ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
২
সখীদের গান
যাও, যাও যদি যাও তবে—
তোমায় ফিরিতে হবে—
হবে হবে।
ব্যর্থ চোখের জলে
আমি লুটাব না ধূলিতলে, লুটাব না।
বাতি নিবায়ে যাব না, যাব না, যাব না
জীবনের উৎসবে।
মোর সাধনা ভীরু নহে,
শক্তি আমার হবে মুক্ত দ্বার যদি রুদ্ধ রহে।
বিমুখ মুহূর্তেরে করি না ভয়—
হবে জয়, হবে জয়, হবে জয়,
দিনে দিনে হৃদয়ের গ্রন্থি তব
খুলিব প্রেমের গৌরবে॥
চিত্রাঙ্গদা। ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে শুনি
অতল জলের অহ্বান।
মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে,
মন রয় না—
চঞ্চল প্রাণ।
ভাসায়ে দিব আপনারে ভরা জোয়ারে,
সকল-ভাবনা-ডুবানো ধারায় করিব স্নান।
ব্যর্থ বাসনার দাহ হবে নির্বাণ।
ঢেউ দিয়েছে জলে—
ঢেউ দিল, ঢেউ দিল, ঢেউ দিল আমার মর্মতলে।
একি ব্যাকুলতা আজি আকাশে, এই বাতাসে
যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয় করে রোমাঞ্চ দান।
দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে গুঞ্জরতান
সখীদের প্রতি
দে তোরা আমায় নূতন ক’রে দে নূতন আভরণে।
হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি—
বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন নবলাবণ্যধনে।
শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক পল্লব-আবরণে।
সখীগণ। বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে
পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে
চিরসুন্দরের অভিবন্দনা।
আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক
হিল্লোলে হিল্লোলে,
যৌবন পাক্ সম্মান বাঞ্ছিতসম্মিলনে॥
সকলের প্রস্থান
অর্জুনের প্রবেশ ও ধ্যানে উপবেশন
তাঁকে প্রদক্ষিণ ক’রে চিত্রাঙ্গদার নৃত্য
চিত্রাঙ্গদা। আমি তোমারে করিব নিবেদন
আমার হৃদয় প্রাণ মন॥
অর্জুন। ক্ষমা করো আমায়— আমায়—
বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে— ব্রহ্মচারী ব্রতধারী॥
প্রস্থান
চিত্রাঙ্গদা। হায় হায়, নারীরে করেছি ব্যর্থ
দীর্ঘকাল জীবনে আমার।
ধিক্ ধনুঃশর!
ধিক্ বাহুবল!
মুহূর্তের অশ্রুবন্যাবেগে
ভাসায়ে দিল যে মোর পৌরুষসাধনা।
অকৃতার্থ যৌবনের দীর্ঘশ্বাসে
বসন্তেরে করিল ব্যাকুল—
———
রোদন-ভরা এ বসন্ত, সখী,
কখনো আসে নি বুঝি আগে।
মোর বিরহবেদনা রাঙালো কিংশুকরক্তিমরাগে।
সখীগণ। তোমার বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা,
কখন বাদল আনে আষাঢ়ের পালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা
সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা,
সারা দিন-রজনী অনিমিখা
কার পথ চেয়ে জাগে।
সখীগণ। কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল,
সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। দক্ষিণসমীরে দূর গগণে
একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো।
কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত
আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।
সখীগণ। মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে
মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে
ব্যাকুল কর হানি বারে বারে,
দেওয়া হল না যে আপনারে
এই ব্যথা মনে লাগে।
সখীগণ। যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে
কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা।
হায় হায় হায়॥
একজন সখী। ব্রহ্মচর্য!— পুরুষের স্পর্ধা এ যে!
নারীর এ পরাভবে
লজ্জা পাবে বিশ্বের রমণী।
পঞ্চশর, তোমারি এ পরাজয়।
জাগো হে অতনু,
সখীরে বিজয়দূতী করো তব,
নিরস্ত্র নারীর অস্ত্র দাও তারে—
দাও তারে অবলার বল॥
মদনকে চিত্রাঙ্গদার পূজানিবেদন
চিত্রাঙ্গদা। আমার এই রিক্ত ডালি
দিব তোমারি পায়ে।
দিব কাঙালিনীর আঁচল
তোমার পথে পথে, পথে বিছায়ে।
যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু
তারি ফুলে ফুলে, হে অতনু, তারি ফুলে
আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য
দিয়ো দিয়ো দিয়ো ঘুচায়ে।
তোমার রণজয়ের অভিযানে
তুমি আমায় নিয়ো,
ফুলবাণের টিকা আমার ভালে
এঁকে দিয়ো দিয়ো—
রণজয়ের অভিযানে।
আমার শূন্যতা দাও যদি
সুধায় ভরি
দিব তোমার জয়ধ্বনি
ঘোষণ করি— জয়ধ্বনি—
ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও
আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে॥
মদনের প্রবেশ
মদন। মণিপুরনৃপদুহিতা
তোমারে চিনি তাপসিনী!
মোর পূজায় তব ছিল না মন,
তবে কেন অকারণ
তুমি মোর দ্বারে এলে তরুণী,
কহো কহো শুনি তাপসিনী!
চিত্রাঙ্গদা। পুরুষের বিদ্যা করেছিনু শিক্ষা,
লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা—
কুসুমধনু,
অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু।
অর্জুন ব্রহ্মচারী
মোর মুখে হেরিল না নারী,
ফিরাইল, গেল ফিরে।
দয়া করো অভাগীরে—
শুধু এক বরষের জন্যে
পুষ্পলাবণ্যে
মোর দেহ পাক্ তব স্বর্গের মূল্য
মর্তে অতুল্য॥
মদন। তাই আমি দিনু বর,
কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর,
মম পঞ্চম শর—
দিবে মন মোহি,
নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসীরে
পাবে অচিরে—
বন্দী করিবে ভুজপাশে
বিদ্রূপহাসে।
মণিপুররাজকন্যা
কান্তহৃদয়বিজয়ে হবে ধন্যা॥