ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৩
নূতনরূপপ্রাপ্ত চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা। এ কী দেখি!
এ কে এল মোর দেহে
পূর্ব-ইতিহাস-হারা!
আমি কোন্ গত জনমের স্বপ্ন!
বিশ্বের অপরিচিত আমি!
আমি নহি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা—
আমি শুধু এক রাত্রে ফোটা
অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল—
এক প্রভাতের শুধু পরমায়ু,
তার পরে ধূলিশয্যা.
তার পরে ধরণীর চির-অবহেলা॥
সরোবরতীরে
আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়, বাজায় বাঁশি।
আনন্দে বিষাদে মন উদাসী
পুষ্পবিকাশের সুরে দেহ মন উঠে পূরে,
কী মাধুরীসুগন্ধ বাতাসে যায় ভাসি।
সহসা মনে জাগে আশা,
মোর আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা।
আজ মম রূপে বেশে লিপি লিখি কার উদ্দেশে,
এল মর্মের বন্দিনী বাণী বন্ধন নাশি।।
———
মীনকেতু,
কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি।
এ মায়ালাবণ্য মোর কী অভিসম্পাত! ক্ষণিক যৌবনবন্যা
রক্তস্রোতে তরঙ্গিয়া উন্মাদ করেছে মোরে।।
নূতন কান্তির উত্তেজনায় নৃত্য
স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা,
জাগায় দেহে মনে এ কি বিপুল ব্যথা।
বহে মম শিরে শিরে এ কী দাহ, কী প্রবাহ—
চকিতে সর্বদেহে ছুটে তড়িৎলতা।
ঝড়ের পবনগর্জে হারাই আপনায়,
দুরন্ত যৌবনক্ষুব্ধ অশান্ত বন্যায়।
তরঙ্গ উঠে প্রাণে দিগন্তে কাহার পানে,
ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে— নাহি নাহি কথা॥
———
এরে ক্ষমা কোরো সখা—
এ যে এল তব আঁখি ভুলাতে,
শুধু ক্ষণকালতরে মোহ-দোলায় দুলাতে
আঁখি ভুলাতে।
মায়াপুরী হতে এল নাবি—
নিয়ে এল স্বপ্নের চাবি,
তব কঠিন হৃদয়দুয়ার খুলাতে,
আঁখি ভুলাতে॥
প্রস্থান
অর্জুনের প্রবেশ
অর্জুন। কাহারে হেরিলাম! আহা!
সে কি সত্য, সে কি মায়া!
সে কি কায়া,
সে কি সুবর্ণকিরণে-রঞ্জিত ছায়া!
চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ
এসো এসো যে হও সে হও,
বলো বলো তুমি স্বপন নও, নও স্বপন নও।
অনিন্দ্যসুন্দর দেহলতা
বহে সকল আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা॥
চিত্রাঙ্গদা। তুমি অতিথি, অতিথি আমার।
বলো কোন নামে করি সৎকার॥
অর্জুন। পাণ্ডব আমি অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা নৃপতিকন্যা!
লহো মোর খ্যাতি,
লহো মোর কীর্তি
লহো পৌরুষগর্ব।
লহো আমার সর্ব॥
চিত্রাঙ্গদা। কোন্ ছলনা এ যে নিয়েছে আকার,
এর কাছে মানিবে কি হার।
ধিক্ ধিক্ ধিক্ ॥
বীর তুমি বিশ্বজয়ী,
নারী এ যে মায়াময়ী—
পিঞ্জর রচিবে কি এ মরীচিকার।
ধিক্ ধিক্ ধিক্॥
লজ্জা, লজ্জা, হায় একি লজ্জা,
মিথ্যা রূপ মোর, মিথ্যা সজ্জা।
এ যে মিছে স্বপ্নের স্বর্গ,
এ যে শুধু ক্ষণিকের অর্ঘ্য,
এই কি তোমার উপহার
ধিক্ ধিক্ ধিক্॥
অর্জুন। হে সুন্দরী, উন্মথিত যৌবন আমার
সন্ন্যাসীর ব্রতবন্ধ দিল ছিন্ন করি।
পৌরুষের সে অধৈর্য
তাহারে গৌরব মানি আমি—
আমি তো আচারভীরু নারী নহি
শাস্ত্রবাক্যে-বাঁধা।
এসো সখী, দুঃসাহসী প্রেম
বহন করুক আমাদের
অজানার পথে॥
চিত্রাঙ্গদা। তবে তাই হোক
কিন্তু মনে রেখো,
কিংশুকদলের প্রান্তে এই-যে দুলিছে
একটু শিশির— তুমি যারে করিছ কামনা
সে এমনি শিশিরের কণা
নিমিষের সোহাগিনী॥
———
কোন্ দেবতা সে কী পরিহাসে ভাসালো মায়ার ভেলায়।
স্বপ্নের সাথি, এসো মোরা মাতি স্বর্গের কৌতুকখেলায়।
সুরের প্রবাহে হাসির তরঙ্গে
বাতাসে বাতাসে ভেসে যাব রঙ্গে নৃত্যবিভঙ্গে,
মাধবীবনের মধুগন্ধে মোদিত মোহিত মন্থর বেলায়।
যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি রোমাঞ্চিত বক্ষতলে,
মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া মোহের মদির জলে।
নবোদিত সূর্যের করসম্পাতে
বিকল হবে হায় লজ্জা-আঘাতে,
দিন গত হলে নূতন প্রভাতে
মিলাবে ধুলার তলে কার অবহেলায়॥
অর্জুন। আজ মোরে
সপ্তলোক স্বপ্ন মনে হয়।
শুধু একা পূর্ণ তুমি,
সর্ব তুমি,
বিশ্ববিধাতার গর্ব তুমি,
অক্ষয় ঐশ্বর্য তুমি,
এক নারী —সকল দৈন্যের তুমি মহা অবসান—
সব সাধনার তুমি শেষ পরিণাম॥
চিত্রাঙ্গদা। সে আমি যে আমি নই, আমি নই—
হায় পার্থ, হায়,
সে যে কোন্ দেবের ছলনা।
যাও যাও ফিরে যাও, ফিরে যাও বীর।
শৌর্য বীর্য মহত্ব তোমার
দিয়ো না মিথ্যার পায়ে—
যাও যাও ফিরে যাও॥
প্রস্থান
অর্জুন। এ কী তৃষ্ণা, এ কী দাহ!
এ যে অগ্নিলতা পাকে পাকে
ঘেরিয়াছে তৃষ্ণার্ত কম্পিত প্রাণ।
উত্তপ্ত হৃদয়
ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া॥
———
অশান্তি আজ হানল একি দহনজ্বালা!
বিঁধল হৃদয় নিদয় বাণে বেদন-ঢালা।
বক্ষে জ্বালায় অগ্নিশিখা,
চক্ষে কাঁপায় মরীচিকা,
মরণ-সুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা।
চেনা ভুবন হারিয়ে গেল স্বপন-ছায়াতে,
ফাল্গুন-দিনের পলাশ-রঙের রঙিন মায়াতে।
যাত্রা আমার নিরুদ্দেশা—
পথ-হারানোর লাগল নেশা,
অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা॥