ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি
চতুর্থ
সর্গ নিভৃত যমুনাতীরে বসিয়া রয়েছে কি রে কমলা নীরদ দুই জনে? যেন দোঁহে জ্ঞানহত– নীরব চিত্রের মতো দোঁহে দোঁহা হেরে একমনে। দেখিতে দেখিতে কেন অবশ পাষাণ হেন, চখের পলক নাহি পড়ে। শোণিত না চলে বুকে, কথাটি না ফুটে মুখে, চুলটিও না নড়ে না চড়ে! মুখ ফিরাইল বালা, দেখিল জোছনামালা খসিয়া পড়িছে নীল যমুনার নীরে– অস্ফুট কল্লোলস্বর উঠিছে আকাশ-'পর অর্পিয়া গভীর ভাব রজনী-গভীরে! দেখিছে লুটায় ঢেউ আবার লুটায়, দিগন্তে খেলায়ে পুন দিগন্তে মিলায়! দেখে শূন্য নেত্র তুলি– খণ্ড খণ্ড মেঘগুলি জোছনা মাখিয়া গায়ে উড়ে উড়ে যায়। একখণ্ড উড়ে যায় আর খণ্ড আসে ঢাকিয়া চাঁদের ভাতি মলিন করিয়া রাতি মলিন করিয়া দিয়া সুনীল আকাশে। পাখী এক গেল উড়ে নীল নভোতলে, ফেনখণ্ড গেল ভেসে নীল নদীজলে, দিবা ভাবি অতিদূরে আকাশ সুধায় পূরে ডাকিয়া উঠিল এক প্রমুগ্ধ পাপিয়া। পিউ, পিউ, শূন্যে ছুটে উচ্চ হতে উচ্চে উঠে– আকাশ সে সূক্ষ্ম স্বরে উঠিল কাঁপিয়া। বসিয়া গণিল বালা কত ঢেউ করে খেলা, কত ঢেউ দিগন্তের আকাশে মিলায়, কত ফেন করি খেলা লুটায়ে চুম্বিছে বেলা, আবার তরঙ্গে চড়ি সুদূরে পলায়। দেখি দেখি থাকি থাকি আবার ফিরায়ে আঁখি নীরদের মুখপানে চাহিল সহসা– আধেক মুদিত নেত্র অবশ পলকপত্র– অপূর্ব্ব মধুর ভাবে বালিকা বিবশা! নীরদ ক্ষণেক পরে উঠে চমকিয়া, অপূর্ব্ব স্বপন হতে জাগিল যেন রে। দূরেতে সরিয়া গিয়া থাকিয়া থাকিয়া বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে– "সে কী কথা শুধাইছ বিপিনরমণী! ভালবাসি কিনা আমি তোমারে কমলে? পৃথিবী হাসিয়া যে লো উঠিবে এখনি! কলঙ্ক রমণী নামে রটিবে তা হলে? ও কথা শুধাতে আছে? ও কথা ভাবিতে আছে! ওসব কি স্থান দিতে আছে মনে মনে? বিজয় তোমার স্বামী বিজয়ের পত্মী তুমি সরলে! ও কথা তবে শুধাও কেমনে? তবুও শুধাও যদি দিব না উত্তর!– হৃদয়ে যা লিখা আছে দেখাবো না কারো কাছে, হৃদয়ে লুকান রবে আমরণ কাল! রুদ্ধ অগ্নিরাশিসম দহিবে হৃদয় মম ছিঁড়িয়া খুঁড়িয়া যাবে হৃদিগ্রন্থিজাল। যদি ইচ্ছা হয় তবে লীলা সমাপিয়া ভবে শোণিতধারায় তাহা করিব নির্বাণ। নহে অগ্নিশৈলসম জ্বলিবে হৃদয় মম যত দিন দেহমাঝে রহিবেক প্রাণ! যে তোমারে বন হতে এনেছে উদ্ধারি যাহারে করেছ তুমি পাণি সমর্পণ প্রণয় প্রার্থনা তুমি করিও তাহারি– তারে দিয়ো যাহা তুমি বলিবে আপন! চাই না বাসিতে ভালো, ভালবাসিব না। দেবতার কাছে এই করিব প্রার্থনা– বিবাহ করেছ যারে সুখে থাক লয়ে তারে বিধাতা মিটান তব সুখের কামনা!" "বিবাহ কাহারে বলে জানি না তা আমি" কহিল কমলা তবে বিপিনকামিনী, "কারে বলে পত্মী আর কারে বলে স্বামী, কারে বলে ভালবাসা আজিও শিখি নি। এইটুকু জানি শুধু এইটুকু জানি, দেখিবারে আঁখি মোর ভালবাসে যারে শুনিতে বাসি গো ভাল যার সুধাবাণী– শুনিব তাহার কথা দেখিব তাহারে! ইহাতে পৃথিবী যদি কলঙ্ক রটায় ইহাতে হাসিয়া যদি উঠে সব ধরা বল গো নীরদ আমি কি করিব তার? রটায়ে কলঙ্ক তবে হাসুক না তারা। বিবাহ কাহারে বলে জানিতে চাহি না– তাহারে বাসিব ভাল, ভালবাসি যারে! তাহারই ভালবাসা করিব কামনা যে মোরে বাসে না ভাল, ভালবাসি যারে।" নীরদ অবাক রহি কিছুক্ষণ পরে বালিকারে সম্বোধিয়া কহে মৃদুস্বরে, "সে কী কথা বল বালা, যে জন তোমারে বিজন কানন হতে করিয়া উদ্ধার আনিল, রাখিল যত্নে সুখের আগারে– সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার? হৃদয় সঁপেছে যে লো তোমারে নবীনা সে কেন গো ভালবাসা পাবে না তোমার?" কমলা কহিল ধীরে, "আমি তা জানি না"। নীরদ সমুচ্চ স্বরে কহিল আবার– "তবে যা লো দুশ্চারিণী! যেথা ইচ্ছা তোর কর্ তাই যাহা তোর কহিবে হৃদয়– কিন্তু যত দিন দেহে প্রাণ রবে মোর– তোর এ প্রণয়ে আমি দিব না প্রশ্রয়! আর তুই পাইবি না দেখিতে আমারে জ্বলিব যদিন আমি জীবন-অনলে– স্বরগে বাসিব ভাল যা খুসী যাহারে প্রণয়ে সেথায় যদি পাপ নাহি বলে! কেন বল্ পাগলিনী! ভালবাসি মোরে অনলে জ্বালিতে চাস্ এ জীবন ভোরে! বিধাতা যে কি আমার লিখেছে কপালে! যে গাছে রোপিতে যাই শুকায় সমূলে।" ভর্ৎসনা করিবে ছিল নীরদের মনে– আদরেতে স্বর কিন্তু হয়ে এল নত! কমলা নয়নজল ভরিয়া নয়নে মুখপানে চাহি রয় পাগলের মতো! নীরদ উদ্গামী অশ্রু করি নিবারিত সবেগে সেখান হতে করিল প্রয়াণ। উচ্ছ্বাসে কমলা বালা উন্মত্ত চিত অঞ্চল করিয়া সিক্ত মুছিল নয়ান। |