতে কী এক যেন অতীন্দ্রিয় ঔজ্জ্বল্য। সে কী বিরাট নির্ভয়তা।

শুনলুম সেদিন আমাদের পাশের গাঁয়ের দশবারো জন কলেরা রোগীকে গোর দিয়ে কয়েক জনকে ঔষধ পথ্য দিয়ে উনি বাড়ি ফিরছিলেন। পথে তাঁকে ওই রোগে আক্রমণ করলে। একটি পুরানো বটগাছের তলায় তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, একটু আগে উঠিয়ে আনা হয়েছে। – আবার বৃষ্টি এল, সমস্ত আকাশ ভেঙে ঝম ঝম ঝম। ...

তাঁকে ধরে রাখবার ক্ষমতা আর কারুর ছিল না – তাঁর কাজ শেষ হয়ে গেছিল, আর থাকবেন কেন? তিনি চলে গেলেন! যার যতটা ইচ্ছা গেল, কাঁদলে। আমাদের ঘরের আঙিনায় নিমগাছটার পাতা ঝরে পড়ল, ঝর ঝর ঝর! গোয়ালের গরু দড়ি ছিঁড়ে গোঙাতে গোঙাতে ছুটল। দ্বারে কাকাতুয়াটি শুধু একবার একটা বিকট চিৎকার করে অসাড় হয়ে নীচের দিকে মুখ করে ঝুলে পড়ল। চারিদিকে মুমূর্ষুর তীক্ষ্ম একটা আহা আহা শব্দ রহিয়ে রহিয়ে উঠতে লাগলে। সব ব্যেপে উঠতে লাগল শুধু একটা বীভৎস কান্নার রব। কান্নায় যেন সারা বিশ্বের বত্রিশ নাড়ি পাক দিয়ে অশ্রু ঝরছিল, ঝম ঝম ঝম।

শুধু তেমনি অচল অটল হয়ে একটা বিরাট পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়েছিলেন মা!

শুধু তাঁর শেষ সময় বলেছিলেন, ‘বাপ রে, আমাকে তো কাঁদতে নেই, তুই তো আর আমার নস, তোকে খোদার কাছে কোরবানি দিয়েছি! খোদার নামে উৎসর্গীকৃত জিনিসে তো আমার অধিকার নেই! – তবে চল বাপ, তুই তো আমায় ছেড়ে এক মুহূর্তও থাকতে পারিসনে, আমিও তোকে কখনও চোখের আড়াল করিনি। তোর কাজ ফুরিয়েছে, আমারও কাজ ফুরাল আজ।’

কতকগুলো লোকের মগজ নাকি এমনই খারাপ হয়ে যায় যে, তারা এক একটা ছোট্ট মুহূর্তকেই একটা অখণ্ড কাল বলে ভাবে। তবে কী আমারও মাথা সেই রকম খারাপ হয়ে গেছে, তা না হলে আমার বোধ হচ্ছে কেন যে, এসব ঘটনা যেন বাবা আদমের কালে ঘটে গেছে, আর আমি এমনি করে গোরস্থানে বসেই আছি। তুই কিন্তু বলছিস, এই সেদিন তাঁরা মারা গেছেন। তবে তো আমি সত্যিই পাগল হয়ে গেছি।

কী বলছিস, এ গোরস্থানে এলুম কেন? – আহা, কথার ছিরি দেখ! এই গোরস্থানে যেখানে সব সত্যিকারের মানুষ শুয়ে রয়েছেন, সেখানে না এসে, যাব কী তবে বনে-জঙ্গলে যেখানে এক রকম জন্তু আছে, যাদের শুধু মানুষের মতো হাত পা আর অন্তরটা শয়তানের চেয়েও কুৎসিত কালো? – আমার বেশ মনে পড়ে, যখন তাঁর লাশ কাঁধে করে বাইরে আনা হল, তখন ওদের কে একজন আত্মীয় আমার চুল ধরে বললে, ‘যা শয়তানি, বেরো ঘর থেকে এখনি। তখনই বলেছিলুম, বুনিয়াদি খানদানের উপর নাল চড়ান, এ সইবে কেন? তোকে ঘরে এনে শেষে বংশে বাতি দিতে পর্যন্ত রইল না কেউ; বেরো রাক্ষুসি, আর গাঁয়ের লোকের সামনে মুখ দেখাস না। আর ইচ্ছা হয় চল, তোর আর একটা নেকা দিয়ে দি?’ – অত মার গাল কিছুই বাজে নাই আমার প্রাণে, যত বেজেছিল ওই একটা নেকার কথায়। ওই বিশ্রী কথাটা একটা মস্ত আঘাতের মতো বেজেছিল আমার চূর্ণ বক্ষে। – ওগো নেকা কী? সে কী দুবার অন্যের গলায় মালা দেওয়া? শাস্ত্রে নেকার কথা আছে, সে কাদের জন্যে? আচ্ছা ভাই, যারা বাধ্য হয়ে অন্নবস্ত্রাভাবে বা আকাঙ্ক্ষার বশবর্তী হয়ে ও রকম করে ভালোবাসার অপমান করে, তাদের কী হৃদয় বলে কোনো একটা জিনিস নাই? তা হলেও তাদিগকে ক্ষমা করা যেতে পারে, কিন্তু যারা শুধু কামনার বশবর্তী হয়ে পবিত্রতাকে, নারীত্বকে ওরকম মাড়িয়ে চলে যায়, তাদের কোথাও ক্ষমা নাই। ভালোবাসা – স্বর্গের এমন পবিত্র ফুলকে কামনার শ্বাসে যে কলঙ্কিত করে, তার উপযুক্ত বোধ হয় এখনও কোনো নরকের সৃষ্টি হয় নাই।

‘মউলবি সাহেবরা হয়তো খুব চটে আমার ‘জানাজার নামাজ’ই পড়বেন না, কিন্তু মানুষ আর মউলবিতে অনেক তফাত – শাস্ত্র আর হৃদয়, অনেকটা তফাত।

[ চ ]

যেখানে শুধু এই রকম অবমাননা, সেখান থেকে সরে এসে মরার দেশে থাকাই ভালো।

*  *  *

ওকি, তুমি এমন করে আঁতকে উঠলে কেন? আমি মূর্ছা গেছলুম বলে? – কী বলচ, আমি বিষ খেয়েছি? – তা হলে তুমিও পাগল হয়েছ! আমার চেহারা এমন নীল হয়ে গেছে দেখে তুমি হয়তো মনে করেছ, আমি বিষ খেয়েছি। না গো না, আমি পাগল হই আর যা-ই হই ওরকম দুর্বলতা আমার মধ্যে নেই। কেরোসিনে পোড়া, জলে ডোবা, গলায় দড়ি দেওয়া, বিষ খাওয়া মেয়েদের জাতটার যেন রোগের মধ্যে দাঁড়িয়েছে। আমার কপাল পুড়লেও আমি ওরকম ‘হারামি মওতকে’ প্রাণ থেকে ঘৃণা করি। এ মরায় যে এ-দুনিয়া ও আখের উভয়ের খারাবি, বোন।

কাল রাত্রে ভয় পেয়ে যখন তুই আমার কাছ হতে চলে গেলি, তার একটু পর থেকেই আমার ভেদবমি আরম্ভ হয়েছে। এই একটু আগে আমার জ্ঞান হল।

আমি বুঝতে পেরেছি বোন, আমার আর সময় নাই। আর কারুর চোখের জলের বাধা আমায় বেঁধে রাখতে পারবে না। ওঃ এত দিনে ওই নদীর পারের অলস-ঘুমে ভরা সুরটা আমার প্রাণে গভীর স্পর্শ করে গেল। সে কত গভীর দুঃখ ভরা। পানি আমার চোখের কোল ছেয়ে ফেলেছে দিদি। তার কোমল স্পর্শ আমার চোখের পাতায় পাতায় অনুভব করছি। কী শিহরন আমার প্রতি লোমকূপে খেলে বেড়াচ্ছে।

কী পিপাসা, কী বুক-ফাটা তৃষ্ণা। একটু পানি দে তো বোন! – না না, আর চাই না। ওই দেখতে পাচ্ছি ‘শারাবান তহুরা’ -ভরা পেয়ালা হাতে আমার স্বামী হৃদয়-সর্বস্ব দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কী সহানুভূতি-আর্দ্র করুণ স্নেহময় গভীর দৃষ্টি তাঁর। আঃ মাগো! আঃ!’