ভাষাংশ | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর | রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচনাসংগ্রহের সূচি


কড়ি ও কোমল

হৃদয়-আকাশ | অঞ্চলের বাতাস | দেহের মিলন | তনু | স্মৃতি | হৃদয়-আসন | কল্পনার সাথি | হাসি

 


 

         হৃদয়-আকাশ

আমি ধরা দিয়েছি গো আকাশের পাখি,
নয়নে দেখেছি তব নূতন আকাশ।
দুখানি আঁখির পাতে কী রেখেছ ঢাকি,
হাসিলে ফুটিয়া পড়ে উষার আভাস।
হৃদয় উড়িতে চায় হোথায় একাকী
আঁখিতারকার দেশে করিবারে বাস।
ঐ গগনেতে চেয়ে উঠিয়াছে ডাকি,
হোথায় হারাতে চায় এ গীত-উচ্ছ্বাস।
তোমার হৃদয়াকাশ অসীম বিজন —
বিমল নীলিমা তার শান্ত সুকুমার,
যদি নিয়ে যাই ওই শূন্য হয়ে পার
আমার দুখানি পাখা কনকবরন।
হৃদয় চাতক হয়ে চাবে অশ্রুধার,
হৃদয়চকোর চাবে হাসির কিরণ।

         অঞ্চলের বাতাস
পাশ দিয়ে গেল চলি চকিতের প্রায়,
অঞ্চলের প্রান্তখানি ঠেকে গেল গায়,
শুধু দেখা গেল তার আধখানি পাশ —
শিহরি পরশি গেল অঞ্চলের বায়।
অজানা হৃদয়বনে উঠেছে উচ্ছ্বাস,
অঞ্চলে বহিয়া এল দক্ষিণবাতাস,
সেথা যে বেজেছে বাঁশি তাই শুনা যায়,
সেথায় উঠিছে কেঁদে ফুলের সুবাস।
কার প্রাণখানি হতে করি হায়-হায়
বাতাসে উড়িয়া এল পরশ-আভাস!
ওগো কার তনুখানি হয়েছে উদাস,
ওগো কে জানাতে চাহে মরম বারতা !
দিয়ে গেল সর্বাঙ্গের আকুল নিশ্বাস,
বলে গেল সর্বাঙ্গের কানে কানে কথা॥

          দেহের মিলন
প্রতি অঙ্গ কাঁদে তব প্রতি অঙ্গ-তরে।
প্রাণের মিলন মাগে দেহের মিলন।
হৃদয়ে আচ্ছন্ন দেহ হৃদয়ের ভরে
মুরছি পড়িতে চায় তব দেহ -' পরে।
তোমার নয়ন পানে ধাইছে নয়ন,
অধর মরিতে চায় তোমার অধরে।
তৃষিত পরান আজি কাঁদিছে কাতরে
তোমারে সর্বাঙ্গ দিয়ে করিতে দর্শন।
হৃদয় লুকানো আছে দেহের সায়রে,
চিরদিন তীরে বসি করি গো ক্রন্দন।
সর্বাঙ্গ ঢালিয়া আজি আকুল অন্তরে
দেহের রহস্য-মাঝে হইব মগন।
আমার এ দেহমন চির রাত্রিদিন
তোমার সর্বাঙ্গে যাবে হইয়া বিলীন !

               তন
ওই তনুখানি তব আমি ভালোবাসি।
এ প্রাণ তোমার দেহে হয়েছে উদাসী।
শিশিরেতে টলমল ঢলঢল ফুল
টুটে পড়ে থরে থরে যৌবন বিকাশি।
চারি দিকে গুঞ্জরিছে জগৎ আকুল,
সারানিশি সারাদিন ভ্রমর পিপাসী।
ভালোবেসে বায়ু এসে দুলাইছে দুল,
মুখে পড়ে মোহভরে পূর্ণিমার হাসি।
পূর্ণ দেহখানি হতে উঠিছে সুবাস।
মরি মরি কোথা সেই নিভৃত নিলয়
কোমল শয়নে যেথা ফেলিছে নিশ্বাস
তনুঢাকা মধুমাখা বিজন হৃদয়।
ওই দেহখানি বুকে তুলে নেব বালা,
পঞ্চদশ বসন্তের একগাছি মালা॥

             স্মৃতি
ওই দেহ-পানে চেয়ে পড়ে মোর মনে
যেন কত শত পূর্বজনমের স্মৃতি।
সহস্র হারানো সুখ আছে ও নয়নে,
জন্মজন্মান্তের যেন বসন্তের গীতি।
যেন গো আমারি তুমি আত্মবিস্মরণ,
অনন্ত কালের মোর সুখ দুঃখ শোক,
কত নব জগতের কুসুমকানন,
কত নব আকাশের চাঁদের আলোক।
কত দিবসের তুমি বিরহের ব্যথা,
কত রজনীর তুমি প্রণয়ের লাজ,
সেই হাসি সেই অশ্রু সেই-সব কথা
মধুর মুরতি ধরি দেখা দিল আজ।
তোমার মুখেতে চেয়ে তাই নিশিদিন
জীবন সুদূরে যেন হতেছে বিলীন!

            
হৃদয়-আসন
কোমল দুখানি বাহু শরমে লতায়ে
বিকশিত স্তন দুটি আগুলিয়া রয়,
তারি মাঝখানে কি রে রয়েছে লুকায়ে
অতিশয় সযতন গোপন হৃদয় !
সেই নিরালায়, সেই কোমল আসনে,
দুইখানি স্নেহস্ফুট স্তনের ছায়ায়,
কিশোর প্রেমের মৃদু প্রদোষকিরণে
আনত আঁখির তলে রাখিবে আমায় !
কত-না মধুর আশা ফুটিছে সেথায় —
গভীর নিশীথে কত বিজন কল্পনা,
উদাস নিশ্বাসবায়ু বসন্তসন্ধ্যায়,
গোপনে চাঁদিনী রাতে দুটি অশ্রুকণা !
তারি মাঝে আমারে কি রাখিবে যতনে
হৃদয়ের সুমধুর স্বপন-শয়নে !

       
কল্পনার সাথি
যখন কুসুমবনে ফির একাকিনী,
ধরায় লুটায়ে পড়ে পূর্ণিমাযামিনী,
দক্ষিণবাতাসে আর তটিনীর গানে
শোন যবে আপনার প্রাণের কাহিনী —
যখন শিউলি ফুলে কোলখানি ভরি
দুটি পা ছড়ায়ে দিয়ে আনতবয়ানে
ফুলের মতন দুটি অঙ্গুলিতে ধরি
মালা গাঁথ ভোরবেলা গুন্ গুন‍্ তানে —
মধ্যাহ্নে একেলা যবে বাতয়নে ব'সে
নয়নে মিলাতে চায় সুদূর আকাশ,
কখন আঁচলখানি প'ড়ে যায় খ'সে,
কখন হৃদয় হতে উঠে দীর্ঘশ্বাস,
কখন অশ্রুটি কাঁপে নয়নের পাতে —
তখন আমি কি, সখী, থাকি তব সাথে !

              
হাসি
সুদূর প্রবাসে আজি কেন রে কী জানি
কেবল পড়িছে মনে তার হাসিখানি।
কখন নামিয়া গেল সন্ধ্যার তপন,
কখন থামিয়া গেল সাগরের বাণী।
কোথায় ধরার ধারে বিরহবিজন
একটি মাধবীলতা আপন ছায়াতে
দুটি অধরের রাঙা কিশলয়-পাতে
হাসিটি রেখেছে ঢেকে কুঁড়ির মতন!
সারা রাত নয়নের সলিল সিঞ্চিয়া
রেখেছে কাহার তরে যতনে সঞ্চিয়া!
সে হাসিটি কে আসিয়া করিবে চয়ন,
লুব্ধ এই জগতের সবারে বঞ্চিয়া !
তখন দুখানি হাসি মরিয়া বাঁচিয়া
তুলিবে অমর করি একটি চুম্বন।