ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


বলাকা
ৎ‌সর্গ

      উইলি পিয়র্‌সন্ বন্ধুবরেষু


 

আপনারে তুমি সহজে ভুলিয়া থাক,

              আমরা তোমারে ভুলিতে পারি না তাই

সবার পিছনে নিজেরে গোপনে রাখ,

               আমরা তোমারে প্রকাশ করিতে চাই

ছোটোরে কখনো ছোটো নাহি কর মনে,

              আদর করিতে জান অনাদৃত জনে,

প্রীতি তব কিছু না চাহে নিজের জন্য,

             তোমারে আদরি আপনারে করি ধন্য

 

তোসা-মারু জাহাজ                                    স্নেহাসক্ত

    বঙ্গসাগর                                       শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

৭ মে ১৯১৬


 

পর্যায়ক্রমকিক সূচি বর্ণনানুক্রমিক সূচি
১. ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
২. এবার যে ওই সর্বনেশে গো
৩.
আমরা চলি সমুখপানে
৪.
তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে
৫.
মত্ত সাগর দিল পাড়ি গহন রাত্রিকালে

৬. তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা
৭. এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান
৮.  হে বিরাট নদী

৯. কে তোমারে দিল প্রাণ
১০. এ প্রিয়, আজি এ প্রাতে
১১.
হে মোর সুন্দর
১২. তুমি দেবে
, তুমি মোরে দেবে
১৩.
পউষের পাতা-ঝরা তপোবনে

১৪. কত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে
১৫. মোর গান এরা সব শৈবালের দল
১৬.  বিশ্বের বিপুল বস্তুরাশি
১৭. হে ভুবন আমি যতক্ষণ
১৮. যতক্ষণ স্থির হয়ে থাকি

১৯. আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে
আমরা চলি সমুখপানে
আমি যে বেসেছি ভালো এই জগতেরে
এ কথা জানিতে তুমি ভারত-ঈশ্বর শা-জাহান
এ প্রিয়, আজি এ প্রাতে

এবার যে ওই সর্বনেশে গো
ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা
কত লক্ষ বরষের তপস্যার ফলে
কে তোমারে দিল প্রাণ
তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা
তুমি দেবে, তুমি মোরে দেবে
তোমার শঙ্খ ধুলায় পড়ে
পউষের পাতা-ঝরা তপোবনে
বিশ্বের বিপুল বস্তুরাশি

মত্ত সাগর দিল পাড়ি গহন রাত্রিকালে
মোর গান এরা সব শৈবালের দল
যতক্ষণ স্থির হয়ে থাকি

হে বিরাট নদী
হে ভুবন আমি যতক্ষণ
হে মোর সুন্দর

                 

                

                ২০

আনন্দ-গান উঠুক তবে বাজি

        এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে

অশ্রুজলের ঢেউয়ের পরে আজি

         পারের তরী থাকুক ভাসিতে

 

যাবার হাওয়া ওই যে উঠেছে—ওগো

          ওই যে উঠেছে,

সারারাত্রি চক্ষে আমার

       ঘুম যে ছুটেছে

 

হৃদয় আমার উঠেছে দুলে দুলে

        অকূল জলের অট্টহাসিতে,

কে গো তুমি দাও দেখি তান তুলে

       এবার আমার ব্যথার বাঁশিতে

 

হে অজানা, অজানা সুর নব

        বাজাও আমার ব্যথার বাঁশিতে,

হঠাৎ এবার উজান হাওয়ায় তব

        পারের তরী থাক্ না ভাসিতে

 

কোনো কালে হয় নি যারে দেখা—ওগো

       তারি বিরহে

এমন করে ডাক দিয়েছে,

        ঘরে কে রহে

 

বাসার আশা গিয়েছে মোর ঘুরে,

     ঝাঁপ দিয়েছি আকাশরাশিতে;

পাগল, তোমার সৃষ্টিছাড়া সুরে

       তান দিয়ো মোর ব্যথার বাঁশিতে

                                                রেলগাড়ি
                                          ২৯ পৌষ ১৩২১

                 ২১

ওরে তোদের ত্বর সহে না আর?

        এখনো শীত হয় নি অবসান

পথের ধারে আভাস পেয়ে কার

        সবাই মিলে গেয়ে উঠিস গান?

ওরে পাগল চাঁপা, ওরে উন্মত্ত বকুল,

কার তরে সব ছুটে এলি কৌতুকে আকুল

 

মরণপথে তোরা প্রথম দল,

        ভাবলি নে তো সময় অসময়

শাখায় শাখায় তোদের কোলাহল

         গন্ধে রঙে ছড়ায় বনময়

সবার আগে উচ্চে হেসে ঠেলাঠেলি করে

উঠলি ফুটে, রাশি রাশি পড়লি ঝরে ঝরে

 

বসন্ত সে আসবে যে ফাল্গুনে

          দখিন হাওয়ার জোয়ার-জলে ভাসি

তাহার লাগি রইলি নে দিন গুণে

       আগে-ভাগেই বাজিয়ে দিলি বাঁশি

রাত না হতে পথের শেষে পৌঁছবি কোন্ মতে

যা ছিল তোর কেঁদে হেসে ছড়িয়ে দিলি পথে!

 

ওরে খ্যাপা, ওরে হিসাব-ভোলা,

      দূর হতে তার পায়ের শব্দে মেতে

সেই অতিথির ঢাকতে পথের ধুলা

       তোরা আপন মরণ দিলি পেতে

না দেখে না শুনেই তোদের পড়ল বাঁধন খসে,

   চোখের দেখার অপেক্ষাতে রইলি নে আর বসে

                                                            কলিকাতা

                                                         ৮ মাঘ ১৩২১

                  ২২

            যখন আমায় হাতে ধরে

                  আদর করে

           ডাকলে তুমি আপন পাশে,

           রাত্রিদিবস ছিলেম ত্রাসে

পাছে তোমার আদর হতে অসাবধানে কিছু হারাই,

             চলতে গিয়ে নিজের পথে

             যদি আপন ইচ্ছামতে

        কোনো দিকে এক পা বাড়াই,

পাছে বিরাগ-কুশাঙ্কুরের একটি কাঁটা একটু মাড়াই

 

          মুক্তি, এবার মুক্তি আজি

                উঠল বাজি

           অনাদরের কঠিন ঘায়ে,

অপমানের ঢাকে ঢোলে সকল নগর সকল গাঁয়ে

ওরে ছুটি, এবার ছুটি, এই যে আমার হল ছুটি,

             ভাঙল আমার মানের খুঁটি,

             খসল বেড়ি হাতে পায়ে;

                    এই যে এবার

                    দেবার নেবার

            পথ খোলসা ডাইনে বাঁয়ে

 

            এতদিনে আবার মোরে

                  বিষম জোরে

           ডাক দিয়েছে আকাশ পাতাল

                 লাঞ্ছিতেরে কে রে থামায়

                 ঘর-ছাড়ানো বাতাস আমায়

                      মুক্তি-মদে করল মাতাল

                 খসে পড়া তারার সাথে

                         নিশীথরাতে

                 ঝাঁপ দিয়েছি অতলপানে

                         মরণ-টানে

 

আমি-যে সেই বৈশাখি মেঘ বাঁধনছাড়া,

        ঝড় তাহারে দিল তাড়া;

সন্ধ্যারবির স্বর্ণকিরীট ফেলে দিল অস্তপারে,

      বজ্রমানিক দুলিয়ে নিল গলার হারে;

            একলা আপন তেজে

                  ছুটল সে-যে

            অনাদরের মুক্তিপথের ’পরে

তোমার চরণধুলায়-রঙিন চরম সমাদরে

 

      গর্ভ ছেড়ে মাটির ’পরে

             যখন পড়ে

   তখন ছেলে দেখে আপন মাকে

            তোমার আদর যখন ঢাকে,

             জড়িয়ে থাকি তারি নাড়ীর পাকে,

             তখন তোমায় নাহি জানি

                আঘাত হানি

তোমারি আচ্ছাদন হতে যেদিন দূরে ফেলাও টানি

         সে-বিচ্ছেদে চেতনা দেয় আনি,

                    দেখি বদনখানি

                                              শিলাইদা কুঠিবাড়ি

                                                ১৯ মাঘ ১৩২১

                                                     রাত্রি

                        ২৩

                    কোন্ ক্ষণে

                 সৃজনের সমুদ্রমন্থনে

                        উঠেছিল দুই নারী

              অতলের শয্যাতল ছাড়ি

              একজনা উর্বশী, সুন্দরী,

              বিশ্বের কামনা-রাজ্যে রানী,

                   স্বর্গের অপ্সরী

              অন্যজনা লক্ষ্মী সে কল্যাণী,

              বিশ্বের জননী তাঁরে জানি,

                      স্বর্গের ঈশ্বরী

 

           একজন তপোভঙ্গ করি

উচ্চহাস্য-আগ্নিরসে ফাল্গুনের সুরাপাত্র ভরি

              নিয়ে যায় প্রাণমন হরি,

দু-হাতে ছড়ায় তারে বসন্তের পুষ্পিত প্রলাপে,

             রাগরক্ত কিংশুকে গোলাপে,

                     নিদ্রাহীন যৌবনের গানে

 

      আরজন ফিরাইয়া আনে

       অশ্রুর শিশির-স্নানে

              স্নিগ্ধ বাসনায়;

হেমন্তের হেমকান্ত সফল শান্তির পূর্ণতায়;

             ফিরাইয়া আনে

          নিখিলের আশীর্বাদপানে

অচঞ্চল লাবণ্যের স্মিতহাস্যসুধায় মধুর

           ফিরাইয়া আনে ধীরে

             জীবনমৃত্যুর

          পবিত্র সংগমতীর্থতীরে

          অনন্তের পূজার মন্দিরে

                                             পদ্মাতীরে

                                         ২০ মাঘ ১৩২১

                  ২৪

     স্বর্গ কোথায় জানিস কি তা ভাই

             তার ঠিক-ঠিকানা নাই

তার   আরম্ভ নাই, নাই রে তাহার শেষ,

   ওরে   নাই রে তাহার দেশ,

       ওরে  নাই রে তাহার দিশা,

ওরে নাই রে দিবস, নাই রে তাহার নিশা

 

ফিরেছি সেই স্বর্গে শূন্যে শূন্যে

        ফাঁকির ফাঁকা ফানুস

কত যে যুগ-যুগান্তরের পুণ্যে

      জন্মেছি আজ মাটির ’পরে ধুলামাটির মানুষ

স্বর্গ আজি কৃতার্থ তাই আমার দেহে,

       আমার প্রেমে, আমার স্নেহে,

             আমার ব্যাকুল বুকে,

আমার লজ্জা, আমার সজ্জা, আমার দুঃখে সুখে

             আমার জন্ম-মৃত্যুরি তরঙ্গে

নিত্যনবীন রঙের ছটায় খেলায় সে-যে রঙ্গে

 

          আমার গানে স্বর্গ আজি

                ওঠে বাজি,

      আমার প্রাণে ঠিকানা তার পায়,

আকাশভরা আনন্দে সে আমারে তাই চায়

দিগঙ্গনার অঙ্গেনে আজ বাজল যে তাই শঙ্খ,

       সপ্ত সাগর বাজায় বিজয়-ডঙ্ক

           তাই ফুটেছে ফুল,

বনের পাতায় ঝরনাধারায় তাই রে হুলুস্থুল

স্বর্গ আমার জন্ম নিল মাটি-মায়ের কোলে

বাতাসে সেই খবর ছিটে আনন্দ-কল্লোলে

                                                   শিলাইদা কুঠিবাড়ি

                                                     ২০ মাঘ ১৩২১

                           ২৫

যে-বসন্ত একদিন করেছিল কত কোলাহল

            লয়ে দলবল

      আমার প্রাঙ্গণতলে কলহাস্য তুলে

      দাড়িম্বে পলাশগুচ্ছে কাঞ্চনে পারুলে;

                  নবীন পল্লবে বনে বনে

বিহ্বল করিয়াছিল নীলাম্বর রক্তিম চুম্বনে;

         সে আজ নিঃশব্দে আসে আমার নির্জনে;

                       অনিমেষে

         নিস্তব্ধ বসিয়া থাকে নিভৃত ঘরের প্রান্তদেশে

              চাহি সেই দিগন্তের পানে

শ্যামশ্রী মূর্ছিত হয়ে নীলিমায় মরিছে যেখানে

                                                   পদ্মা

                                             ২০ মাঘ ১৩২১

                              ২৬

এবার ফাল্গুনের দিনে সিন্ধুতীরের কূঞ্জবীথিকায়

               এই যে আমার জীবন-লতিকায়

ফুটল কেবল শিউরে-ওঠা নতুন পাতা যত

                      রক্তবরন হৃদয়ব্যাথার মতো;

দখিন হাওয়া ক্ষণে ক্ষণে দিল কেবল দোল,

                  উঠল কেবল মর্মর কল্লোল

           এবার শুধু গানের মৃদু গুঞ্জনে

বেলা আমার ফুরিয়ে গেল কূঞ্জবনের প্রাঙ্গণে

 

আবার যেদিন আসবে আমার রুপের আগুন ফাগুনদিনের কাল

              দখিন হাওয়ায় উড়িয়ে রঙিন পাল,

সেবার এই সিন্ধুতীরের কূঞ্জবীথিকায়

              যেন আমার জীবন-লতিকায়

                  ফোটে প্রেমের সোনার বরন ফুল

                          হয় যেন আকুল

      নবীন রবির আলোকটি তাই বনের প্রাঙ্গণে

            আনন্দ মোর জনম নিয়ে

                     তালি দিয়ে তালি দিয়ে

             নাচে যেন গানের গুঞ্জনে

                                              পদ্মা

                                          ২২ মাঘ ১৩২১

                           ২৭

আমার কাছে রাজা আমার রইল অজানা

      তাই সে যখন তলব করে খাজানা

মনে করি পালিয়ে গিয়ে দেব তারে ফাঁকি,

                রাখব দেনা বাকি

যেখানেতেই পালাই আমি গোপনে

দিনে কাজের আড়ালেতে, রাতে স্বপনে,

             তলব তারি আসে

              নিশ্বাসে নিশ্বাসে

 

তাই জেনেছি, আমি তাহার নইকো অজানা

            তাই জেনেছি ঋণের দায়ে

                   ডাইনে বাঁয়ে

বিকিয়ে বাসা নাইকো আমার ঠিকানা

               তাই ভেবেছি জীবন-মরণে

যা আছে সব চুকিয়ে দেব চরণে

                তাহার পরে

                     নিজের জোরে

                        নিজেরি স্বত্বে

মিলবে আমার আপন বাসা তাঁহার রাজত্বে

                                                    পদ্মা

                                                ২২ মাঘ ১৩২১

                         ২৮

পাখিরে দিয়েছ গান, গায় সেই গান,

         তার বেশি করে না সে দান

আমারে দিয়েছ স্বর, আমি তার বেশি করি দান,

                আমি গাই গান

 

বাতাসেরে করেছ স্বাধীন,

সহজে সে ভৃত্য তব বন্ধনবিহীন

         আমারে দিয়েছ যত বোঝা,

তাই নিয়ে চলি পথে কভু বাঁকা কভু সোজা

একে একে ফেলে ভার মরণে মরণে

          নিয়ে যাই তোমার চরণে

একদিন রিক্তহস্ত সেবায় স্বাধীন;

বন্ধন যা দিলে মোরে করি তারে মুক্তিতে বিলীন

 

পূর্ণিমারে দিলে হাসি;

        সুখস্বপ্ন-রসরাশি

ঢালে তাই, ধরণীর করপুট সুধায় উচ্ছ্বাসি

দুঃখখানি দিলে মোর তপ্ত ভালে থুয়ে,

         অশ্রুজলে তারে ধুয়ে ধুয়ে

আনন্দ করিয়া তারে ফিরায়ে আনিয়া দিই হাতে

            দিনশেষে মিলনের রাতে

 

তুমি তো গড়েছ শুধু মাটির ধরণী তোমার

        মিলাইয়া আলোকে আঁধার

        শূন্যহাতে সেথা মোরে রেখে

হাসিছ আপনি সেই শূন্যের আড়ালে গুপ্ত থেকে

              দিয়েছ আমারে ’পরে ভার

              তোমার স্বর্গটি রচিবার

 

              আর সকলেরে তুমি দাও,

              শুধু মোর কাছে তুমি চাও

আমি যাহা দিতে পারি আপনার প্রেমে,

              সিংহাসন হতে নেমে

          হাসিমুখে বক্ষে তুলে নাও

              মোর হাতে যাহা দাও

তোমার আপন হাতে তার বেশে ফিরে তুমি পাও

                                                        পদ্মাতীর

                                                     ২৪ মাঘ ১৩২১

                             ২৯

              যেদিন তুমি আপনি ছিলে একা

              আপনাকে তো হয় নি তোমার দেখা

সেদিন কোথাও কারো লাগি ছিল না পথ-চাওয়া;

         এপার হতে ওপার বেয়ে

               বয় নি ধেয়ে

কাঁদন-ভরা বাঁধন-ছেঁড়া হাওয়া

 

        আমি এলেম, ভাঙল তোমার ঘুম,

শূন্যে শূন্যে ফুটল আলোর আনন্দ-কুসুম

             আমায় তুমি ফুলে ফুলে

                   ফুটিয়ে তুলে

        দুলিয়ে দিলে নানা রূপের দোলে

আমায় তুমি তারায় তারায় ছড়িয়ে দিয়ে কুড়িয়ে নিলে কোলে

          আমায় তুমি মরণ মাঝে লুকিয়ে ফেলে

              ফিরে ফিরে নূতন করে পেলে

 

              আমি এলেম, কাঁপল তোমার বুক,

               আমি এলেম, এল তোমার দুখ,

         আমি এলেম, এল তোমার আগুনভরা আনন্দ,

         জীবন-মরণ-তুফান-ভোলা ব্যাকুল বসন্ত

          আমি এলেম, তাই তো তুমি এলে,

                   আমার মুখে চেয়ে

                   আমার পরশ পেয়ে

                      আপন পরশ পেলে

 

আমার চোখে লজ্জা আছে, আমার বুকে ভয়,

         আমার মুখে ঘোমটা পড়ে রয়;

দেখতে তোমায় বাধে ব’লে পড়ে চোখের জল;

               ওগো আমার প্রভু,

                 জানি আমি তবু

আমায় দেখবে ব’লে তোমার অসীম কৌতূহল,

নইলে তো এই সূর্যতারা সকলি নিষ্ফল

                                                  পদ্মাতীর

                                              ২৫ মাঘ ১৩২১

                   ৩০

এই দেহটির ভেলা নিয়ে দিয়েছি সাঁতার গো,

          এই দু-দিনের নদী হব পার গো

তার পরে যেই ফুরিয়ে যাবে বেলা,

         ভাসিয়ে দেব ভেলা,

তার পরে তার খবর কী যে ধারি নে তার ধার গো,

তার পরে সে কেমন আলো, কেমন অন্ধকার গো

 

আমি যে অজানার যাত্রী সেই আমার আনন্দ

        সেই তো বাধায় সেই তো মেটায় দ্বন্দ্ব

জানা আমায় যেমনি আপন ফাঁদে

         শক্ত করে বাঁধে

অজানা সে সামনে এসে হঠাৎ লাগায় ধন্দ,

এক-নিমেষে যায় গো ফেঁসে অমনি সকল বন্ধ

 

অজানা মোর হালের মাঝি, অজানাই তো মুক্তি,

         তার সনে মোর চিরকালের চুক্তি

          ভয় দেখিয়ে ভাঙায় আমার ভয়

               প্রেমিক সে নির্দয়

মানে না সে বুদ্ধিসুদ্ধি বৃদ্ধজনার যুক্তি,

মুক্তারে সে মুক্ত করে ভেঙে তাহার শুক্তি

 

ভাবিস বসে যেদিন গেছে সেদিন কি আর ফিরবে

            সেই কূলে কি এই তরী আর ভিড়বে

         ফিরবে না রে, ফিরবে না আর, ফিরবে না,

                সেই কূলে আর ভিড়বে না

সামনেকে তুই ভই করেছিস, পিছন তোরে ঘিরবে

এমনি কি তুই ভাগ্যহারা? ছিঁড়বে বাঁধন ছিঁড়বে

 

ঘণ্টা যে  ওই বাজল কবি, হোক রে সভাভঙ্গ,

        জোয়ার-জলে উঠেছে তরঙ্গ

      এখনো সে দেখায় নি তার মুখ,

            তাই তো দোলে বুক

কোন্ রূপে যে সেই অজানার কোথায় পাব সঙ্গ,

কোন্ সাগরের কোন্ কূলে গো কোন্ নবীনের রঙ্গ

                                                              পদ্মাতীর

                                                           ২৬ মাঘ ১৩২১

                  ৩১

    নিত্য তোমার পায়ের কাছে

    তোমার বিশ্ব তোমার আছে

            কোনোখানে অভাব কিছু নাই

   পূর্ণ তুমি, তাই

তোমার ধনে মানে তোমার আনন্দ না ঠেকে

               তাই তো একে একে

যা-কিছু ধন তোমার আছে আমার ক’বে লবে

         এমনি করেই হবে

                  ঐশ্বর্য তব

তোমার আপন কাছে, প্রভু, নিত্য নব নব

এমনি করেই দিনে দিনে

             আমার চোখে লও যে কিনে

                 তোমার সূর্যোদয়

             এমনি করেই দিনে দিনে

আপন প্রেমের পরশমণি, আপনি যে লও চিনে

             আমার পরান করি হিরণ্ময়

                                                   পদ্মা

                                              ২৭ মাঘ ১৩২১

                               ৩২

               আজ এই দিনের শেষে

সন্ধ্যা যে ওই মানিকখানি পরেছিল চিকন কালো কেশে

                 গেঁথে নিলেম তারে

এই তো আমার বিনিসুতার গোপন গলার হারে

       চক্রবাকের নিদ্রানীরব বিজন পদ্মাতীরে

       এই যে সন্ধ্যা ছুঁইয়ে গেল আমার নতশিরে

                    নির্মাল্য তোমার

                    আকাশ হয়ে পার;

                ওই যে মরি মরি

তরঙ্গহীন স্রোতের ’পরে ভাসিয়ে দিল তারার ছায়াতরী;

            ওই যে তার সোনার চেলি

                     দিল মেলি

                রাতের আঙিনায়

                 ঘুমে অলস কায়;

            ওই যে শেষে সপ্তঋষির ছায়াপথে

                    কালো ঘোড়ার রথে

     উড়িয়ে দিয়ে আগুন-ধূলি নিল সে বিদায়;

একটি কেবল করুণ পরশ রেখে গেল একটি কবির ভালে;

তোমার ওই অনন্ত মাঝে এমন সন্ধ্যা হয় নি কোনোকালে,

                 আর হবে না কভু

                  এমনি করেই প্রভু

            এক নিমেষের পত্রপুটে ভরি

চিরকালের ধনটি তোমার ক্ষণকালে লও যে নূতন করি

                                                                   পদ্মা

                                                                ২৭ মাঘ ১৩২১

                          ৩৩

জানি আমার পায়ের শব্দ রাত্রে দিনে শুনতে তুমি পাও,

             খুশি হয়ে পথের পানে চাও

       খুশি তোমার ফুটে ওঠে শরৎ-আকাশে

                  অরুণ-আভাসে

       খুশি তোমার ফাগুনবনে আকুল হয়ে পড়ে

                  ফুলের ঝড়ে ঝড়ে

              আমি যতই চলি তোমার কাছে

                   পথটি চিনে চিনে

               তোমার সাগর অধিক করে নাচে

                        দিনের পরে দিনে

 

জীবন হতে জীবনে মোর পদ্মটি যে ঘোমটা খুলে খুলে

                ফোটে তোমার মানস-সরোবরে

সূর্যতারা ভিড় ক’রে তাই ঘুরে ঘুরে বেড়ায় কূলে কূলে

                  কৌতুহলের ভরে

              তোমার জগৎ আলোর মঞ্জরী

                    পূর্ণ করে  তোমার অঞ্জলি

তোমার লাজুক স্বর্গ আমার গোপন আকাশে

একটি করে পাপড়ি খোলে প্রেমের বিকাশে

                                                    পদ্মা
                                                ২৭
মাঘ ১৩২১

                              ৩৪

আমার মনের জানালাটি আজ হঠাৎ গেল খুলে

               তোমার মনের দিকে

সকালবেলার আলোয় আমি সকল কর্ম ভুলে

                রইনু অনিমিখে

              দেখতে পেলেম তুমি মোরে

              সদাই ডাক যে-নাম ধ’রে

সে-নামটি এই চৈত্রমাসের পাতায় পাতায় ফুলে

                   আপনি দিলে লিখে

সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে

             রইনু অনিমিখে

 

আমার সুরের পর্দাটি আজ হঠাৎ গেল উড়ে

              তোমার গানের পানে

সকালবেলার আলো দেখি তোমার সুরে সুরে

               ভরা আমার গানে

               মনে হল আমারি প্রাণ

             তোমার বিশ্বে তুলেছে তান,

আপন গানের সুরগুলি সেই তোমার চরণমূলে

                 নেব আমি শিখে

সকালবেলার আলোতে তাই সকল কর্ম ভুলে

                   রইনু অনিমিখে

                                               সুরুল
                                         ২১
চৈত্র ১৩২১ 

৩৫

আজ প্রভাতের আকাশটি এই

                      শিশির-ছলছল,

নদীর ধারের ঝাউগুলি ওই

                      রৌদ্রে ঝলমল,

                      এমনি নিবিড় করে

   এরা দাঁড়ায় হৃদয় ভরে

                      তাই তো আমি জানি

বিপুল  বিশ্বভুবনখানি

          অকূল মানস-সাগরজলে

                      কমল টলমল

        তাই তো আমি জানি

আমি     বাণীর সাথে বাণী

আমি     গানের সাথে গান,

আমি     প্রাণের সাথে প্রাণ,

আমি     অন্ধকারের হৃদয়-ফাটা

                        আলোক জ্বলজ্বল

                                                 শ্রীনগর কাশ্মীর

                                                 ৭ কার্তিক ১৩২২

           ৩৬

সন্ধ্যারাগে-ঝিলিমিলি ঝিলমের স্রোতখানি বাঁকা

         আঁধারে মলিন হল যেন খাপে ঢাকা

             বাঁকা তলোয়ার!

      দিনের ভাঁটার শেষে রাত্রির জোয়ার

এল তার ভেসে-আসা তারাফুল নিয়ে কালো জলে;

                   অন্ধকার গিরিতটতলে

                         দেওদার-তরু সারে সারে;

 মনে হল সৃষ্টি যেন স্বপ্নে চায় কথা কহিবারে,

                বলিতে না পারে স্পষ্ট করি,

 অব্যক্ত ধ্বনির পুঞ্জ অন্ধকারে উঠিছে গুমরি

 

          সহসা শুনিনু সেই ক্ষণে

                    সন্ধ্যার গগনে

      শব্দের বিদ্যুৎ‌ছটা শূন্যের প্রান্তরে

 মুহূর্তে ছুটিয়া গেল দূর হতে দূরে দূরান্তরে

                 হে হংসবলাকা,

   ঝঞ্ঝা-মদরসে মত্ত তোমাদের পাখা

             রাশি রাশি আনন্দের অট্টহাসে

বিস্ময়ের জাগরণ তরঙ্গিয়া চলিল আকাশে

                   ওই পক্ষধ্বনি,

            শব্দময়ী অপ্সর-রমণী,

    গেল চলি স্তব্ধতার তপোভঙ্গ করি

                   উঠিল শিহরি

          গিরিশ্রেণী তিমিরমগন,

          শিহরিল দেওদার-বন

 

        মনে হল এ পাখার বাণী

                 দিল আনি

         শুধু পলকের তরে

পুলকিত নিশ্চলের অন্তরে অন্তরে

           বেগের আবেগ

  পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ;

              তরুশ্রেণী চাহে, পাখা মেলি

                   মাটির বন্ধন ফেলি

 ওই শব্দরেখা ধরে চকিতে হইতে দিশাহারা,

               আকাশের খুঁজিতে কিনারা

 এ সন্ধ্যার স্বপ্ন টুটে বেদনার ঢেউ উঠে জাগি

                      সুদূরের লাগি,

              হে পাখা বিবাগি

 বাজিল ব্যাকুল বাণী নিখিলের প্রাণে

 “হেথা নয়, হেথা নয়, আর কোন্‌খানে

 

                হে হংসবলাকা,

আজ রাত্রে মোর কাছে খুলে দিলে স্তব্ধতার ঢাকা

       শুনিতেছি আমি এই নিঃশব্দের তলে

                    শুন্যে জলে স্থলে

       অমনি পাখার শব্দ উদ্দাম চঞ্চল

                           তৃণদল

  মাটির আকাশ-পরে ঝাপটিছে ডানা;

  মাটির আঁধার-নীচে, কে জানে ঠিকানা,

              মেলিতেছে অঙ্কুরের পাখা

              লক্ষ লক্ষ বীজের বলাকা,

              দেখিতেছি আমি আজি

                      এই গিরিরাজি,

       এই বন, চলিয়াছে উন্মুক্ত ডানায়

 দ্বীপ হতে দ্বীপান্তরে, অজানা হইতে অজানায়

                    নক্ষত্রের পাখার স্পন্দনে

      চমকিছে অন্ধকার আলোর ক্রন্দনে

 

       শুনিলাম মানবের কত বাণী দলে দলে

                 অলক্ষিত পথে উড়ে চলে

অস্পষ্ট অতীত হতে অস্ফুট সুদূর যুগান্তরে

                 শুনিলাম আপন অন্তরে

                 অসংখ্য পাখির সাথে

                        দিনে রাতে

 এই বাসাছাড়া পাখি ধায় আলো-অন্ধকারে

            কোন্ পার হতে কোন্ পারে

 ধ্বনিয়া উঠিছে শুন্য নিখিলের পাখার এ গানে

 “হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোথা, অন্য কোন্‌খানে

                                                                   শ্রীনগর

                                                               কার্তিক ১৩২২

                    ৩৭

দূর হতে কী শুনিস মৃত্যুর গর্জন,ওরে দীন,

                    ওরে উদাসীন

             ওই ক্রন্দনের কলরোল,

লক্ষ বক্ষ হতে মুক্ত রক্তের কল্লোল

        বহ্নিবন্যা-তরঙ্গের বেগ,

        বিষশ্বাস-ঝটিকার মেঘ,

               ভূতল গগন

মূর্ছিত বিহ্বল-করা মরণে মরণে আলিঙ্গন;

          ওরি মাঝে পথ চিরে চিরে

                 নূতন সমুদ্রতীরে

       তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি,

                 ডাকিছে কাণ্ডারী

                 এসেছে আদেশ

   বন্দরে বন্ধনকাল এবারের মতো হল শেষ,

পুরানো সঞ্চয় নিয়ে ফিরে ফিরে শুধু বেচাকেনা

                       আর চলিবে না

        বঞ্চনা বাড়িয়া ওঠে, ফুরায় সত্যের যত পুঁজি,

                 কাণ্ডারী ডাকিছে তাই বুঝি

                 “তুফানের মাঝখানে

                  নূতন সমুদ্রতীরপানে

                            দিতে হবে পাড়ি

                            তাড়াতাড়ি

                         তাই ঘর ছাড়ি

চারি দিক হতে ওই দাঁড়-হাতে ছুটে আসে দাঁড়ী

 

               “নূতন উষার স্বর্ণদ্বার

             খুলিতে বিলম্ব কত আর

              কথা শুধায় সবে

                 ভীত আর্তরবে

              ঘুম হতে অকস্মাৎ জেগে

                   ঝড়ের পুঞ্জিত মেঘে

  কালোয় ঢেকেছে আলো জানে না তো কেউ

রাত্রি আছে কিনা আছে; দিগন্তে ফেনায় উঠে ঢেউ

    তারি মাঝে ফুকারে কাণ্ডারী

“নূতন সমুদ্রতীরে তরী নিয়ে দিতে হবে পাড়ি

   বাহিরিয়া এল কা’রা মা কাঁদিছে পিছে,

          প্রেয়সী দাঁড়ায়ে দ্বারে নয়ন মুদিছে

                        ঝড়ের গর্জনমাঝে

                   বিচ্ছেদের হাহাকার বাজে;

          ঘরে ঘরে শূন্য হল আরামের শয্যাতল;

                “যাত্রা করো, যাত্রা করো যাত্রীদল”

                        উঠেছে আদেশ,

                 “বন্দরের কাল শেষ

 

                       মৃত্যু ভেদ করি

                   দুলিয়া চলিছে তরী

        কোথায় পৌঁছিবে ঘাটে,কবে হবে পার,

                 সময় তো নাই শুধাবার

               এই শুধু জানিয়াছে সার

                 তরঙ্গের সাথে লড়ি

           বাহিয়া চলিতে হবে তরী

           টানিয়া রাখিতে হবে পাল,

     আঁকড়ি ধরিতে হবে হাল;

              বাঁচি আর মরি

         বাহিয়া চলিতে হবে তরী

             এসেছে আদেশ

      বন্দরের কাল শেষ

   অজানা সমুদ্রতীর, অজানা সে-দেশ

         সেথাকার লাগি

         উঠিয়াছে জাগি

ঝটিকার কণ্ঠে কণ্ঠে শূন্যে শূন্যে প্রচণ্ড আহ্বান

               মরণের গান

    উঠেছে ধ্বনিয়া পথে নবজীবনের অভিসারে

                   ঘোর অন্ধকারে

    যত দুঃখ পৃথিবীর, যত পাপ, যত অমঙ্গল

                    যত অশ্রুজল,

                যত হিংসা হলাহল,

                সমস্ত উঠিছে তরঙ্গিয়া,

                      কূল উল্লঙ্ঘিয়া,

              উর্ধ্ব আকাশেরে ব্যঙ্গ করি

                     তবু বেয়ে তরী

                 সব ঠেলে হতে হবে পার,

 কানে নিয়ে নিখিলের হাহাকার,

       শিরে লয়ে উন্মত্ত দুর্দিন,

       চিত্তে নিয়ে আশা অন্তহীন,

       হে নির্ভীক, দুঃখ-অভিহিত

 ওরে ভাই, কার নিন্দা কর তুমি মাথা করো নত

          আমার তোমার পাপ

          বিধাতার বক্ষে এই তাপ

 বহু যুগ হতে জমি বায়ুকোণে আজিকে ঘনায়

       ভীরুর ভীরুতাপুঞ্জ, প্রবলের উদ্ধত অন্যায়,

                 লোভীর নিষ্ঠুর লোভ,

              বঞ্চিতের নিত্য চিত্তক্ষোভ,

                     জাতি-অভিমান,

মানবের অধিষ্ঠাত্রী দেবতার বহু অসম্মান,

         বিধাতার বক্ষ আজি বিদীরিয়া

ঝটিকার দীর্ঘশ্বাসে জলে স্থলে বেড়ায় ফিরিয়া

          ভাঙিয়া পড়ুক ঝড়, জাগুক তুফান,

নিঃশেষ হইয়া যাক নিখিলের যত বজ্রবাণ

রাখো নিন্দাবাণী, রাখো আপন সাধুত্ব অভিমান,

                     শুধু একমনে হও পার

                         প্রলয়-পারাবার

                      নূতন সৃষ্টির উপকূলে

                      নূতন বিজয়ধ্বজা তুলে

 

দুঃখেরে দেখেছি নিত্য, পাপেরে দেখেছি নানা ছলে;

অশান্তির ঘূর্ণি দেখি জীবনের স্রোতে পলে পলে;

                মৃত্যু করে লুকাচুরি

                সমস্ত পৃথিবী জুড়ি

          ভেসে যায় তারা সরে যায়

              জীবনেরে করে যায়

                  ক্ষণিক বিদ্রূপ

আজ দেখো তাহাদের অভ্রভেদী বিরাট স্বরূপ

              তার পরে দাঁড়াও সম্মুখে,

                বলো অকম্পিত বুকে

                 “তোরে নাহি করি ভয়,

  সংসারে প্রতিদিন তোরে করিয়াছি জয়

তোর চেয়ে আমি সত্য বিশ্বাসে প্রাণ দিব, দেখ্

  শান্তি সত্য, শিব সত্য, সত্য সেই চিরন্তন এক

 

মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খঁজে,

   সত্য যদি নাহি মেলে দুঃখ সাথে যুঝে,

         পাপ যদি নাহি মরে যায়

          আপনার প্রকাশ লজ্জায়,

অহংকার ভেঙে নাহি পড়ে আপনার অসহ্য সজ্জায়,

            তবে ঘরছাড়া সবে

         অন্তরের কী আশ্বাস-রবে

         মরিতে ছুটিছে শত শত

প্রভাত-আলোর পানে লক্ষ লক্ষ নক্ষত্রের মতো

     বীরের রক্তস্রোত, মাতার অশ্রুধারা

এর যত মূল্য সে কি ধরার ধুলায় হবে হারা

            স্বর্গ কি হবে না কেনা

             বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না

                      এত ঋণ?

      রাত্রির তপস্যা সে কি আনিবে না দিন

           নিদারুণ দুঃখরাতে

                মৃত্যুঘাতে

       মানুষ চূর্ণিল যবে নিজ মর্তসীমা

   তখন দিবে না দেখা দেবতার অমর মহিমা?

                                                      কলিকাতা

                                                    ২৩ কার্তিক ১৩২২

                      ৩৮

সর্বদেহের ব্যাকূলতা কী বলতে চায় বাণী,

        তাই আমার এই নূতন বাসনখানি

নূতন সে মোর হিয়ার মধ্যে দেখতে কি পায় কেউ

                      সেই নূতনের ঢেউ

অঙ্গ বেয়ে পড়ল ছেয়ে নূতন বসনখানি

দেহ-গানের তান যেন এই নিলেম বুকে টানি

 

আপনাকে তো দিলেম তারে, তবু হাজার বার

           নূতন করে দিই যে উপহার

চোখের কালোয় নূতন আলো ঝলক দিয়ে ওঠে,

                    নূতন হাসি ফোটে,

তারি সঙ্গে, যতনভরা নূতন বসনখানি

অঙ্গ আমার নূতন করে দেয়-যে তারে আনি

চাঁদের আলো চাইবে রাতে বনছায়ার পানে

          বেদনভরা শুধু চোখের গানে

মিলব তখন বিশ্বমাঝে আমরা দোঁহে একা,

                  যেন নূতন দেখা

তখন আমার অঙ্গ ভরি নূতন বসনখানি

পাড়ে পাড়ে ভাঁজে ভাঁজে করবে কানাকানি

 

ওগো, আমার হৃদয় যেন সন্ধ্যারি আকাশ,

      রঙের নেশায় মেটে না তার আশ,

তাই তো বসন রাঙিয়ে পরি কখনো বা ধানী,

                       কখনো জাফরানী,

আজ তোরা দেখ্ চেয়ে আমার নূতন বসনখানি

বৃষ্টি-ধোওয়া আকাশ যেন নবীন আসমানী

 

অকূলের এই বর্ণ, -যে দিশাহারার নীল,

         অন্য পারের বনের সাথে মিল

আজকে আমার সকল দেহে বইছে দূরের হাওয়া

               সাগরপানে ধাওয়া

আজকে আমার অঙ্গে আনে নূতন কাপড়খানি

বৃষ্টিভরা ঈশান কোণের নব মেঘের বাণী

                                                     পদ্মা

                                              ১২ অগ্রহায়ণ ১৩২২

                 ৩৯

যেদিন উদিলে তুমি, বিশ্বকবি, দূর সিন্ধুপারে,

ইংলণ্ডের দিকপ্রান্ত পেয়েছিল সেদিন তোমারে

আপন বক্ষের কাছে, ভেবেছিল বুঝি তারি তুমি

কেবল আপন ধন; উজ্জ্বল ললাট তব চুমি

দেখেছিল কিছুকাল অরণ্যশাখার বাহুজালে,

ঢেকেছিল কিছুকাল কুয়াশা-অঞ্চল-অন্তরালে

বনপুষ্প-বিকশিত তৃণঘন শিশির উজ্জ্বল

পরীদের খেলার প্রাঙ্গণে দ্বীপের নিকুঞ্জতল

তখনো ওঠে নি জেগে কবিসূর্য-বন্দনাসংগীতে

তার পরে ধীরে ধীরে অনন্তের নিঃশব্দ ইঙ্গিতে

দিগন্তের কোল ছাড়ি শতাব্দীর প্রহরে প্রহরে

উঠিয়াছে দীপ্তজ্যোতি মধ্যাহ্নের গগনের ’পরে;

নিয়েছ আসন তব সকল দিকের কেন্দ্রদেশে

বিশ্বচিত্ত উদ্ভাসিয়া; তাই হেরো যুগান্তর-শেষে

ভারতসমুদ্রতীরে কম্পমান শাখাপুঞ্জে আজি

নারিকেলকুঞ্জবনে জয়ধ্বনি উঠিতেছে বাজি

                                                    শিলাইদহ
                                                 
১৩ গ্রহায়ণ ১৩২২

                            ৪০

                         এইক্ষণে

মোর হৃদয়ের প্রান্তে আমার নয়ন-বাতায়নে

   যে-তুমি রয়েছ চেয়ে প্রভাত-আলোতে

সে-তোমার দৃষ্টি যেন নানা দিন নানা রাত্রি হতে

                    রহিয়া রহিয়া

           চিত্তে মোর আনিছে বহিয়া

            নীলিমার অপার সংগীত,

            নিঃশ্বব্দের উদার ইঙ্গিত

 

                  আজি মনে হয় বারে বারে

         যেন মোর স্মরণের দূর পরপারে

                          দেখিয়াছ কত দেখা

কত যুগে, কত লোকে, কত চোখে, কত জনতায়, কত একা

            সেই-সব দেখা আজি শিহরিছে দিকে দিকে

                      ঘাসে ঘাসে নিমিখে নিমিখে,

            বেনুবনে ঝিলিমিলি পাতার ঝলক-ঝিকিমিকে

                  কত নব নব অবগুণ্ঠনের তলে

                         দেখিয়াছ কত ছলে

                             চুপে চুপে

                   এক প্রেয়সীর মুখ কত রুপে রুপে

          জন্মে জন্মে, নামহারা নক্ষত্রের গোধূলি-লগনে

                      তাই আজি নিখিল গগনে

                   অনাদি মিলন তব অনন্ত বিরহ

                 এক পূর্ণ বেদনায় ঝংকারি উঠিছে অহরহ

 

                    তাই যা দেখিছ তারে ঘিরেছে নিবিড়

                        যাহা দেখিছ না তারি ভিড়

                              তাই আজি দক্ষিণ পবনে

                ফাল্গুনের ফুলগন্ধে ভরিয়া উঠিছে বনে বনে

                                   ব্যাপ্ত ব্যাকুলতা,

            বহুশত জনমের চোখে-চোখে কানে-কানে কথা

                                                                   শিলাইদা

                                                               ৭ ফাল্গুন ১৩২২

 

                             ৪১

              যে-কথা বলিতে চাই,

                 বলা হয় নাই,

                      সে কেবল এই

       চিরদিবসের বিশ্ব আঁখিসম্মুখেই

                           দেখিনু সহস্রবার

                            দুয়ারে আমার

               অপরিচিতের এই পরিচয়

এতই সহজে নিত্য ভরিয়াছে গভীর হৃদয়

   সে-কথা বলিতে পারি এমন সরল বাণী

               আমি নাহি জানি

 

শূন্য প্রান্তরের গান বাজে ওই একা ছায়াবটে;

           নদীর এপার ঢালু তটে

               চাষি করিতেছে চাষ;

          উড়ে চলিয়াছে হাঁস

ওপারের জনশূন্য তৃণশূন্য বালুতীরতলে

              চলে কি না চলে

          ক্লান্তস্রোত শীর্ণ নদী, নিমেষ-নিহত

              আধো-জাগা নয়নের মতো

              পথখানি বাঁকা

        বহুশত বরষের পদচিহ্ন-আঁকা

চলেছে মাঠের ধারে, ফসল-খেতের যেন মিতা,

          নদীসাথে কুটিরের বহে কুটুম্বিতা

 

ফাল্গুনের -আলোয় এই গ্রাম, ওই শূন্য মাঠ,

              ওই খেয়াঘাট,

ওই নীল নদীরেখা, ওই দূর বালুকার কোলে

  নিভৃত জলের ধারে চখাচখি কাকলি-কল্লোলে

        যেখানে বসায় মেলা এই-সব ছবি

             কতদিন দেখিয়াছে কবি

শুধু এই চেয়ে দেখা, এই পথ বেয়ে চলে যাওয়া,

          এই আলো, এই হাওয়া,

          এইমতো অস্ফুটধ্বনির গুঞ্জরণ,

               ভেসে-যাওয়া মাঘ হতে

              অকস্মাৎ নদীস্রোতে

                  ছায়ার নিঃশব্দ সঞ্চরণ,

যে আনন্দ-বেদনায় জীবন বারেবারে করেছে উদাস

              হৃদয় খুঁজিছে আজি তাহারি প্রকাশ

                                                                পদ্মা
                                                         
ফাল্গুন ১৩২২

 

                                   ৪২

          তোমারে কি বারবার করেছিনু অপমান

                    এসেছিলে গেয়ে গান

                       ভোরবেলা;

   ঘুম ভাঙাইলে ব’লে মেরেছিনু ঢেলা

                       বাতায়ন হতে,

    পরক্ষণে কোথা তুমি লুকাইলে জনতার স্রোতে

                     ক্ষুধিত দরিদ্রসম

                 মধ্যাহ্নে এসেছ দ্বারে মম

                     ভেবেছিনু, ‘এ কী দায়,

কাজের ব্যাঘাত -যে দূর হতে করেছি বিদায়

 

        সন্ধ্যাবেলা এসেছিলে যেন মৃত্যুদূত

                 জ্বালায়ে মশাল-আলো, অস্পষ্ট অদ্ভুত

                        দুঃস্বপ্নের মতো

         দস্যু ব’লে শত্রু  ব’লে ঘরে দ্বার যত

                      দিনু রোধ করি

             গেল চলি, অন্ধকার উঠিল শিহরি

        এরি লাগি এসেছিলে, হে বন্ধু অজানা

                           তোমারে করিব মানা,

             তোমারে ফিরায়ে দিব, তোমারে মারিব,

                 তোমা-কাছে যত ধার সকলি ধারিব,

                           না করিয়া শোধ

                          দুয়ার করিব রোধ

 

                            তার পরে অর্ধরাতে

                 দীপ-নেবা অন্ধকারে বসিয়া ধুলাতে

                          মনে হবে আমি বড়ো একা

                 যাহারে ফিরায়ে দিনু বিনা তারি দেখা

                        দীর্ঘ জীবন ধরি

                 বহুমানে যাহাদের নিয়েছিনু বরি

                           একাগ্র উৎসুক,

                  আঁধারে মিলায়ে যাবে তাহদের মুখ

                          সে আসিলে ছিনু অন্যমনে,

                   যাহারে দেখি নি চেয়ে নয়নের কোণে,

                            যারে নাহি চিনি,

                     যার ভাষা বুঝিতে পারি নি,

অর্ধরাতে দেখা দিবে বারেবারে তারি মুখ নিদ্রাহীন চোখে

            রজনীগন্ধার গন্ধে তারার আলোকে

      বারেবারে-ফিরে-যাওয়া অন্ধকারে বাজিবে হৃদয়ে

            বারেবারে-ফিরে-আসা হয়ে

                                                                 শিলাইদা

                                                              ৮ ফাল্গুন ১৩২২

                                ৪৩

                 ভাবনা নিয়ে মরিস কেন খেপে

                       দুঃখ-সুখের লীলা

                  ভাবিস কি রইবে বক্ষে চেপে

                             জগদ্দলন-শিলা

                  চলেছিস রে চলাচলের পথে

                  কোন্ সারথির উধাও মনোরথে?

                  নিমেষতরে যুগে যুগান্তরে

                        দিবে না রাশ-ঢিলা

 

                 শিশু হয়ে এলি মায়ের কোলে,

                        সেদিন গেল ভেসে

               যৌবনেরি বিষম দোলার দোলে

                        কাটল কেঁদে হেসে

                 রাত্রে যখন হচ্ছিল দীপ জ্বালা

                 কোথায় ছিল আজকে দিনের পালা

                 আবার কবে কী সুর বাঁধা হবে

                            আজকে পালার শেষে

 

                 চলতে যাদের হবে চিরকালই

                        নাইকো তাদের ভার

                 কোথা তাদের রইবে থলি-থালি,

                        কোথা বা সংসার

                  দেহযাত্রা মেঘের খেয়া বাওয়া,

                  মন তাহাদের ঘূর্ণা-পাকের হাওয়া;

                  বেঁকে বেঁকে আকার এঁকে এঁকে

                          চলছে নিরাকার

 

                   ওরে পথিক, ধর্-না চলার গান,

                             বাজা রে একতারা

                   এই খুশিতেই মেতে উঠুক প্রাণ-

                              নাইকো কূল-কিনারা

                   পায়ে পায়ে পথের ধারে ধারে

                   কান্না-হাসির ফুল ফুটিয়ে যা রে,

                      প্রাণ-বসন্তে তুই-যে দখিন হাওয়া

                             গৃহ-বাঁধন-হারা!

                   এই জনমের এই রূপের এই খেলা

                             এবার করি শেষ;

                   সন্ধ্যা হল, ফুরিয়ে এল বেলা,

                             বদল করি বেশ

                   যাবার কালে মুখ ফিরিয়ে পিছু

                   কান্না আমার ছড়িয়ে যাব কিছু,

                   সামনে সে- প্রেমের কাঁদন ভরা

                                চির-নিরুদ্দেশ

                  

বঁধুর দিঠি মধুর হয়ে আছে

                                সেই অজানার দেশে

                      প্রাণের ঢেউ সে এমনি করেই নাচে

                               এমনি ভালোবেসে

                       সেখানেতে আবার সে কোন্ দূরে

 

                       আলোর বাঁশি বাজবে গো এই সুরে

                       কোন্ মুখেতে সেই অচেনা ফুল

                          ফুটবে আবার হেসে

 

                   এইখানে এক শিশির-ভরা প্রাতে

                          মেলেছিলেম প্রাণ

                    এইখানে এক বীণা নিয়ে হাতে

                           সেধেছিলেম তান

                    এতকালের সে মোর বীণাখানি

                    এইখানেতেই ফেলে যাব জানি,

                    কিন্তু ওরে হিয়ার মধ্যে ভারি

                            নেব যে তার গান

 

                     সে-গান আমি শোনাব যার কাছে

                             নূতন আলোর তীরে,

                     চিরদিন সে সাথে সাথে আছে

                              আমার ভুবন ঘিরে

                     শরতে সে শিউলি-বনের তলে

                     ফুলের গন্ধে ঘোমটা টেনে চলে,

                     ফাল্গুনে তার বরণমালাখানি

                               পরাল মোর শিরে

 

                     পথের বাঁকে হঠাৎ দেয় সে দেখা

                                   শুধু নিমেষতরে

                     সন্ধ্যা-আলোয় রয় সে বসে একা

                                 উদাস প্রান্তরে

                      এমনি করেই তার সে আসা-যাওয়া,

                      এমনি করেই বেদন-ভরা হাওয়া 

                      হৃদয়-বনে বইয়ে সে যায় চলে

                                  মর্মরে মর্মরে

 

                      জোয়ার-ভাঁটার নিত্য চলাচলে

                              তার এই আনাগোনা

                      আধেক হাসি আধেক চোখের জলে

                               মোদের চেনাশোনা

                      তারে নিয়ে হল না ঘর বাঁধা,

                      পথে পথেই নিত্য তারে সাধা,

                      এমনি করেই আসা-যাওয়ার ডোরে

                                  প্রেমেরি জাল-বোনা

                                                               শান্তিনিকেতন

                                                            ২৯ ফাল্গুন ১৩২২

              ৪৪

যৌবন রে, তুই কি রবি সুখের খাঁচাতে

         তুই যে পারিস কাঁটাগাছের উচ্চ ডালের পরে

                             পুচ্ছ নাচাতে

          তুই পথহীন সাগরপারের পান্হ,

          তোর ডানা যে অশান্ত অক্লান্ত,

                অজানা তোর বাসার সন্ধানে রে

                      অবাধ যে তোর ধাওয়া;

                ঝড়ের থেকে বজ্রকে নেয় কেড়ে

                           তোর যে দাবিদাওয়া

 

যৌবন রে, তুই কি কাঙাল, আয়ুর ভিখারী

        মরণ-বনের অন্ধকারে গহন কাঁটাপথে

                              তুই যে শিকারি

         মৃত্যু যে তার পাত্রে বহন করে

         অমৃতরস নিত্য তোমার তরে;

                   বসে আছে মানিনী তোর প্রিয়া

                            মরণ-ঘোমটা টানি

                    সেই আবরণ দেখ্ রে উতারিয়া

                              মুগ্ধ সে মুখখানি

 

যৌবন রে, রয়েছ কোন্ তানের সাধনে

          তোমার বাণী শুষ্ক পাতায় রয় কি কভু বাঁধা

                            পুঁথির বাঁধনে

          তোমার বাণী দখিন হাওয়ার বীণায়

          অরণ্যেরে আপনাকে তার চিনায়,

                   তোমার বাণী জাগে প্রলয়মেঘে

                         ঝড়ের ঝংকারে;

          ঢেউয়ের পরে বাজিয়ে চলে বেগে

                          বিজয়-ডঙ্কা রে

 

যৌবন রে, বন্দী কি তুই আপন গণ্ডিতে

       বয়সের এই মায়াজালের বাঁধনখানা তোরে

                              হবে খণ্ডিতে

       খড়্গসম তোমার দীপ্ত শিখা

       ছিন্ন করুক জরার কুজ্ঝটিকা,

       জীর্ণতারি বক্ষ দু-ফাঁক রে

                       অমর পুষ্প তব

               আলোকপানে লোকে লোকান্তরে

                        ফুটুক নিত্য নব

 

যৌবন রে, তুই কি হবি ধুলায় লুণ্ঠিত

       আবর্জনার বোঝা মাথায় আপন গ্লানিভারে

                                  রইবি কুণ্ঠিত?

       প্রভাত যে তোর সোনার মুকুটখানি

       তোমার তরে প্রত্যুষে দেয় আনি,

              আগুন আছে উর্ধ্ব শিখা জ্বেলে

                       তোমার সে যে কবি

               সূর্য তোমার মুখে নয়ন মেলে

                        দেখে আপন ছবি

                                                   শান্তিনিকেতন

                                                   ৪ চৈত্র ১৩২২

               ৪৫

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি

      ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী

তোমার পথের পরে তপ্ত রৌদ্র এনেছে আহ্বান

               রুদ্রের ভৈরব গান

                   দূর হতে দূরে

                

     বাজে পথ শীর্ণ তীব্র দীর্ঘতান সুরে,

                যেন পথহারা

         কোন্ বৈরাগীর একতারা

 

                 ওরে যাত্রী,

        ধূসর পথের ধুলা সেই তোর ধাত্রী;

চলার অঞ্চলে তোরে ঘূর্ণাপাকে বক্ষেতে  আবরি

             ধরার বন্ধন হতে নিয়ে যাক হরি

                        দিগন্তের পারে দিগন্তরে

          ঘরের মঙ্গলশঙ্খ নহে তোর তরে,

               নহে রে সন্ধ্যার দীপালোক,

               নহে প্রেয়সীর অশ্রু-চোখ

পথে পথে অপেক্ষিছে কালবৈশাখীর আশীর্বাদ,

            শ্রাবণরাত্রির বজ্রনাদ

       পথে পথে কণ্টকের অভ্যর্থনা,

       পথে পথে গুপ্তসর্প গূঢ়ফণা

             নিন্দা দিবে জয়শঙ্খনাদ

             এই তোর রুদ্রের প্রসাদ

 

ক্ষতি এনে দিবে পদে অমূল্য অদৃশ্য উপহার

         চেয়েছিলি অমৃতের অধিকার

সে তো নহে সুখ, ওরে, সে নহে বিশ্রাম,

       নহে শান্তি, নহে সে আরাম

           মৃত্যু তোরে দিবে হানা,

            দ্বারে দ্বারে পাবি মানা,

এই তোর নব বৎসরের আশীর্বাদ,

          এই তোর রুদ্রের প্রসাদ

           ভয় নাই, ভয় নাই, যাত্রী

ঘরছাড়া দিকহারা অলক্ষী তোমার বরদাত্রী

 

পুরাতন বৎসরের জীর্ণক্লান্ত রাত্রি

            ওই কেটে গেল, ওরে যাত্রী

                 এসেছে নিষ্ঠুর,

              হোক রে দ্বারের বন্ধ দূর,

               হোক রে মদের পাত্র চুর

নাই বুঝি, নাই চিনি, নাই তারে জানি,

         ধরো তার পাণি;

ধ্বনিয়া উঠুক তব হৃৎকম্পনে তার দীপ্ত বাণী

                   ওরে যাত্রী

গেছে কেটে, যাক কেটে পুরাতন রাত্রি

 

কলিকাতা

বৈশাখ ১৩২৩