ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল
 

প্রাণ | পুরাতন | নূতন | উপকথা | যোগিয়া | কাঙালিনী |  ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি |


 

কবির মন্তব্য
 

যৌবন হচ্ছে জীবনে সেই ঋতুপরিবর্তনের সময় যখন ফুল ও ফসলের প্রচ্ছন্ন প্রেরণা নানা বর্ণে ও রূপে অকস্মাৎ বাহিরে প্রত্যক্ষ হয়ে ওঠে। কড়ি ও কোমল আমার সেই নবযৌবনের রচনা। আত্মপ্রকাশের একটা প্রবল আবেগ তখন যেন প্রথম উপলব্ধি করেছিলুম। মনে পড়ে তখনকার দিনে নিজের মনের একটা উদ্‌বেল অবস্থা। তখন আমার বেশভূষায় আবরণ ছিল বিরল। গায়ে থাকত ধুতির সঙ্গে কেবল একটা পাতলা চাদর, তার খুঁটোয় বাঁধা ভোরবেলায় তোলা একমুঠো বেলফুল, পায়ে একজোড়া চটি। মনে আছে থ্যাকারের দোকানে বই কিনতে গেছি কিন্তু এর বেশি পরিচ্ছন্নতা নেই, এতে ইংরেজ দোকানদারের স্বীকৃত আদবকায়দার প্রতি উপেক্ষা প্রকাশ হত। এই আত্মবিস্মৃত বেআইনী প্রমত্ততা কড়ি ও কোমলের কবিতায় অবাধে প্রকাশ পেয়েছিল। এই প্রসঙ্গে একটা কথা মনে রাখতে হবে এই রীতির কবিতা তখনো প্রচলিত ছিল না। সেইজন্যেই কাব্যবিশারদ প্রভৃতি সাহিত্যবিচারকদের কাছ থেকে কটুভাষায় ভর্ৎসনা সহ্য করেছিলুম। সে-সব যে উপেক্ষা করেছি অনায়াসে সে কেবল যৌবনের তেজে। আপনার মধ্যে থেকে যা প্রকাশ পাচ্ছিল, সে আমার কাছেও ছিল নূতন এবং আন্তরিক। তখন হেম বাঁড়ুজ্জে এবং নবীন সেন ছাড়া এমন কোনো দেশপ্রসিদ্ধ কবি ছিলেন না যাঁরা নূতন কবিদের কোনো-একটা কাব্যরীতির বাঁধা পথে চালনা করতে পারতেন। কিন্তু আমি তাঁদের সম্পূর্ণই ভুলে ছিলুম। আমাদের পরিবারের বন্ধু কবি বিহারীলালকে ছেলেবেলা থেকে জানতুম এবং তাঁর কবিতার প্রতি অনুরাগ আমার ছিল অভ্যস্ত। তাঁর প্রবর্তিত কবিতার রীতি ইতিপূর্বেই আমার রচনা থেকে সম্পূর্ণ স্খলিত হয়ে গিয়েছিল। বড়োদাদার স্বপ্নপ্রয়াণের আমি ছিলুম অত্যন্ত ভক্ত, কিন্তু তাঁর বিশেষ কবিপ্রকৃতির সঙ্গে আমার বোধ হয় মিল ছিল না, সেইজন্য ভালোলাগা সত্ত্বেও তাঁর প্রভাব আমার কবিতা গ্রহণ করতে পারে নি। তাই কড়ি ও কোমলের কবিতা মনের অন্তঃস্তরের উৎসের থেকে উছলে উঠেছিল। তার সঙ্গে বাহিরের কোনো মিশ্রণ যদি ঘটে থাকে তো সে গৌণভাবে।

এই আমার প্রথম কবিতার বই যার মধ্যে বিষয়ের বৈচিত্র্য এবং বহির্দৃষ্টিপ্রবণতা দেখা দিয়েছে। আর প্রথম আমি সেই কথা বলেছি যা পরবর্তী আমার কাব্যের অন্তরে অন্তরে বারবার প্রবাহিত হয়েছে
                            মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
                            মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই  
যা নৈবেদ্যে আর-এক ভাবে প্রকাশ পেয়েছে
                            বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নয়।

কড়ি ও কোমলের যৌবনের রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গে আর-একটি প্রবল প্রবর্তনা প্রথম আমার কাব্যকে অধিকার করেছে, সে জীবনের পথে মৃত্যুর আবির্ভাব। যাঁরা আমার কাব্য মন দিয়ে পড়েছেন তাঁরা নিশ্চয় লক্ষ্য করে থাকবেন এই মৃত্যুর নিবিড় উপলব্ধি আমার কাব্যের এমন একটি বিশেষ ধারা, নানা বাণীতে যার প্রকাশ। কড়ি ও কোমলেই তার প্রথম উদ্ভব।


 


 

           প্রাণ

মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে,
মানবের মাঝে আমি বাঁচিবারে চাই।
এই সূর্যকরে এই পুষ্পিত কাননে
জীবন্ত হৃদয়-মাঝে যদি স্থান পাই।
ধরায় প্রাণের খেলা চিরতরঙ্গিত,
বিরহ মিলন কত হাসি-অশ্রু-ময়,
মানবের সুখে দুঃখে গাঁথিয়া সংগীত
যদি গো রচিতে পারি অমর-আলয়।
তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল
তোমাদেরি মাঝখানে লভি যেন ঠাঁই,
তোমরা তুলিবে বলে সকাল বিকাল
নব নব সংগীতের কুসুম ফুটাই।
হাসিমুখে নিয়ো ফুল, তার পরে হায়
ফেলে দিয়ো ফুল, যদি সে ফুল শুকায়।

                  পুরাতন
          হেথা হতে যাও, পুরাতন
!
      হেথায় নূতন খেলা আরম্ভ হয়েছে।
আবার বাজিছে বাঁশি,  
          আবার উঠিছে হাসি,
          বসন্তের বাতাস বয়েছে।
সুনীল আকাশ -'পরে             শুভ্র মেঘ থরে থরে
          শ্রান্ত যেন রবির আলোকে,
পাখিরা ঝাড়িছে পাখা,          কাঁপিছে তরুর শাখা,
          খেলাইছে বালিকা বালকে।
সমুখের সরোবরে                আলো ঝিকিমিকি করে,
          ছায়া কাঁপিতেছে থরথর,
জলের পানেতে চেয়ে           ঘাটে বসে আছে মেয়ে,
          শুনিছে পাতার মরমর।
কী জানি কত কী আশে         চলিয়াছে চারি পাশে
           কত লোক কত সুখে দুখে,
সবাই তো ভুলে আছে,          কেহ হাসে কেহ নাচে,
          তুমি কেন দাঁড়াও সমুখে।
বাতাস যেতেছে বহি,            তুমি কেন রহি রহি
          তারি মাঝে ফেল দীর্ঘশ্বাস।
সুদূরে বাজিছে বাঁশি,             তুমি কেন ঢাল আসি
          তারি মাঝে বিলাপ-উচ্ছ্বাস।
উঠেছে প্রভাতরবি,              আঁকিছে সোনার ছবি,
          তুমি কেন ফেল তাহে ছায়া।
বারেক যে চলে যায়             তারে তো কেহ না চায়,
          তবু তার কেন এত মায়া।
তবু কেন সন্ধ্যাকালে             জলদের অন্তরালে
          লুকায়ে ধরার পানে চায় —
নিশীথের অন্ধকারে                 পুরানো ঘরের দ্বারে
          কেন এসে পুন ফিরে যায় ।
কী দেখিতে আসিয়াছ            যাহা কিছু ফেলে গেছ
          কে তাদের করিবে যতন !
স্মরণের চিহ্ন যত                 ছিল পড়ে দিন - কত
          ঝরে - পড়া পাতার মতন
আজি বসন্তের বায়               একেকটি করে হায়
          উড়ায়ে ফেলিছে প্রতিদিন
 
ধূলিতে মাটিতে রহি              হাসির কিরণে দহি
          ক্ষণে ক্ষণে হতেছে মলিন।
ঢাকো তবে ঢাকো মুখ,          নিয়ে যাও দুঃখ সুখ,
          চেয়ো না চেয়ো না ফিরে ফিরে।
হেথায় আলয় নাহি,              অনন্তের পানে চাহি
          আঁধারে মিলাও ধীরে ধীরে।

              
নূতন
           হেথাও তো পশে সূর্যকর।
ঘোর ঝটিকার রাতে
          দারুণ অশনিপাতে
           বিদীরিল যে গিরিশিখর

বিশাল পর্বত কেটে 
         পাষাণহৃদয় ফেটে,
           প্রকাশিল যে ঘোর গহ্বর

প্রভাতে পুলকে ভাসি
        বহিয়া নবীন হাসি,
           হেথাও তো পশে সূর্যকর !
দুয়ারেতে উঁকি মেরে
        ফিরে তো যায় না সে রে,
           শিহরি উঠে না আশঙ্কায়,
ভাঙা পাষাণের বুকে
        খেলা করে কোন্‌ সুখে,
           হেসে আসে, হেসে চলে যায়।
হেরো হেরো হায় হায়,
      যত প্রতিদিন যায়

          কে গাঁথিয়া দেয় তৃণজাল।
লতাগুলি লতাইয়া
           বাহুগুলি বিথাইয়া
          ঢেকে ফেলে বিদীর্ণ কঙ্কাল।
বজ্রদগ্ধ অতীতের
           নিরাশার অতিথের
          ঘোর স্তব্ধ সমাধি-আবাস,
ফুল এসে, পাতা এসে
     কেড়ে নেয় হেসে হেসে,
          অন্ধকারে করে পরিহাস।
এরা সব কোথা ছিল,
      কেই বা সংবাদ দিল,
          গৃহহারা আনন্দের দল

বিশ্বে তিল শূন্য হলে
      অনাহূত আসে চলে ,
          বাসা বাঁধে করি কোলাহল।
আনে হাসি, আনে গান,
  আনে রে নূতন প্রাণ,
         সঙ্গে করে আনে রবিকর

অশোক শিশুর প্রায়
      এত হাসে এত গায়
         কাঁদিতে দেয় না অবসর।
বিষাদ বিশালকায়া
      ফেলেছে আঁধার ছায়া,
         তারে এরা করে না তো ভয়

চারিদিক হতে তারে
     ছোটো ছোটো হাসি মারে,
        অবশেষে করে পরাজয়।
এই যে রে মরুস্থল,
      দাবদগ্ধ ধরাতল,
        এইখানে ছিল 'পুরাতন'
 
একদিন ছিল তার
       শ্যামল যৌবনভার,
         ছিল তার দক্ষিণপবন।
যদি রে সে চলে গেল,
  সঙ্গে যদি নিয়ে গেল
         গীত গান হাসি ফুল ফল

শুষ্ক স্মৃতি কেন মিছে
   রেখে তবে গেল পিছে,
         শুষ্ক শাখা শুষ্ক ফুলদল।
সে কি চায় শুষ্ক বনে
    গাহিবে বিহঙ্গগণে
        আগে তারা গাহিত যেমন।
আগেকার মতো করে
    স্নেহে তার নাম ধরে
         উচ্ছ্বসিবে বসন্তপবন ?
নহে নহে, সে কি হয় !
   সংসার জীবনময়,
          নাহি হেথা মরণের স্থান ।
আয় রে, নূতন, আয়,
     সঙ্গে করে নিয়ে আয়,
         তোর সুখ, তোর হাসি গান।
ফোটা নব ফুলচয়,
      ওঠা নব কিশলয়,
         নবীন বসন্ত আয় নিয়ে।
যে যায় সে চলে যাক,
   সব তার নিয়ে যাক,
         নাম তার যাক মুছে দিয়ে।
এ কি ঢেউ-খেলা হায়,
   এক আসে, আর যায়,
         কাঁদিতে কাঁদিতে আসে হাসি,
বিলাপের শেষ তান
      না হইতে অবসান
         কোথা হতে বেজে ওঠে বাঁশি।
আয় রে কাঁদিয়া লই
,     শুকাবে দু-দিন বই
         এ পবিত্র অশ্রুবারিধারা।
সংসারে ফিরিব ভুলি,
   ছোটো ছোটো সুখগুলি
         রচি দিবে আনন্দের কারা।
না রে, করিব না শোক,
 এসেছে নূতন লোক,
         তারে কে করিবে অবহেলা।
সেও চলে যাবে কবে,
   গীত গান সাঙ্গ হবে,
        ফুরাইবে দু-দিনের খেলা।

                  
উপকথা
      মেঘের আড়ালে বেলা কখন যে যায়।
      বৃষ্টি পড়ে সারাদিন থামিতে না চায় ।
আর্দ্র-পাখা পাখিগুলি               গীতগান গেছে ভুলি,
          নিস্তব্ধে ভিজিছে তরুলতা।
বসিয়া আঁধার ঘরে                 বরষার ঝরঝরে
          মনে পড়ে কত উপকথা।
কভু মনে লয় হেন                   এ-সব কাহিনী যেন
          সত্য ছিল নবীন জগতে।
উড়ন্ত মেঘের মতো                 ঘটনা ঘটিত কত,
          সংসার উড়িত মনোরথে।
রাজপুত্র অবহেলে                   কোন্‌ দেশে যেত চলে
          কত নদী কত সিন্ধু-পার।
সরোবর-ঘাট আলা,                 মণি হাতে নাগবালা
          বসিয়া বাঁধিত কেশভার।
সিন্ধুতীরে কত দূরে                কোন্‌ রাক্ষসের পুরে
          ঘুমাইত রাজার ঝিয়ারি।
হাসি তার মণিকণা                 কেহ তাহা দেখিত না,
          মুকুতা ঢালিত অশ্রুবারি।
সাত ভাই একত্তরে                  চাঁপা হয়ে ফুটিত রে,
          এক বোন ফুটিত পারুল।
সম্ভব কি অসম্ভব                   একত্রে আছিল সব

          দুটি ভাই সত্য আর ভুল।
বিশ্ব নাহি ছিল বাঁধা,                না ছিল কঠিন বাধা,
          নাহি ছিল বিধির বিধান,
হাসিকান্না লঘুকায়া                  শরতের আলোছায়া,
          কেবল সে ছুঁয়ে যেত প্রাণ !
আজি ফুরায়েছে বেলা ,            জগতের ছেলেখেলা
          গেছে আলো-আঁধারের দিন।
আর তো নাই রে ছুটি ,            মেঘরাজ্য গেছে টুটি,
          পদে পদে নিয়ম-অধীন।
মধ্যাহ্নে রবির দাপে               বাহিরে কে রবে তাপে,
          আলয় গড়িতে সবে চায়।
যবে হায় প্রাণপণ                   করে তাহা সমাপন
          খেলারই মতন ভেঙে যায়।


                
যোগিয়া
       বহুদিন পরে আজি মেঘ গেছে চলে,
       রবির কিরণসুধা আকাশে উথলে।
স্নিগ্ধ শ্যাম পত্রপুটে               আলোক ঝলকি উঠে
           পুলক নাচিছে গাছে গাছে।
নবীন যৌবন যেন                প্রেমের মিলনে কাঁপে,
           আনন্দ বিদ্যুৎ-আলো নাচে।
জুঁই সরোবরতীরে                নিশ্বাস ফেলিয়া ধীরে
           ঝরিয়া পড়িতে চায় ভুঁয়ে,
অতি মৃদু হাসি তার,             বরষার বৃষ্টিধার
           গন্ধটুকু নিয়ে গেছে ধুয়ে।
আজিকে আপন প্রাণে           না জানি বা কোন্‌খানে
           যোগিয়া রাগিণী গায় কে রে।
ধীরে ধীরে সুর তার             মিলাইছে চারি ধার,
           আচ্ছন্ন করিছে প্রভাতেরে।
গাছপালা চারিভিতে            সংগীতের মাধুরীতে
           মগ্ন হয়ে ধরে স্বপ্নছবি।
এ প্রভাত মনে হয়             আরেক প্রভাতময়,
           রবি যেন আর কোনো রবি।
ভাবিতেছি মনে মনে           কোথা কোন্‌ উপবনে
           কী ভাবে সে গান গাইছে না জানি,
চোখে তার অশ্রুরেখা          একটু দেছে কি দেখা,
           ছড়ায়েছে চরণ দুখানি।
তার কি পায়ের কাছে          বাঁশিটি পড়িয়া আছে

           আলোছায়া পড়েছে কপোলে।
মলিন মালাটি তুলি             ছিঁড়ি ছিঁড়ি পাতাগুলি
           ভাসাইছে সরসীর জলে।
বিষাদ-কাহিনী তার            সাধ যায় শুনিবার
           কোন্‌খানে তাহার ভবন।
তাহার আঁখির কাছে            যার মুখ জেগে আছে
           তাহারে বা দেখিতে কেমন।
এ কী রে আকুল ভাষা !       প্রাণের নিরাশ আশা
           পল্লবের মর্মরে মিশালো।
না জানি কাহারে চায়          তার দেখা নাহি পায়
           ম্লান তাই প্রভাতের আলো।
এমন কত না প্রাতে           চাহিয়া আকাশপাতে
           কত লোক ফেলেছে নিশ্বাস,
সে-সব প্রভাত গেছে,         তারা তার সাথে গেছে
           লয়ে গেছে হৃদয়-হুতাশ !
এমন কত না আশা           কত ম্লান ভালোবাসা
           প্রতিদিন পড়িছে ঝরিয়া,
তাদের হৃদয়-ব্যথা            তাদের মরণ-গাথা
           কে গাইছে একত্র করিয়া,
পরস্পর পরস্পরে            ডাকিতেছে নাম ধরে,
           কেহ তাহা শুনিতে না পায়।
কাছে আসে, বসে পাশে,   তবুও কথা না ভাষে,
           অশ্রুজলে ফিরে ফিরে যায়।
চায় তবু নাহি পায়,         অবশেষে নাহি চায়,
           অবশেষে নাহি গায় গান,
ধীরে ধীরে শূন্য হিয়া       বনের ছায়ায় গিয়া
           মুছে আসে সজল নয়ান।

             
কাঙালিনী
আনন্দময়ীর আগমনে
        আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।
হেরো ওই ধনীর দুয়ারে
        দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।
উৎসবের হাসি-কোলাহল
        শুনিতে পেয়েছে ভোরবেলা,
নিরানন্দ গৃহ তেয়াগিয়া
        তাই আজ বাহির হইয়া
আসিয়াছে ধনীর দুয়ারে
        দেখিবারে আনন্দের খেলা।
বাজিতেছে উৎসবের বাঁশি,
        কানে তাই পশিতেছে আসি,
ম্লান চোখে তাই ভাসিতেছে
        দুরাশার সুখের স্বপন;
চারি দিকে প্রভাতের আলো
        নয়নে লেগেছে বড়ো ভালো,
আকাশেতে মেঘের মাঝারে
        শরতের কনক তপন।
কত কে যে আসে, কত যায়,
        কেহ হাসে, কেহ গান গায়,
কত বরনের বেশভূষা

        ঝলকিছে কাঞ্চন-রতন,
কত পরিজন দাসদাসী,
       পুষ্প পাতা কত রাশি রাশি
চোখের উপরে পড়িতেছে
        মরীচিকা-ছবির মতন।
হেরো তাই রহিয়াছে চেয়ে
        শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে।
শুনেছে সে, মা এসেছে ঘরে,
        তাই বিশ্ব আনন্দে ভেসেছে,
মার মায়া পায় নি কখনো,
        মা কেমন দেখিতে এসেছে।
তাই বুঝি আঁখি ছলছল,
        বাষ্পে ঢাকা নয়নের তারা!
চেয়ে যেন মার মুখ পানে
বালিকা কাতর অভিমানে
        বলে , 'মা গো এ কেমন ধারা ।
এত বাঁশি, এত হাসিরাশি,
এত তোর রতন-ভূষণ,
তুই যদি আমার জননী
        মোর কেন মলিন বসন !'

ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলি
ভাইবোন করি গলাগলি,
        অঙ্গনেতে নাচিতেছে ওই;
বালিকা দুয়ারে হাত দিয়ে
তাদের হেরিছে দাঁড়াইয়ে,
ভাবিতেছে নিশ্বাস ফেলিয়ে

        আমি তো ওদের কেহ নই।
স্নেহ ক'রে আমার জননী
       পরায়ে তো দেয় নি বসন,
প্রভাতে কোলেতে করে নিয়ে
       মুছায়ে তো দেয় নি নয়ন।
আপনার ভাই নেই বলে
       ওরে কি রে ডাকিবে না কেহ ?
আর কারো জননী আসিয়া
       ওরে কি রে করিবে না স্নেহ?
ও কি শুধু দুয়ার ধরিয়া
        উৎসবের পানে রবে চেয়ে
        শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে?
 

ওর প্রাণ আঁধার যখন
       করুণ শুনায় বড়ো বাঁশি,
দুয়ারেতে সজল নয়ন,
       এ বড়ো নিষ্ঠুর হাসিরাশি।
আজি এই উৎসবের দিনে
      কত লোক ফেলে অশ্রুধার,
গেহ নেই, স্নেহ নেই, আহা,
      সংসারেতে কেহ নেই তার।
শূন্য হাতে গৃহে যায় কেহ,
      ছেলেরা ছুটিয়া আসে কাছে,
কী দিবে কিছুই নেই তার,
      চোখে শুধু অশ্রুজল আছে।
অনাথ ছেলেরে কোলে নিবি
      জননীরা, আয় তোরা সব।
মাতৃহারা মা যদি না পায়
      তবে আজ কিসের উৎসব!
দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া
       ম্লানমুখ বিষাদে বিরস,
তবে মিছে সহকার-শাখা
      তবে মিছে মঙ্গল-কলস ।
 

          ভবিষ্যতের রঙ্গভূমি

      সম্মুখে রয়েছে পড়ি যুগ-যুগান্তর ।
অসীম নীলিমে লুটে          ধরণী ধাইবে ছুটে,
      প্রতিদিন আসিবে, যাইবে রবিকর।
      প্রতিদিন প্রভাতে জাগিবে নরনারী,
প্রতিসন্ধ্যা শ্রান্তদেহে         ফিরিয়া আসিবে গেহে,
      প্রতিরাত্রে তারকা ফুটিবে সারি সারি।
      কত আনন্দের ছবি, কত সুখ আশা
আসিবে যাইবে হায়,        সুখ-স্বপনের প্রায়
     কত প্রাণে জাগিবে, মিলাবে ভালোবাসা।
     তখনো ফুটিবে হেসে কুসুম কানন,
তখনো রে কত লোকে      কত স্নিগ্ধ চন্দ্রালোকে
      আঁকিবে আকাশ-পটে সুখের স্বপন।
      নিবিলে দিনের আলো, সন্ধ্যা হলে, নিতি
বিরহী নদীর ধারে            না জানি ভাবিবে কারে,
      না জানি সে কী কাহিনী, কী সুখ, কী স্মৃতি।

      দূর হতে আসিতেছে , শুন কান পেতে —
      কত গান, সেই মহা-রঙ্গভূমি হতে
কত যৌবনের হাসি,         কত উৎসবের বাঁশি,
      তরঙ্গের কলধ্বনি প্রমোদের স্রোতে।
      কত মিলনের গীত, বিরহের শ্বাস,
      তুলেছে মর্মর তান বসন্ত-বাতাস,
সংসারের কোলাহল           ভেদ করি অবিরল
      লক্ষ নব কবি ঢালে প্রাণের উচ্ছ্বাস।

      ওই দূর খেলাঘরে খেলাইছ কারা!
      উঠেছে মাথার 'পরে আমাদেরি তারা।
আমাদেরি ফুলগুলি           সেথাও নাচিছে দুলি,
      আমাদেরি পাখিগুলি গেয়ে হল সারা।
      ওই দূর খেলাঘরে করে আনাগোনা
       হাসে কাঁদে কত কে যে নাহি যায় গণা।
আমাদের পানে হায়         ভুলেও তো নাহি চায়,
       মোদের ওরা তো কেউ ভাই বলিবে না
       ওই সব মধুমুখ অমৃত-সদন,
       না জানি রে আর কারা করিবে চুম্বন।
শরমময়ীর পাশে             বিজড়িত আধ-ভাষে
       আমরা তো শুনাব না প্রাণের বেদন।

       আমাদের খেলাঘরে কারা খেলাইছ!
সাঙ্গ না হইতে খেলা        চলে এনু সন্ধেবেলা,
       ধূলির সে ঘর ভেঙে কোথা ফেলাইছ।
       হোথা, যেথা বসিতাম মোরা দুই জন,
       হাসিয়া কাঁদিয়া হত মধুর মিলন,
মাটিতে কাটিয়া রেখা       কত লিখিতাম লেখা,
       কে তোরা মুছিলি সেই সাধের লিখন।
       সুধাময়ী মেয়েটি সে হোথায় লুটিত,
       চুমো খেলে হাসিটুকু ফুটিয়া উঠিত।
তাই রে মাধবীলতা         মাথা তুলেছিল হোথা,
       ভেবেছিনু চিরদিন রবে মুকুলিত।
       কোথায় রে, কে তাহারে করিলি দলিত।

       ওই যে শুকানো ফুল ছুঁড়ে ফেলে দিলে
       উহার মরম-কথা বুঝিতে নারিলে।
ও যেদিন ফুটেছিল        নব রবি উঠেছিল,
       কানন মাতিয়াছিল বসন্ত-অনিলে।
       ওই যে শুকায় চাঁপা পড়ে একাকিনী
       তোমরা তো জানিবে না উহার কাহিনী।
কবে কোন্‌ সন্ধেবেলা      ওরে তুলেছিল বালা,
      ওরি মাঝে বাজে কোন্‌ পূরবী রাগিণী।
      যারে দিয়েছিল ওই ফুল উপহার
      কোথায় সে গেছে চলে, সে তো নেই আর।
একটু কুসুমকণা            তাও নিতে পারিল না,
      ফেলে রেখে যেতে হল মরণের পার;
কত সুখ, কত ব্যথা,       সুখের দুখের কথা
      মিশিছে ধূলির সাথে ফুলের মাঝার।

      মিছে শোক , মিছে এই বিলাপ কাতর,
      সম্মুখে রয়েছে পড়ে যুগ-যুগান্তর।