ভাষাংশ
রবীন্দ্রনাথ
ঠাকুর
-এর
রচনাবলী
রচনাবলী সূচি
৪
মদন ও চিত্রাঙ্গদা
চিত্রাঙ্গদা। ভস্মে ঢাকে ক্লান্ত হুতাশন—
এ খেলা খেলাবে, হে ভগবন্, আর কতখন।
এ খেলা খেলাবে আর কতখন।
শেষ যাহা হবেই হবে, তারে
সহজে হতে দাও শেষ।
সুন্দর যাক রেখে স্বপ্নের রেশ।
জীর্ণ কোরো না, কোরো না, যা ছিল নূতন॥
মদন। না না না সখী, ভয় নেই সখী, ভয় নেই—
ফুল যবে সাঙ্গ করে খেলা
ফল ধরে সেই।
হর্ষ-অচেতন বর্ষ
রেখে যাক মন্ত্রস্পর্শ
নবতর ছন্দস্পন্দন॥
প্রস্থান
অর্জুন ও চিত্রাঙ্গদা
কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে—
নয়নে, নয়নে।
দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে
কে দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে
নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে মোদের মিলিত নয়নে—
নয়নে, নয়নে।
বাহির-আকাশে মেঘ ঘিরে আসে, এল সব তারা ঢাকিতে।
হারানো সে আলো আসন বিছালো শুধু দুজনের আঁখিতে—
আঁখিতে, আঁখিতে।
ভাষাহারা মম বিজন রোদনা
প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা,
চিরজীবনের বাণীর বেদনা মিটিল দোঁহার নয়নে—
নয়নে, নয়নে॥
প্রস্থান
অর্জুনের প্রবেশ
অর্জুন কেন রে ক্লান্তি আসে আবেশভার বহিয়া,
দেহ মন প্রাণ দিবানিশি জীর্ণ অবসাদে কেন রে।
ছিন্ন কর্মহারা কারাগারে রয়েছে কোন্ পরমাদে।
এই কর্মহারা কারাগারে রয়েছ কোন্ পরমাদে।
কেন রে॥
গ্রামবাসীগণের প্রবেশ
গ্রামবাসীগণ হো, এল এল এল রে দস্যুর দল,
গর্জিয়ানামে যেন বন্যার জল- এল এল।
চল্ তোরা পঞ্চগ্রামী,
চল তোরা কলিঙ্গধামী,
মল্লপল্লী হতে চল্, চল্।
‘জয় চিত্রাঙ্গদা’ বল্, বল্ বল্ ভাই রে-
ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে।
অর্জুন। জনপদবাসী, শোনো শোনো,
রক্ষক তোমাদের নাই কোন?
গ্রামবাসীগণ। তীর্থে গেছেন কোথা তিনি
গোপনব্রতধারিণী,
চিত্রাঙ্গদা তিনি রাজকুমারী।
অর্জুন। নারী! তিনি নারী!
গ্রামবাসীগণ। স্নেহবলে তিনি মাতা, বাহুবলে তিনি রাজা।
তাঁর নামে ভেরী বাজা,
‘জয় জয় জয়’ বলো ভাই রে—
ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে॥
------
সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ- আ! আহা!
মুক্ত করো ভয়,
আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়- আ! আহা!
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,
নিজের 'পরে করিতে ভর না রেখো সংশয়- আ! আহা!
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়,
দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়-আ! আহা॥
প্রস্থান
চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ
চিত্রাঙ্গদা। কী ভাবিছ নাথ, কী ভাবিছ॥
অর্জুন। চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী।
কেমন না জানি
আমি তাই ভাবি মনে মনে।
শুনি বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী।
জান যদি বলো প্রিয়ে, বলো তার কথা॥
চিত্রাঙ্গদা। ছি ছি, কুৎসিত কুরূপ সে।
হেন বঙ্কিম ভুরুযুগ নাহি তার,
হেন উজ্জ্বলকজ্জল আঁখিতারা।
সন্ধিতে পারে লক্ষ্য কিণাঙ্কিত তার বাহু,
বিঁধিতে পারে না বীরবক্ষ কুটিল কটাক্ষশরে।
নাহি লজ্জা, নাহি শঙ্কা, নাহি নিষ্ঠুরসুন্দর রঙ্গ,
নাহি নীরব ভঙ্গীর সঙ্গীতলীলা ইঙ্গিতছন্দোমধুর॥
অর্জুন। আগ্রহ মোর অধীর অতি—
কোথা সে রমণী বীর্যবতী।
কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা—
দারুণ সে, সুন্দর সে
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে—
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা॥
সখীগণ। নারীর ললিত লোভন লীলায় এখনি কেন এ ক্লান্তি।
এখনি কি, সখা, খেলা হল অবসান।
যে মধুর রসে ছিলে বিহ্বল
সে কি মধুমাখা ভ্রান্তি—
সে কি স্বপ্নের দান,
সে কি সত্যের অপমান।
দূর দুরাশায় হৃদয় ভরিছ,
কঠিন প্রেমের প্রতিমা গড়িছ,
কী মনে ভাবিয়া নারীতে করিছ পৌরুষসন্ধান।
এও কি মায়ার দান।
সহসা মন্ত্রবলে
নমনীয় এই কমনীয়তারে
যদি আমাদের সখী একেবারে
পরের বসন-সমান ছিন্ন করি ফেলে ধূলিতলে,
সবে না সবে না সে নৈরাশ্য—
ভাগ্যের সেই অট্টহাস্য
জানি জানি, সখা, ক্ষুব্ধ করিবে লুব্ধ পুরুষপ্রাণ—
হানিবে নিঠুর বাণ॥
অর্জুন। যদি মিলে দেখা তবে তারি সাথে
ছুটে যাব আমি আর্তত্রাণে।
ভোগের আবেশ হতে
ঝাঁপ দিব যুদ্ধস্রোতে।
আজি মোর চঞ্চল রক্তের মাঝে
ঝন নন ঝন নন ঝঞ্ঝনা বাজে- বাজে –বাজে।
চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী
একাধারে মিলিত পুরুষ নারী।।
চিত্রাঙ্গদা। ভাগ্যবতী সে যে,
এত দিনে তার আহ্বান এল তব বীরের প্রাণে।
আজ অমাবস্যার রাতি হোক অবসান।
কাল শুভ শুভ্র প্রাতে দর্শন মিলিবে তার,
মিথ্যায় আবৃত নারী ঘুচাবে মায়া-অবগুণ্ঠন॥
অর্জুনের প্রতি
সখী। রমণীর মন-ভোলাবার ছলাকলা
দূর ক’রে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী
সরল উন্নত বীর্যবন্ত অন্তরের বলে
পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরু সম—
যেন সে সম্মান পায় পুরুষের।
রজনীর নর্মসহচরী
যেন হয় পুরুষের কর্মসহচরী,
যেন বামহস্তসম দক্ষিণহস্তের থাকে সহকারী।
তাহে যেন পুরুষের তৃপ্তি হয় বীরোত্তম॥