ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল
 

 


 

              চিরদিন

কোথা রাত্রি, কোথা দিন, কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা,
কে বা আসে কে বা যায়, কোথা বসে জীবনের মেলা,
কে বা হাসে কে বা গায়, কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা,
কোথা পথ, কোথা গৃহ, কোথা পান্থ, কোথা পথহারা !
কোথা খ'সে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা,
বহে যায় কালবায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে !
এত ভাঙা এত গড়া, আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব —
কোথা কে বা, কোথা সিন্ধু, কোথা ঊর্মি, কোথা তার বেলা —
গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব !
জনপূর্ণ সুবিজনে, জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশমণ্ডপে শুধু বসে আছে এক 'চিরদিন'।

                      ২
কী লাগিয়া বসে আছ, চাহিয়া রয়েছ কার লাগি,
প্রলয়ের পরপারে নেহারিছ কার আগমন,
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ,
চিরবিরহীর মতো চিররাত্রি রহিয়াছ জাগি !
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিশ্বাস,
আকাশপ্রান্তরে তাই কেঁদে উঠে প্রলয়বাতাস,
জগতের ঊর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি !
অনন্ত আঁধার-মাঝে কেহ তব নাহিক দোসর,
পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ,
পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর।
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর —
হাসি, কাঁদি, ভালোবাসি , নাই তব হাসি কান্না মায়া —
আসি, থাকি, চলে যাই কত ছায়া কত উপছায়া !

                       ৩
তাই কি ? সকলি ছায়া ? আসে , থাকে , আর মিলে যায় ?
তুমি শুধু একা আছ, আর সব আছে আর নাই ?
যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে, ফুল ঝরে তাই ?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই , সে কি শুধু মরণের পায় ?
এ ফুল চাহে না কেহ ? লহে না এ পূজা-উপহার ?
এ প্রাণ , প্রাণের আশা, টুটে কি অসীম শূন্যতায় ।
বিশ্বের উঠিছে গান, বধিরতা বহি সিংহাসনে ?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ, শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার ?
যুগযুগান্তের প্রেম কে লইবে, নাই ত্রিভুবনে ?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে —
বাঁশি শুনি চলিয়াছে, সে কি হায় বৃথা অভিসার !
বলো না সকলি স্বপ্ন, সকলি এ মায়ার ছলন —
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে, সে স্বপন কাহার স্বপন ?
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার ?

                      ৪
ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি, প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ।
জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান।
অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ —
যত দেয় তত পায়, কিছুতে না হয় অবসান।
যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন —
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন,
অসীমে জগতে একি পিরিতির আদান-প্রদান !
কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন-উপহারে,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম, সে প্রেমের পাথার কোথা রে!
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে, কোথা সেই অনন্ত জীবন!
ক্ষুদ্র আপনারে দিলে, কোথা পাই অসীম আপন —
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে !

          
বঙ্গভূমির প্রতি
কেন   চেয়ে আছ, গো মা, মুখপানে !
এরা   চাহে না তোমারে চাহে না যে,
        আপন মায়েরে নাহি জানে !
এরা  তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না —
       মিথ্যা কহে শুধু কত কী ভানে !
       তুমি তো দিতেছ মা, যা আছে তোমারি —
       স্বর্ণশস্য তব, জাহ্নবীবারি,
       জ্ঞান ধর্ম কত পুণ্যকাহিনী।
       এরা কী দেবে তোরে, কিছু না, কিছু না —
                মিথ্যা কবে শুধু হীন পরানে!
        মনের বেদনা রাখো, মা, মনে,
        নয়নবারি নিবারো নয়নে,
        মুখ লুকাও, মা, ধূলিশয়নে —
        ভুলে থাকো যত হীন সন্তানে।
        শূন্যপানে চেয়ে প্রহর গণি গণি
        দেখো কাটে কি না দীর্ঘ রজনী
        দুঃখ জানায়ে কী হবে, জননী,
        নির্মম চেতনহীন পাষাণে !

             
বঙ্গবাসীর প্রতি
আমায়     বোলো না গাহিতে বোলো না ।
এ কি      শুধু হাসিখেলা, প্রমোদের মেলা
                  শুধু মিছে কথা ছলনা !
আমায়    বোলো না গাহিতে বোলো না।
এ যে     নয়নের জল, হতাশের শ্বাস,
                  কলঙ্কের কথা দরিদ্রের আশ,
এ যে     বুক-ফাটা দুখে গুমরিছে বুকে
                  গভীর মরমবেদনা।
এ কি     শুধু হাসিখেলা, প্রমোদের মেলা,
                  শুধু মিছে কথা ছলনা !
            এসেছি কি হেথা যশের কাঙালি
            কথা গেঁথে গেঁথে নিতে করতালি ,
            মিছে কথা কয়ে মিছে যশ লয়ে
                  মিছে কাজে নিশিযাপনা !
           কে জাগিবে আজ, কে করিবে কাজ,
           কে ঘুচাতে চাহে জননীর লাজ —
           কাতরে কাঁদিবে, মা'র পায়ে দিবে
                  সকল প্রাণের কামনা।
এ কি    শুধু হাসিখেলা, প্রমোদের মেলা,
                  শুধু মিছে কথা ছলনা!